ট্রাম্প যুগের অবসান হতে যাচ্ছে কি?
01:13
1 comment
আগামী মঙ্গলবার ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা নিশ্চিত হয়ে যাবে যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকতে পারবেন, নাকি হোয়াইট হাউস একজন নয়া প্রেসিডেন্ট পাবে। জনমত জরিপ ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনের পক্ষে থাকলেও বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়ায় কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ডাকযোগে দেয়া ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এবং বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে, এমন একটি ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাটদের আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। সিনেট তা কনফার্মও করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, সুপ্রিমকোর্টে এখন বিচারপতিদের দলীয় অবস্থান ৬-৩।
অর্থাৎ ৬ জন রিপাবলিকান মতাদর্শ অনুসারী (যার মাঝে ৩ জন মনোনয়ন পেয়েছেন ট্রাম্পের শাসনামলে), আর ৩ জন ডেমোক্র্যট মতাদর্শের অনুসারী। এর অর্থ হচ্ছে, ডাকযোগে দেয়া ভোট নিয়ে যদি ট্রাম্প প্রশ্ন তোলেন, তাহলে তা সুপ্রিমকোর্টে যাবে এবং সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের অনুকূলে যেতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ভোটারদের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোট এবার ‘পোস্টাল ব্যালটের’ মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। যুক্তরাষ্ট্রে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেয়া একটা কমন প্র্যাকটিস। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ৩৩ মিলিয়ন ভোটার পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ভোট দিয়েছিল। এ সংখ্যা এবার ৮০ মিলিয়নে উন্নীত হতে পারে। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হয়েছে। ১ অক্টোবর ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় পোস্টাল ব্যালটে জালিয়াতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। যদিও ফেডারেল নির্বাচন কমিশনার এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে মনটানাতে গভর্নর স্টিভ বুলক একটি আইনে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে এ রাজ্যের প্রতিটি কাউন্টিতে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদানের নির্দেশ তিনি দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটা চ্যালেঞ্জ করা হলেও কোর্ট গভর্নরের সিদ্ধান্তের পক্ষেই রায় দিয়েছেন। ফলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যেতে পারে। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা, তা দূর হয়নি। সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটের সিনেটে মনোনয়ন ‘কনফার্ম’ হওয়ায় এবং তিনি শপথ নেয়ায় এ শঙ্কা এখন আরও বেড়েছে।
এখানে একটা কথা বলা ভালো, বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন করোনাভাইরাস। সারা বিশ্বে এ ভাইরাসে প্রায় ১২ লাখ মানুষ মারা গেলেও (যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার ১৮০) ট্রাম্প এই মহামারীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। ‘চীনা ভাইরাস’ বলেও তিনি করোনাভাইরাসকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মাস্ক ব্যবহার করেন না। আর বাইডেন বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে তার প্রথম কাজ হবে মহামারী মোকাবেলা করা। কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নীতির কোনো ফল পাওয়া যায়নি। কর্মসংস্থান বাড়েনি। বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জো বাইডেনের বক্তব্য হচ্ছে- করোনাভাইরাসের তাৎক্ষণিক ধাক্কা সামাল দিতে যত অর্থের প্রয়োজন হয়, তত অর্থ তিনি দেবেন। এর মাঝে রয়েছে ছোটখাটো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ঋণ এবং পরিবারগুলোকে নগদ অর্থ সাহায্য প্রদান। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে প্রতি মাসে ২০০ ডলার ও শিক্ষার্থীদের ১০ হাজার ডলার ঋণ মওকুফেরও প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। পরিবেশবান্ধব জ্বালানির জন্য দুই ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং আমেরিকান পণ্য ক্রয়ের জন্য ৪০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন। চীনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের পণ্য টিকিয়ে রাখা হচ্ছে ট্রাম্পের নীতি। এ কারণেই তিনি চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে বাইডেনের নীতি খুব স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অবস্থান ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। তার নীতি দক্ষিণ চীন সাগরে তথা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনবিরোধী একটা অ্যালায়েন্স তৈরি করছে। মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগানের সাম্প্রতিক নয়াদিল্লি ও ঢাকা সফর এর বড় প্রমাণ। অন্যদিকে জো বাইডেন বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান। ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক জোট করতে চান তিনি। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন কমিয়ে আনতে চান। আর জো বাইডেনের নীতি অনেকটা প্রো-অভিবাসন।
জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব ইস্যুতে ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ভোটাররা ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আচরণ, ব্যক্তিগতভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, ক্ষমতার অপব্যবহার করা, ট্যাক্স না দেয়া ইত্যাদিতে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন- যে কারণে জনমত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চলে গেছে। তবে শেষ কথা বলা যাবে না এখনই। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ স্টেটগুলোর ব্যাপারে পর্যবেক্ষকদের আগ্রহ বেড়েছে। যেমন- নিউ হ্যাম্পশায়ার, পেনসিলভানিয়া, ওহাইও, ভার্জিনিয়া, নিউ ক্যারোলিনা, ফ্লোরিডা, আইওয়া, উইসকনসিন, মিনেসোটা ইত্যাদি। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, এ রাজ্যগুলোতে অনেক ভোটারই কোনো একটি দলের কট্টর সমর্থক নন এবং প্রার্থীদের নীতিমালা ও আগামী চার বছরে প্রার্থীদের পরিকল্পনার বিচারে তারা শেষ মুহূর্তে ভোট দেন। ভোটাররা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন ভোটের জন্য। ফলে এই ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ স্টেটগুলোর যে কোনো একটি শেষ মুহূর্তে যে কোনো একজন প্রার্থীর পক্ষে হেলে যেতে পারে, যা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। এ রাজ্যগুলোকে ‘সুইং স্টেট’ও বলা হয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনে এ ‘সুইং স্টেট’গুলোর ফলাফলেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিজয়ী হতে পেরেছিলেন। এবারেও তেমন কিছু ঘটতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
পাঠক মাত্রেই জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোট দেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। সিনেট ও প্রতিনিধি সভার সদস্যদের সমন্বয়ে এ নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা আলাদা। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়া আর নেভাদা রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা। কোনো রাজ্যে বেশি, কোনো রাজ্যে কম। পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ২৩টি, আবার ডেলাওয়ারে মাত্র ৩টি। সবচেয়ে বেশি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ক্যালিফোর্নিয়ায়- ৫৪টি, নিউইয়র্কে ৩৩টি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো প্রার্থী কোনো রাজ্যে বিজয়ী হলে সে রাজ্যে যে ক’টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট রয়েছে, তার পুরোটা তিনি পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে যে প্রার্থী হেরে যান, তিনি নির্বাচকমণ্ডলীর কোনো ভোট পান না। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। জিততে হলে পেতে হবে ২৭০টি ভোট। নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে।
১৪টি ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ স্টেটের কথা আলোচনায় এসেছে। সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা যায় জর্জিয়া, আইওয়াতে জো বাইডেন ট্রাম্পের থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছেন। টেক্সাস রিপাবলিকান স্টেট হিসেবে পরিচিত। ২০১৬ সালে এই স্টেটে ট্রাম্প ৯.১ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। এবারে দেখা গেল বাইডেন এগিয়ে আছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিয়াল ক্লিয়ার পলিটিক্সের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, আইওয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহাইও, পেনসিলভানিয়া, টেক্সাস ও উইসকনসিনে ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিলেন। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এসব সুইং স্টেটের মাঝে শুধু জর্জিয়া ও আইওয়াতে ট্রাম্প এগিয়ে আছেন।
কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে ট্রাম্প যদি হেরে যান, তাহলে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন কিনা তাকে এ প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি জবাব দিয়েছেন এভাবে- ‘ডাকযোগে ভোট না দিলে তার বিজয় নিয়ে এ প্রশ্ন উঠত না।’ ভয়টা হচ্ছে এখানেই যে, ভোটের ফলাফল তার পক্ষে না গেলে তিনি বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে যেতে পারেন। আর সুপ্রিমকোর্টে তার সমর্থকের সংখ্যা বেশি থাকায় কোর্ট তার পক্ষে রায় দিলে আমি অবাক হব না। প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাস ২৩১ বছরের, ১৭৮৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত (স্বাধীনতা ঘোষণা ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই)। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৮৯-১৭৯৭)। তিনি ছিলেন ফেডারেলিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী। জর্জ এডামসও ছিলেন ফেডারেলিস্ট পার্টির প্রার্থী (১৭৯৭-১৮০১)। কিন্তু তৃতীয় প্রেসিডেন্টের (টমাস জেফারসন, ১৮০১-১৮০৯) শাসনামল থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান পার্টি একসঙ্গে একক প্রার্থী হিসেবে চার টার্মে ক্ষমতায় ছিল। সপ্তম প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসনের (১৮২৯-১৮৩৭) সময় থেকেই ডেমোক্র্যাট পার্টি আলাদাভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। রিপাবলিকান পার্টির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন (১৬তম প্রেসিডেন্ট, ১৮৬১-১৮৬৫)। সেই থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দুটি বড় দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রথমদিকে অবশ্য তৃতীয় একটি পার্টি উইগ পার্টির অস্তিত্ব ছিল। উইগ পার্টির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন (৯ম, ১৮৪১), যদিও নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারেননি। ট্রাম্প হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। তিনি রিপাবলিকান দলের সদস্য।
সারা বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের দিকে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ট্রাম্প-পরবর্তী যুগের সূচনা হয় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।
Jugantor
1.11.2020
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
স্যার আপনার বিশ্লেষন সব সময়ই নতুন করে ভাবার খোরাক যোগায়।
ReplyDelete