রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাইডেন কি বিভক্তির দেয়াল ভাঙতে পারবেন?

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি এমন সব কথা বলেছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মার্কিন সমাজের বর্তমান অবস্থাকে তুলে ধরেছে। বারাক ওবামার ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেক বেশি বিভক্ত। এ বিভক্তির দেয়াল তুলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মাত্র এক নির্বাচনে ট্রাম্পের বিভক্তির দেয়াল ভাঙা সম্ভব নয়; আরও কয়েক নির্বাচন লাগবে। বারাক ওবামা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হওয়া তীব্র ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ দেশটির বিভক্তি আরও তীব্র করেছে। তার মতে, জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয় এসব বিভক্তি মেরামতের শুরু। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে ও বিভক্তির প্রবণতা কমিয়ে আনতে একাধিক নির্বাচন পার করতে হবে। বিবিসিকে ওবামা আরও বলেছেন, গ্রামীণ ও শহুরে আমেরিকান এবং অভিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও বিভক্তি তৈরি হয়েছে। অনেক অন্যায্য বিষয় স্থান পেয়েছে সমাজে। যেমন, অসমতা ও তীব্র ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মতো বিষয় সামনে এসেছে। অনেকে একে ‘সত্য ও নৈতিকতার অবক্ষয়’ বলেছেন। এটি কিছু মার্কিন মিডিয়া ছড়িয়ে দিয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এগুলো ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন সমাজে। এসব কারণে আমরা এখন অনেক বেশি বিভক্ত একটি সমাজ। ওবামা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবৈষম্য নিয়েই কথা বলেননি; বরং অতি সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই ব্যাপারেও কথা বলেছেন। ওবামা স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমেরিকান সমাজে মৌলিক একটি ভুল জায়গা করে নিয়েছে। সেটি হল বর্ণবাদ ইস্যু। একে নিজেদের মূল পাপ বলে অভিহিত করেন সাবেক এ প্রেসিডেন্ট। এ ধরনের কথাবার্তা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। খুব স্পষ্ট করে বর্ণবাদ তথা বিভক্ত সমাজ নিয়ে বারাক ওবামা অতীতে কোনোদিন কথা বলেছেন বলে আমার মনে হয় না। ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রায় ট্রাম্প কর্তৃক মেনে না নেয়া, রায় বানচাল করতে নানা অপকৌশল, মামলা-মোকদ্দমা, ট্রাম্প কর্তৃক তার সমর্থকদের উসকে দেয়া, ভোট গণনা কেন্দ্রে হামলার ঘটনা একের পর এক যখন ঘটছে, তখনই বারাক ওবামা এ ধরনের কথা বললেন। একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি! পাঠক, কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে পারেন। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎকে একটা প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছিল। এ আন্দোলন ইউরোপের অনেক দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের একটা পুরনো ‘রোগ’-১৯৬৩ সালে দেয়া মার্কিন লুথার কিং-এর সেই বিখ্যাত ভাষণ ও have a dream (আমার একটি স্বপ্ন আছে)-এর পর এতটা বছর পার হয়ে গেছে; কিন্তু বর্ণবাদকে সেখানে সমাজ থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড এর সর্বশেষ উদাহরণ। টেলিভিশনের বদৌলতে সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে, ঘাড়ের ওপর হাঁটু চেপে ধরে একজন শ্বেতাঙ্গ অফিসার কীভাবে শ্বাস বন্ধ করে ‘খুন’ করেছিলেন জর্জ ফ্লয়েডকে। ফ্লয়েডকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমি শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছি না’; কিন্তু তারপরও ওই শ্বেতাঙ্গ অফিসার ফ্লয়েডের ঘাড়ের উপর থেকে হাঁটু সরিয়ে নেননি। দীর্ঘ ৮ মিনিট ওই অবস্থায় থেকে ফ্লয়েড মারা যান। ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দ্রুত আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই যে আজ ‘Black live Matters’-এর ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে তেমনটি নয়; বরং শ্বেতাঙ্গরাও এ বিক্ষোভে শরিক হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসের বাংকারে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল তার নিরাপত্তারক্ষীরা। শুধু একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের একটি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যা সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গেছে; তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আমেরিকান সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরিব আরও গরিব হয়েছে (দেখুন Wealth Inequality in America)। এতে দেখা যায়, কীভাবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে সেখানে। কভিড-১৯ সংক্রমণের এ সময়টাতেও শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাঝে কভিড-১৯ এ আক্রান্ত, মৃত্যুহার ও চাকরি হারানোর হার বেশি (আরবান ওয়ার, ১০ এপ্রিল ২০২০)। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন (২০ মে, ২০২০) থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে যত মানুষ মারা গেছে (আক্রান্ত ১২০৭২৫৬০ জন, মৃত্যু ২৫৮৩৫৪ জন, ২০ নভেম্বর); তার মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গ মৃত্যুর চেয়ে তিনগুণ বেশি। ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের তথ্যমতে, প্রতি পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের মধ্যে একজনের কোনো হেলথ ইন্স্যুরেন্স অর্থাৎ স্বাস্থ্যবীমা নেই। এরা নিয়মিত চিকিৎসা পান না। মৃত্যুর এটা একটা বড় কারণ। ফলে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ (২১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০১৯); কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। করোনাভাইরাসের সময় এ বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ যখন বৃদ্ধি পায়, তখন দেখা গেল- হাসপাতালগুলোয় যথেষ্ট পরিমাণ আইসিইউ বেড নেই। ভেন্টিলেটর নেই। মাস্ক নেই। ডাক্তার তথা নার্সদের জন্য পিপিই নেই। শুধু ভেন্টিলেটরের অভাবে শত শত মানুষ সেখানে মারা গেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের পেছনে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা আরও উন্নত করা যেত, সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেত। এতে স্বাস্থ্য সেক্টরে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছিল, তা কমিয়ে আনা যেত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতির কারণে, বিশেষ করে ‘ওবামা কেয়ার’ বাতিল করে দেয়ায় এ বৈষম্য আরও বেড়েছে। ট্রাম্প স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বীমা কোম্পানি তথা ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষে কাজ করে গেছেন। ফলে কভিড-১৯ মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ালেও এক্ষেত্রে তার কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। কৃষ্ণাঙ্গ অসন্তোষ দানা বাঁধার পেছনে ট্রাম্পের অনেক বক্তব্যও দায়ী। আন্দোলনকারীদের তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি এ আন্দোলকে চিহ্নিত করেছিলেন অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস হিসেবে (নিউইয়র্ক টাইমস)। যেখানে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডে তার সহানুভূতি দেখানোর কথা; সেখানে তিনি তাদের সন্ত্রাসী, এমনকি সেনাবাহিনী নামিয়ে আন্দোলন দমন করার কথাও বলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ট্রাম্প প্রশাসনের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও ব্রায়েনও আন্দোলনকারীদের ‘বহিরাগত জঙ্গি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ ধরনের বক্তব্য ছিল মূল ঘটনাকে আড়াল করার শামিল। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাবলিকে পর্যবেক্ষকরা আখ্যায়িত করেছেন ‘Racism and Racial Terrorism Has Fueled Nationwide Anger’ হিসেবে (অ্যামিওডম্যান, ট্রুথআউট, ১ জুন); অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যে বর্ণবাদ এখনও আছে, তা-ই উসকে দিয়েছে জর্জ ফ্লয়েডের এই মৃত্যু। আরেকজন বিশ্লেষক উইলিয়াম রিভাস পিট এ আন্দোলনকে একটি ‘বিপ্লবের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। একধরনের ‘কালার রেভুলেশন’-এর কথাও বলেছেন কেউ কেউ। নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ধরনের সংকটে আছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা চরমে উঠেছে। ইতোমধ্যে ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে এনেছেন। অথচ করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এখানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র তথা শীর্ষ ধনী দেশগুলোর মাঝে একটা সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে ট্রাম্প একা চলতে চান, যা করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট নয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে Black Lives Matter ট্রাম্পবিরোধী আন্দোলনে নতুন এক রূপ পেয়েছিল। এ আন্দোলন ইউরোপসহ অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে, ট্রাম্পের বর্ণবাদী নীতির ব্যাপারে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সমর্থন নেই। ট্রাম্প জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন হোয়াইট হাউসে। কিন্তু জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল তাতে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ফলে ওই সময় জি-৭ সম্মেলন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এরপর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে জয়-পরাজয় স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু তিন সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও ট্রাম্প এ ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন। ১৯ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস আমাদের জানাচ্ছে-ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরা নির্বাচন কর্মকাণ্ডে জড়িতদের হুমকি দিচ্ছে। Independent-এর খবর- Georgia secretary of state and wife receive death threat amid election recount (১৯ নভেম্বর)। ট্রাম্প সমর্থকরা জর্জিয়ায় ভোট জালিয়াতি হয়েছে, এ অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সেক্রেটারি অব স্টেট ব্রাড রাফেনস্পারগার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। এর পরই তাকে ও তার স্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়ে টেক্সট মেসেজ পাঠানো হয়। অ্যারিজোনায়ও ভোট পুনঃগণনার সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিই বলে দেয় রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র কতটা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ দ্বন্দ্ব; অন্যদিকে উগ্র ট্রাম্প সমর্থকদের ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা ও নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করা পুরো মার্কিন সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে। এতে ২০ জানুয়ারিতে ক্ষমতা হস্তান্তর কীভাবে হবে, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল Jugantor 22.11.2020

1 comments: