এশিয়া-প্যাসিফিকের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে?
03:25
1 comment
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় একটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। তা হচ্ছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতিতে তিনি কী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন? নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সফরে এসেছিলেন দু'জন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার। তারা দু'জন ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে 'টু প্লাস টু' শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। এর আগে টোকিওতে 'কোয়াড'-এর (কোয়াডরিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত যার সদস্য) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (৬ অক্টোবর, ২০২০)। এর পরই বঙ্গোপসাগর উপকূলে ভারতের বিশাখাপত্নমের কাছে গভীর সাগরে মালাবার নৌমহড়ায় অংশ নিয়েছিল (৩ নভেম্বর) এই চার দেশের নৌবাহিনী। অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী গত ১৩ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মালাবার নৌমহড়ায় অংশ নিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে মালাবার নৌমহড়া আরব সাগরে ১৭ থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত। 'কোয়াড' শীর্ষ সম্মেলনের মালাবার নৌমহড়া এবং পম্পেও-এসপারের ভারত সফর মূলত একই সূত্রে গাঁথা। এর সঙ্গে আমরা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের শীর্ষ কর্মকর্তা মি. বিগাবের ঢাকা সফরকেও যোগ করতে পারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, এটি তার বড় প্রমাণ। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশিয়া-প্যাসিফিক যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার আরও একটি প্রমাণ হচ্ছে ভারত সফরের পরপরই পম্পেও-এসপার শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া সফর করেছিলেন। তবে নিঃসন্দেহে পম্পেও-এসপারের নয়াদিল্ল্নির সফরের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানো ও ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ উপস্থিতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করছে, তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। ভারতকে কেন্দ্র করেই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। মোদ্দাকথা চীনকে ঠেকানো। আর এ জন্য ভারতকে সঙ্গে নেওয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের এই যে নীতি, এখন জো বাইডেনের প্রশাসন তা কি পরিত্যাগ করবে?
জো বাইডেন একজন সিনেটর হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে কাজ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ২০০১-০৩ ও ২০০৭-০৯ দুই দুইবার সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে বৈদেশিক সম্পর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই আলোকেই বলা যায়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এখন দেখার পালা তিনি কীভাবে মার্কিনি স্বার্থ আদায়ে উদ্যোগী হবেন। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি হচ্ছে চীনের (১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার)। চীন তার 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি দেশকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার প্রভাব বলয় বিস্তার করছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও এটি ঠিক, অতীতে চীন কখনও কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না। দেশটির আধিপত্য বিস্তারের কোনো ইতিহাসও নেই। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের এই কর্মসূচির ব্যাপারে সন্দিহান। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি খুবই জরুরি। দ্বিতীয়ত, এ অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। দক্ষিণ চীন সাগরের তেলের রিজার্ভ রয়েছে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীনের জ্বালানি চাহিদা অনেকটা মেটাবে। যুক্তরাষ্ট্রও চায় এই জ্বালানি সম্পদের ভাগীদার হতে। সুতরাং এখানেও একটি চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক ও মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ ব্যবহার করে চলাচল করে। এ কারণেই এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং, যা মার্কিনি স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই চীনকে মোকাবিলা করতে জাপানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি আরেকটি কারণ। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা ওই দেশকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে তার নৌবাহিনীকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করাতে পারে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সামরিক কৌশলগত জলসীমা হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা রয়েছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৬০ ভাগ সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করার। এ ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন বেশি।
অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। এটাই স্বাভাবিক। কভিড-১৯ বিশ্ব অর্থনীতিতে আঘাত করেছে। তার ঢেউ লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রেও। একটি মহামন্দার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিংবা শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মহামন্দার কথা অনেকেই জানেন। জাপান ও চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ১ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ও ১ দশমিক শূন্য ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বড় অর্থনীতি, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এই অর্থনীতি এখন ঝুঁকির মুখে। ফলে অর্থনীতি একটি বড় সেক্টর, যেখানে জো বাইডেনকে হাত দিতে হবে। আশার কথা, অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন এই শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত বিষয়। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে মরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের উষ্ণতাও বাড়ছে। এটি বৈশ্বিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটি বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিস কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। পরে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কপ-২১ চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। ১৭০টি দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করেছিল। অথচ ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কপ-২১-এ বিশ্বের ১৯৫টি দেশ রাজি হয়েছিল- ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখবে। জো বাইডেন বলেছেন, তিনি কপ-২১ চুক্তিতে ফিরে যাবেন। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপরেও গুরুত্ব দিয়েছেন বাইডেন, যা কিনা বিশ্বে তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে পশ্চিম ইউরোপ তথা ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। ন্যাটোর দেশগুলোকে ন্যাটোতে দেওয়া অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন।
মোদ্দাকথা, ট্রাম্প গত চার বছর বিশ্বকে একটি অস্থিরতার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এখন জো বাইডেনকে ফিরে আসতে হবে। চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' বা বিআরআইর (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের 'এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি'র একটি সমন্বয় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাইডেন যদি ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করেন, যদি চীনকে 'একঘরে' করার ট্রাম্পের নীতি সমর্থন করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেন, তাহলে ট্রাম্প স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর যে ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন, তা আরও শক্তিশালী হবে মাত্র। কভিড-১৯ মোকাবিলা করা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফের যোগ দিয়ে মহামারি রোধে একটি বৈশ্বিক অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করা, ইরান প্রশ্নে ছয় জাতি আলোচনা শুরু করা- এসব বিষয়ও স্থান পাবে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার তালিকায়। এ ক্ষেত্রে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল যে তার পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
Samakal
20.11.2020
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Nintendo Switch in stock on Cyber Monday: Check Mario Kart bundle at Amazon, Best Buy and Walmart
ReplyDeleteA New Strategy as Moderna's Charts Point to Further Gains
Amazon Cyber Monday 2020: Save 25% on Meghan Markle’s Veja Sneakers