রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মার্কিন নির্বাচনের ফল আদালতে?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আগামীকাল ৩ নভেম্বর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। জনমত জরিপে ডেমোক্র্যাট দলীয় ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। আশঙ্কাটা তৈরি হয়েছে ডাকযোগে দেওয়া ভোট ও এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। পোস্টাল ব্যালটের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আপত্তি রয়েছে। তিনি বলেছেন, পোস্টাল ব্যালট না হলে তার 'বিজয়' নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠত না। নির্বাচনের আগেই ডাকযোগে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার বিধান যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। কলোরাডো, হাওয়াই, অরিগন, উটাহ এবং ওয়াশিংটন- এই পাঁচটি স্টেটে নির্বাচনী কার্যক্রম অনেকটাই পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এর বাইরে ৩৩টি স্টেটে এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান একটি 'অপশন'। এর বাইরে অন্তত স্টেটগুলো 'বিশেষ প্রয়োজনে' পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাস কভিড-১৯-এ আক্রান্ত। নতুন করে সেখানে 'দ্বিতীয় ঢেউ' আঘাত করেছে। ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা ২,৩২,২৭২ জন (মোট আক্রান্ত ৯,০৫১,৭৩৫ জন, নতুন আক্রান্ত ১৩,৭০৫, নতুন মৃত্যু ১৮৮)। ফলে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে অনেক স্টেটই ইতোমধ্যে ভোটদান সম্পন্ন করেছে। এটা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ট্রাম্প। নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, (২৮ অক্টোবর) আইনজীবীরা ৪৪টি স্টেটে প্রায় ৩০০ মামলা ফাইল করেছেন। করোনার কারণে এই ভোটদানকে চ্যালেঞ্জ করে এই মামলাগুলো হয়েছে। যেসব স্টেটে এই মামলাগুলো হয়েছে, তার মাঝে আছে বেশ কিছু 'ব্যাটেল গ্রাউন্ড স্টেটস', যেখানে নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটপ্রার্থীদের বিজয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। ট্রাম্প ইতোমধ্যে দাবি করেছেন, নির্বাচনের দিন রাতের মধ্যে সব ভোট গণনা করতে হবে। (হোপপোস্ট, ২৮ অক্টোবর)। অথচ ফেডারেল আইন অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকরা আগাম ভোট দিতে পারবেন; যা পরে গণনা করা হবে। ইতোমধ্যে 'ব্যাটেল গ্রাউন্ড' স্টেটসগুলোতে ৩১.১ মিলিয়ন ভোটার তাদের আগাম ভোট প্রদান করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব সেনাসদস্য ও কূটনৈতিক কোরের সদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন ও সেখানে অবস্থান করে তারা ভোট দিয়েছেন, তাতেও একটা 'জটিলতা' তৈরি হতে পারে। কেননা যে মামলাগুলো করা হয়েছে, তার কোনো একটিতে যদি রায় আগাম ভোটের বিপক্ষে যায়, তখন চূড়ান্ত ফল স্থগিত থাকতে পারে! বিষয়টি তখন সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে। আর এখানেই ট্রাম্পের প্লাস পয়েন্ট। সর্বশেষ তিনি বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটকে সুপ্রিম কোর্টে মনোনয়ন দিয়েছেন। সিনেট তার মনোনয়ন 'কনফার্ম' করায় বিচারপতি ব্যারেট শপথও নিয়েছেন। এর ফলে ৯ সদস্যবিশিষ্ট সুপ্রিম কোর্টে রিপাবলিকান মতাদর্শী বিশ্বাসী বিচারপতির সংখ্যা ছয়জন। পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, যা ট্রাম্পের পক্ষে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ অতীতে কখনোই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের 'নানা কাহিনি' একদিকে তাকে যেমনি বিতর্কিত করেছে, ঠিক তেমনি নির্বাচন নিয়ে তার 'ভূমিকা'ও প্রশ্নবিদ্ধ। গত ১ অক্টোবর এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প বলেছেন, পোস্টাল ব্যালটে জালিয়াতি হতে পারে। তখন থেকেই গুজবের ডালপালা গজাচ্ছে। 'তার উদ্দেশ্য' নিয়ে মিডিয়া প্রশ্ন তুলেছে। ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে একটা আশঙ্কার জায়গা থাকলই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোট দেন বটে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। সিনেট ও প্রতিনিধি সভার সদস্যদের সমন্বয়ে এই নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। প্রতিটি স্টেটের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা আলাদা। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া আর নেভাদা স্টেটের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা। কোনো স্টেটে বেশি, কোনো স্টেটে কম। পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ২৩টি, আবার ডেলওয়ারে মাত্র তিনটি। সবচেয়ে বেশি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ক্যালিফোর্নিয়ায়- ৫৪টি; নিউইয়র্কে ৩৩টি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো প্রার্থী কোনো রাজ্যে বিজয়ী হলে সে রাজ্যে যে ক'টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট রয়েছে, তার পুরোটা তিনি পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে যে প্রার্থী হেরে যান, তিনি নির্বাচকমণ্ডলীর কোনো ভোট পান না। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। জিততে হলে পেতে হবে ২৭০টি ভোট। নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করছেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। ১৪টি 'ব্যাটেল গ্রাউন্ড' স্টেটের কথা আলোচনায় এসেছে। সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা যায়, শুধু জর্জিয়া, আইওয়াতে জো বাইডেন ট্রাম্পের কাছ থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছেন। টেক্সাস রিপাবলিকান স্টেট হিসেবে পরিচিত। ২০১৬ সালে এই স্টেটে ট্রাম্প ৯ দশমিক ১ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। এবার দেখা গেল বাইডেন এগিয়ে আছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিয়াল ক্লিয়ার পলিটিক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, আইওয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, পেনসিলভানিয়া, টেক্সাস ও উইসকনসিনে ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিলেন। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, এখন অবধি এসব সুইং স্টেটের মাঝে শুধু জর্জিয়া ও আইওয়াতে ট্রাম্প এগিয়ে আছেন। তারপরও কথা থেকে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি হার স্বীকার করবেন কিনা? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাস ২৩১ বছরের, ১৭৮৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত (স্বাধীনতা ঘোষণা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই)। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৮৯-১৭৯৭)। তিনি ছিলেন ফেডারেলিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী। জর্জ অ্যাডামসও ছিলেন ফেডারেলিস্ট পার্টির প্রার্থী (১৭৯৭-১৮০১)। কিন্তু তৃতীয় প্রেসিডেন্টের (থমাস জেফারসনের, ১৮০১-১৮০৯) শাসনামল থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট রিপাবলিকান পার্টি একসঙ্গে একক প্রার্থী হিসেবে চার টার্মে ক্ষমতায় ছিল। সপ্তম প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসনের (১৮২৯-১৮৩৭) সময় থেকেই ডেমোক্র্যাট পার্টি আলাদাভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। রিপাবলিকান পার্টির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন (১৬তম প্রেসিডেন্ট, ১৮৬১-১৮৬৫)। সেই থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দুটি বড় দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির মাঝে সীমাবদ্ধ। প্রথম দিকে অবশ্যি তৃতীয় একটি পার্টি উইগ পার্টির অস্তিত্ব ছিল। উইগ পার্টির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন (নবম, ১৮৪১)। যদিও নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারেননি। ট্রাম্প হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। তিনি রিপাবলিকান দলের সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। এমন একটি সময় এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন মহামারি কভিড-১৯-এর প্রকোপ থেকে বিশ্ব বের হয়ে আসতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে মহামারির টিকা আবিস্কারের নেতৃত্ব দিতে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে 'বাণিজ্যযুদ্ধ' ও সম্পর্কের অবনতি এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নয়া প্রেসিডেন্টের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। ট্রাম্প যদি পুনরায় নির্বাচিত হন, তাহলে বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে। আর জো বাইডেন নির্বাচিত হলে পরিবর্তন আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে। তবে নির্বাচনের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে গড়ায় কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয় Somokal 2.11.2020

0 comments:

Post a Comment