রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রসঙ্গ ইভি এম পদ্ধতি

বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট কারচুপি সম্ভব নয়, জাল ভোট প্রদান ও সিল মেরে নির্বাচনও সম্ভব নয়। যারা ভোট চুরি করে নির্বাচন করতে চায়, এটা তাদের জন্য খুব খারাপ হবে। দৈনিক ডেসটিনিতে তার এই বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবেই (২৯ জানুয়ারি)। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত ২৮ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সার্ভার স্টেশন উদ্বোধন করে এ বক্তব্য দেন। তিনি এই বক্তব্যটি দিলেন এমন একসময় যখন চলতি সপ্তাহেই পুরো নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে একটি সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা সিইসি তথা নির্বাচন কমিশনারদের একটি তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। শুধু তাই নয়, তার এ বক্তব্য আসলে এমন এক সময় যখন দিলি্লর হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম যন্ত্রটি টেম্পারপ্রুফ নয়। অর্থাৎ ইভিএম দিয়ে কারসাজি করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় দিলি্লর হাইকোর্টের এই রায়ের সংবাদও ছাপা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াতের মতো ব্যক্তিত্ব নিশ্চয়ই এই সংবাদটি পাঠ করে থাকবেন। কিন্তু তারপরও তিনি যখন ইভিএমের পক্ষ যুক্তি দেখান, তখন তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! আধুনিক প্রযুক্তি অবশ্যই আমরা চাই। কিন্তু যে প্রযুক্তি নিয়ে খোদ উন্নত বিশ্বেই প্রশ্ন আছে, সেখানে এই মুহূর্তে এই প্রযুক্তিতে না গেলেই আমরা ভালো করতাম। ইতিমধ্যে প্রায় তিন লাখ ইভিএম তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে ব্যয় হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বড় কথা, প্রধান বিরোধী দলসহ বেশ কটি রাজনৈতিক দল যেখানে ইভিএমের বিরোধিতা করছে, সেখানে এই মুহূর্তে আমরা এ ধরনের সিদ্ধান্তে না গেলেও পারতাম। ইভিএমের আগে প্রয়োজন দশম সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা। সার্চ কমিটির ব্যাপারে বিরোধী দল আপত্তি করেছে। ফেব্রুয়ারিতেই ইসি পুনর্গঠন করতে হবে। সংশোধিত সংবিধানে ৫ম নির্বাচন কমিশনারের (সিইসিসহ) কথা বলা হয়েছে। এটা সত্য। কিন্তু এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনে অতিরিক্ত আরো দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। এতে সংবিধানের ধারাবাহিকতাও লঙ্ঘিত হবে না। সংবিধানে পাঁচজনের কথা বলা আছে সত্য; কিন্তু সরকার যদি মনে করে এই মুহূর্তে (যখন দেশে কোনো নির্বাচন নেই) নির্বাচন কমিশনে পাঁচজন কমিশনারের প্রয়োজন নেই, সে ক্ষেত্রে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচন কমিশনে এই মুহূর্তে আরো দুজনের বসার জায়গাও নেই। গাড়ি নেই। জনবল নেই। কমিশনারদের কাজও তেমন নেই। যেখানে বিশ্বব্যাপী কৃচ্ছ্র সাধন চলছে, সেখানে দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে সরকারের খরচ না বাড়ানোই শ্রেয়।
শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনো সমাধান দেবে না। বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছেন। কিন্তু সংবিধান এখন কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদন দেয় না। সরকার যদি চায়, তাহলে সমাধান একটা আছে। সরকার উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে। যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, সেই রায়ের দ্বিতীয় অংশে, যেখানে আরো দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন, এই অংশটুকু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এক্ষেত্রে মহাজোটের শরিকদের (যারা এখনো চাচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন) কাউকে দিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করাতে পারে এবং সরকার পরোক্ষভাবে তা সমর্থন করতে পারে। ওই প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে 'নিরপেক্ষ সরকার' বলা যেতে পারে, যাদের কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। ওই 'নিরপেক্ষ সরকার' এর সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে তিন সদস্যের একটি যৌথ কাউন্সিল থাকবে। এককভাবে কারো কোনো ক্ষমতা থাকবে না। নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে এরা সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে এরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তিন সদস্যের ওই কাউন্সিলে কারা কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।
নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। এ ব্যাপারে বিদায়ী সিইসির অতি উৎসাহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেবে। এটা একটা হাস্যকর বিষয়। শহরের মানুষ হয়ত ওই মেশিনের ব্যবহার জানবে। কিন্তু গ্রামে? যেখানে এখনো মানুষ অশিক্ষিত, সেখানে সিইসি এই মেশিন ব্যবহার করাবেন কীভাবে? দেখা গেল ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত কর্মকর্তাদের (যারা নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন) সহযোগিতা চাইছেন ভোটাররা। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ওই কর্মকর্তার কথায় প্রভাবিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বিঘি্নত হবে। ঢাকায় বসে এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের আইডিয়া বিক্রি করার লোকের অভাব নেই। কনসালটেন্সি করার লোকেরও অভাব নেই। তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। বুয়েটের এক বিশেষজ্ঞ এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়েছেন। তার এই 'বিশেষজ্ঞ' জ্ঞানের জন্য ইসি থেকে তিনি কত টাকা নিয়েছেন, তা আমরা জানি না। কিন্তু ইভিএম মেশিনের যে খারাপ দিকও আছে, তা সেমিনার করে আমাদের জানিয়ে দিলেন আরেক 'বিশেষজ্ঞ'। এখন জানান দিল দিলি্লর হাইকোর্ট।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটা নিয়ে কোনো ধরনের পরীক্ষায় যেতে চাই না। ইভিএম মেশিন খোদ আমেরিকায়ও সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না। শুধু যুক্তরাষ্ট্র কেন? জার্মানিতে আইন করে ইভিএম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতেও তা ব্যবহৃত হয় না। ইউরোপের অনেক দেশ, যেখানে শতকরা একশ ভাগ শিক্ষিত এবং প্রযুক্তি বিদ্যায় আমাদের চেয়ে উন্নত, সেখানেও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হয় না। প্রযুক্তির ভালো দিক যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে খারাপ দিকও। আমাদের সমাজে আমরা শতকরা একশ ভাগ এখনো প্রযুক্তিনির্ভর হতে পারিনি। কম্পিউটার ব্যবহারের দিক থেকেও পিছিয়ে আছি। আজ যুক্তরাষ্ট্রের মতো শতকরা একশ ভাগ প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে ভোট মেশিন যখন সর্বত্র গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেখানে বাংলাদেশে সিইসির অতি উৎসাহ প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। তথ্যগতভাবে ভোট মেশিন ভালো। কিন্তু আমাদের শিক্ষা, আমাদের পরিবেশ, আমাদের সমাজ সেই পর্যায়ে এখনো উন্নীত হয়নি যে, আমরা এখনই ভোটার মেশিন ব্যবহার করব। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী হলে, সহনশীলতা আরো বাড়লে এবং পরস্পরের অতি আস্থার একটা ভিত্তি যদি দাঁড় করাতে পারি, তাহলেই আমরা ভোটার মেশিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এর আগে নয় এবং এটা চালু করা উচিতও হবে না।
বিদায়ী সিইসিসহ দুজন নির্বাচন কমিশনারই সাবেক আমলা, দুজন বেসামরিক একজন সামরিক। জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনো নেই। জনগণের পাল্স্ তারা বুঝতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী কিংবা ইভিএম মেশিন ব্যবহারের আগে যা দরকার, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিরোধী দলকে আঘাত করে নয়, বরং আস্থায় নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে, জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ১৯৯৬ সালে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে বিএনপি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় (বিএনপি ২৭৮টি আসন, অন্যরা ১২টি) বিএনপিকে নয়া নির্বাচন দিতে হয়। সাধারণ ভোটারদের মাঝে ওই নির্বাচন কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। এখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে, তা দেশকে শুধু একটি সংকটের মাঝেই ঠেলে দেবে না, বরং বহির্বিশ্বে আওয়ামী লীগ একটি ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে। তাই যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে একটা 'সংলাপ' শুরু করা ও তার জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। নির্বাচনের এখনো অনেক বাকি। কিন্তু চারদলীয় জোটের দেশব্যাপী গণমিছিল, চট্টগ্রামে জনসমাবেশ ও কর্মসূচি আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে যে, চারদলীয় জোট সরকার পতনের আন্দোলনে যাচ্ছে। আমরা আতঙ্কিত এ কারণে যে, দেশের অর্থনীতি আদৌ ভালো নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব খুব শিগগির আমরা অনুভব করব। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। যার ফলে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি, যার পরিমাণ এখন প্রায় ১২ ভাগ। এর প্রতিক্রিয়া কী হবে এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তথা আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মূল্য ক্রয়সীমার বাইরে। এক্ষেত্রে রাজনীতিতে অস্থিরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে বাধ্য। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সংলাপ হোক। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করুক। পাল্টা কর্মসূচি দিলেই সংকটের গভীরতা বাড়বে, যা কারো জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।
এই যখন পরিস্থিতি তখন ইভিএম নিয়ে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছান প্রয়োজন। বিদায়ী কমিশনারের অতি উৎসাহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগির আমরা একজন নয়া সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পাব। ইভিএমের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিক_ আমরা এটাই চাইব। সংসদেও বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিষয়টি দেখতে হবে অত্যন্ত সহনশীলতার দৃষ্টি দিয়ে। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। ইভিএম নিয়ে নানা মত আছে। বিরোধিতাও আছে। এক্ষেত্রে এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যা বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়

0 comments:

Post a Comment