যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
10:50
No comments
আগামীকাল মঙ্গলবার ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে সারাবিশ্ব। একদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্ব যখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে এবং করোনা ভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ যখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে শুরু করেছে, তখনই নিয়মমাফিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩৩ কোটি মানুষের জন্য অনেক কিছু। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে বর্ণবাদের উত্থান ও শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসি, ১১ দশমিক ১ ভাগ বেকারত্ব, কোভিড-১৯ রোধে ব্যর্থতা, উৎপাদন খাতে ধস ও ব্যাপক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া, নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা এবং সর্বোপরি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা যুক্তরাষ্ট্রকে আজ যে অবস্থানে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে আসতে পারবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। জনমত জরিপে ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও একটা শঙ্কার জায়গা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে যে, ট্রাম্প এই ফলাফল নাও মানতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডাকযোগে ভোট দেওয়ার বিষয়টি একটি ‘কমন প্রাকটিস’। কিন্তু এবার ডাকযোগে দেওয়া ভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বয়ং ট্রাম্প। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনি বিষয়টি সুপ্রিমকোর্টে নিয়ে যাবেন। আশঙ্কার জায়গাটা এখানেই যে, তিনি বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটকে সুপ্রিমকোর্টে মনোনয়ন দিয়েছিলেন এবং সিনেট তাকে অনুমোদনও দিয়েছে। তিনি শপথও নিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, সুপ্রিমকোর্টে ৬-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ট্রাম্পের পক্ষে যে কোনো সিদ্ধান্ত এখন আসতে পারে। মোটামুটিভাবে এটা নিশ্চিত যে, নির্বাচনের ফলাফল যদি ট্রাম্পের পক্ষে না আসে, তা হলে তিনি সুপ্রিমকোর্টকে তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন! তিনি সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র নন। তার অনেক দিনের ‘স্বপ্ন’ ছিল তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন এবং তিনি হয়েছেনও। তিনি কখনো রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ কোনো নেতা ছিলেন না। কোনোদিন গভর্নর, সিনেটর কিংবা প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতাও তার নেই। তবে একজন ধনী ব্যক্তি হিসেবে ২০১৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন প্রাইমারিগুলোতে। শেষ পর্যন্ত এই অর্থ ব্যয়ই তাকে হোয়াইট হাউসে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ২০১৬ সালে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ৪ বছর অন্তর নির্বাচিত হন নির্বাচকম-লীর ভোটে। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ৫০টি, আর নির্বাচকম-লীর সংখ্যা ৫৩৮। সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের মোট সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে এই নির্বাচকম-লী গঠিত হয়। যেমন বলা যেতে পারে, ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচকম-লীর ভোটের সংখ্যা ৫৪টি, আবার নর্থ ডাকোটার ভোটার সংখ্যা মাত্র ৩। বড় রাজ্যগুলোর নির্বাচকম-লীর সংখ্যাও বেশি (যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার পর নিউইয়র্কের ৩৩, আর টেক্সাসের নির্বাচকম-লীর ভোটের সংখ্যা ৩২)। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো প্রার্থী কোনো রাজ্যে বিজয়ী হলে, সেই রাজ্যে যে কটি নির্বাচকম-লীর ভোট রয়েছে, তার পুরোটা তিনি পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে যে প্রার্থী হেরে যান তিনি নির্বাচকম-লীর কোনো ভোট পান না। অর্থাৎ জনসাধারণের ভোটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচত হন না। নির্বাচিত হন নির্বাচকম-লীর ভোটে। তবে জনসাধারণ ভোট দেন। এটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে ৩৪টি সিনেট সিট ও প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি সিটেরও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বেশ কয়েকটি গভর্নর পদেও এবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বলা ভালো, প্রতি ৬ বছর অন্তর অন্তর সিনেট সদস্যরা পর্যায়ক্রমে নির্বাচিত হন। আর প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচন হয় ৪ বছর অন্তর। ভোটের প্যাটার্ন অনুযায়ী রাজ্যগুলো দলীয়ভাবে বিভক্ত, অর্থাৎ কোনো কোনো রাজ্যে ডেমোক্র্যাটদের প্রভাব বেশি (যেমন নিউইয়র্ক) এবং সে কারণেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচকম-লীর সব ভোট ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থীই পান। কোনো কোনো রাজ্যে (যেমন টেক্সাস), সেখানে রিপাবলিকানদের প্রভাব বেশি, সব নির্বাচকম-লীর ভোট রিপাবলিকান প্রার্থী পান। তবে কয়েকটি রাজ্য আছে (ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, মিসিগান, নর্থ ক্যারোলিনা, আরিজোনা, উইসকনসিন), এই রাজ্যগুলো ‘Battleground States ’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ এখানে ভোটাররা বিভক্ত। এই রাজ্যগুলোই চূড়ান্ত বিচারে কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে। এখানে ভোটাররা বারবার মত পরিবর্তন করেনÑ কখনো ডেমোক্র্যাট শিবিরে, কখনো রিপাবলিকান শিবিরে। কিছু তথ্য দিই। ফ্লোরিডায় (নির্বাচকম-লীর ভোট ২৫), রিপাবলিকানরা বিজয়ী হয়েছিল ১৯৯২, ২০০০, ২০০৪ আর ২০১৬ সালে। আবার এই রাজ্যেই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী (বিল ক্লিনটন) বিজয়ী হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে ও পরে বারাক ওবামা (২০০৮ ও ২০১২)। ঠিক তেমনি পেনসিলভানিয়ায় (ভোট ২৩) ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা ১৯৯২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত পরপর ৬ বার বিজয়ী হলেও ২০১৬ সালে এখানে বিজয়ী হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আবার নর্থ ক্যারোলিনায় (১৪) রিপাবলিকান প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন ১৯৯২, ১৯৯৬, ২০০০ ও ২০০৪ সালে। কিন্তু ২০০৮ সালে বারাক ওবামা এখানে বিজয়ী হলেও ২০১২ সালে কিন্তু তিনি এখানে বিজয়ী হতে পারেননি। আরও একটি বিষয় লক্ষ করার মতোÑ আর তা হচ্ছে এই ৬টি রাজ্যে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিলেন। একটি রাজ্যেও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ২০১৬ সালে বিজয়ী হতে পারেননি। তাই ২০২০ সালে জো বাইডেন এই ৬টি রাজ্যের নির্বাচকম-লীর ভোটের ফলাফল তার অনুকূলে নিতে পারবেন কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এই ৬টি রাজ্যে নির্বাচকম-লীর ভোটার সংখ্যা ৯৯। মোট ৫৩৮ নির্বাচকম-লীর ভোটে যিনি ২৭০-এর ওপরে নির্বাচকম-লীর ভোট পাবেন, তিনিই বিজয়ী হবেন। এ ক্ষেত্রে ওপরে উল্লেখিত ৯৯ ভোট নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিটি নির্বাচনের আগেই কতগুলো ইস্যু থাকে। এবারও আছে। কোভিড-১৯ একটি ইস্যু। ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিদিন সংক্রমিত হতো ৬৯১৩৮ আর ১ নভেম্বর এটা প্রাক্কলন করা হয়েছে ১২১৯১৬ জনে (প্রগ্রেস রিপোর্ট)। অর্থাৎ সংক্রমণের হার বাড়ছে। এটা একটা ইস্যু। ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা এখানে চোখে লাগার মতো। কিন্তু পোস্টাল ব্যালট এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।Truthout এর প্রতিবেদক শানা ইস্ট লিখেছেন, Is Trump Trying to suppress Votes by saying He will Disregard Election Results ( 28 October )নির্বাচন-ফলাফল তিনি উপেক্ষা করবেন? যুক্তরাষ্ট্রের যেসব সেনাসদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন এবং সেখানে অবস্থান করে আগাম ভোট দিয়েছেন, তা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, নির্বাচনের দিন রাতের বেলাতেই সব ভোট গণনা করতে হবে (Huffpost , ২৮ অক্টোবর)। অথচ ফেডারেল আইন অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকরা আগাম ভোট দিতে পারবেন, যা পরে গণনা করা হয়। ২৭ অক্টোবরের মধ্যে ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ স্টেটগুলোতে ৩১.১ মিলিয়ন ভোটার তাদের ভোটাধিকার ইতোমধ্যে প্রয়োগ করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, আইনজীবীরা ৪৪টি স্টেটে প্রায় ৩০০ মামলা ফাইল করেছেন। করোনার কারণে আগাম ভোট প্রদানকে কেন্দ্র করে ওই মামলাগুলো হয়েছে। ট্রাম্প যদি নির্বাচনের ফলাফল তার অনুকূলে আনতে না পারেন, তা হলে বিষয়টি সুপ্রিমকোর্টে নিয়ে যেতে আইনজীবীদের উৎসাহিত করবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এটা বিবেচনা করেই তিনি বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটকে (রিপাবলিকান মতাদর্শী) সুপ্রিমকোর্টে মনোনয়ন দিয়েছিলেন।
ইতোমধ্যে ব্যারেটের মনোনয়ন সিনেট কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টে ৬-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রিপাবলিকানদের সমর্থন বেশি। ফলে পোস্টাল ব্যালটের বিষয়টি নিয়ে একটি জটিলতা তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, বেশ কটি বিদেশি রাষ্ট্র নির্বাচনে ‘হস্তক্ষেপ’ করার চেষ্টা করছে। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টে চীন, রাশিয়া ও ইরানের কথা বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্বাচন ও নির্বাচনী ফল নিয়ে একটা শঙ্কা থেকেই গেল।
Amader Somoy
2.11.2020
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment