রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পুলিশের মর্যাদা বাড়ল কতটুকু

গেল ৩০ জানুয়ারি দুটি বড় ধরনের ঘটনার ছবি ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। একটিতে আইজিপিকে তিন তারকা জেনারেলের সমান পদমর্যাদা দেয়া হয়েছে। পদমর্যাদার র‌্যাংক ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই ছবি ছাপা হয়েছে প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে। এ র‌্যাংক ব্যাজ পুলিশ বাহিনীর জন্য সম্মানের ও মর্যাদার। দ্বিতীয়টিতে দেখা যাচ্ছে, দু’জন পুলিশ সদস্য টেনেহিঁচড়ে উলঙ্গ লিমনের মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে। গণমিছিলে অংশ নেয়া লিমন পুলিশের গুলিতে নিহত হন চাঁদপুরে। দুটি ঘটনার ছবি। আর দুটি ঘটনার বিষয়বস্তুই পুলিশকে নিয়ে। নিঃসন্দেহে আইজিপিকে র‌্যাংক ব্যাজ পরানোর ছবিতে প্রতিটি পুলিশ বাহিনীর সদস্য খুশি হয়েছেন। ঠিক তেমনি কি খুশি হয়েছেন যখন পুলিশ সদস্যরা উলঙ্গ লিমনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান, তা দেখে? এ ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা কি বাড়ল? শুধু লিমন কেন, বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের ডাকা গণমিছিলে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন চারজন। লিমন, আবুল হোসেন গাজী, রুবেল ও আবুল কাশেম। পরদিন রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন আরও একজন, শফিকুল ইসলাম, যিনি জামায়াতে ইসলামীর কর্মী। শফিকুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড নিয়েও মিথ্যাচার করেছে পুলিশ। প্রতিটি সংবাদপত্র যেখানে বলছে, শফিকুলের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে, সেখানে রাজশাহী মহানগরীর পুলিশ কমিশনার এম ওবায়দুল্লাহ কী করে বলেন, শফিকুলের মৃত্যু হয়েছে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলির কারণে? শফিকুলের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু একজন রাজনৈতিক কর্মীর এ মৃত্যু তো কারোরই কাম্য নয়।
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করবে। পুলিশের দায়িত্ব সেখানে আইনশৃংখলা বিঘিœত হয়েছে কিনা, তা দেখা। তাই বলে গুলি করে মানুষ হত্যা? পুলিশ কি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে দিন দিন? পুলিশ কি আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছে? সাংবাদিকরা এ প্রশ্নটি করেছিলেন আইজিপিকে। জবাবটা সাংবাদিকদের জানাই ছিল। পুলিশ যখন মৃত লিমনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়, আমি এ দৃশ্যের সঙ্গে বিএসএফ কর্তৃক চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাবিবুর রহমানের পেটানোর দৃশ্যের কোন অমিল খুঁজে পাই না। বিএসএফের ওই ‘ভূমিকা’ ফাঁস করে দিয়েছিল ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো। সারা বিশ্ব এর নিন্দা করেছিল। একপর্যায়ে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষমা চাইতে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। ভারতীয় গণতন্ত্রের এটা একটা উজ্জ্বল দিক। রাজনীতিকরা দায়বদ্ধ। এ ধরনের ঘটনায় অনেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছেনÑ ভারতে এর দৃষ্টান্ত একটি নয়, অনেক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশের গুলিতে পাঁচ পাঁচটি জীবন ঝরে পড়ল, আর আমাদের ‘থ্রিস্টার জেনারেল’ আইজিপি একটু দুঃখ প্রকাশ তো করলেনই না, বরং বললেন, ‘গণমিছিলকারীদের হামলায় কিছুসংখ্যক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন’ (আমার দেশ)। কী যুক্তি দিলেন আমাদের আইজিপি! মৃতদেহের প্রতি যে সম্মান, তাও দেখায়নি পুলিশ। অথচ জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় পুলিশ চলে। আইজিপি নিশ্চয়ই ভালো করে জানেন, সংবিধান একজন নাগরিককে কী কী অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে’। ৩২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণের’ কথা। সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার কথা। এ ক্ষেত্রে একজন লিমন, একজন আবুল হোসেন গাজী যখন গণমিছিলে অংশ নেন, তখন সংবিধান তাকে এ অধিকার দেয়। কিন্তু গুলি করে হত্যা করে লাশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে শুধু একজন মৃত ব্যক্তির প্রতি অসম্মানই প্রদর্শন করা হয় না, বরং এটা পুলিশের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেয়। পুলিশের মর্যাদা তাতে বাড়ে না, বরং কমে।
এ রাষ্ট্র তো পুলিশ বাহিনীকে অনেক কিছু দিয়েছে। আইজিপি ‘থ্রিস্টার জেনারেলের’ সম্মান পেয়েছেন। তার জন্য স্বরাষ্ট্র সচিবকে পরিবর্তন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পাঁচজনকে ‘এ’ গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদা দেয়া হবে। এমনিতেই পুলিশ বাহিনীতে সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি, যে সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য পেশায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তরুণ ‘ভালো ছাত্র হওয়ার’ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন, তিনিও এ সুযোগ-সুবিধা পান না। রেশনের কথা না হয় নাইবা বললাম। আমরা ধরে নেই পুলিশের চাকরির ‘চাপ’ বেশি, কাজ বেশি, ঝুঁকি বেশি। সুতরাং তারা একটু সুযোগ-সুবিধা বেশিই নিক, ক্ষতি কী? কিন্তু সেবা কি আমরা পাচ্ছি ঠিকমতো? পুলিশ কি জনগণের প্রতি আদৌ দায়বদ্ধ? মিটিং-মিছিলে গুলি কেন হবে? সেখানে আদৌ শান্তি-শৃংখলা অবনতির মতো ঘটনা ঘটেনি। রাজশাহীতে তো নয়ই। আইজিপি দুঃখ প্রকাশ না করলেও, তিন দিন পর দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এতে অবশ্য কিছুটা রক্ষা। কিন্তু আইজিপি যখন পুলিশ অফিসারকে দিয়েই লক্ষ্মীপুরের ঘটনার, অর্থাৎ গুলিবর্ষণের ঘটনার তদন্ত করান, তখন ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ওপর আস্থা রাখতে পারি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু আরও খুশি হতাম যদি তিনি একটি বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতেন। যারা অনলাইনে সংবাদপত্র পাঠ করেন, তারা দেখে থাকবেন রাজশাহী মহানগরীর পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য একজন পাঠকও সমর্থন করেননি। ময়নাতদন্ত রিপোর্টও প্রত্যাখ্যান করেছেন পাঠকরা। পুলিশ প্রশাসন এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। পুলিশের প্রতি আমাদের যে আস্থার জায়গা, তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বটে যে জড়িতদের বিচার করা হবে, কিন্তু এই বিচার কি অতীতে হয়েছে? তবুও আমরা আস্থা রাখছি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়। ধরে নিচ্ছি মন্ত্রীবাহাদুররা সত্য কথাই বলেন। আর সে কারণে দোষী ব্যক্তিদের বিচার হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার সত্যতা যাচাই হবে দু’মাস পর। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। আরও একটা কথা, বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তাদের ১০ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কথাটার পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমি বলতে পারব না। তবে কিছু কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা যে হয়েছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এটা ভালো নয়। সুস্থ গণতন্ত্রচর্চার জন্য এ প্রবণতা কোন ভালো ফল বয়ে আনবে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত চট্টগ্রামে বলেছেন একটি ‘সংলাপ’-এর কথা। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণের স্বার্থে ‘সংলাপটা’ জরুরি। যদিও ‘সংলাপ’-এর ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়। রাষ্ট্রপতি অতি সম্প্রতি একটি ‘সংলাপ’ করেছেন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে। বিএনপি তাতে অংশ নিয়েছে। এটি ছিল একটি ভালো দিক। কিন্তু ওই ‘সংলাপ’ কোন ফল বয়ে আনতে পারেনি।
পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নাগরিক মারা যাওয়ার পর পুলিশের প্রতি আমার আস্থার জায়গাটা যেন কেমন ফিকে হয়ে আসছে। পুলিশ বাহিনীর ব্যাপারে রয়েছে আমার একটা দুর্বলতা। আমার অনেক প্রিয় মানুষ, কেউ ছাত্র, কেউ আমার পাঠক আজ পুলিশ বাহিনীতে। ওদের প্রতি আস্থাটা ধরে রাখতে চাই। ‘থ্রিস্টার জেনারেল’-এর মর্যাদা, আইজিপি সাহেব, আপনার সম্মানকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। কিন্তু পুলিশের শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা, দায়বদ্ধতা আর সেবার বিষয়টি আপনি যদি নিশ্চিত করতে পারেন, মানুষ আপনাকে মনে রাখবে। গুলি করে মানুষ মারা গেলে এর বদনামের ভাগিদার আপনিও হবেন। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গুলি করে দমন করা হয় না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ কেন গুলি করবে? প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই সরকার আর বিরোধী দলের মাঝে বিরোধ আছে। নিউইয়র্কে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ আন্দোলন ১৩৮ দিন পার করেছে ৩ ফেব্র“য়ারি। আন্দোলনকারীদের জুকোট্টি পার্ক থেকে উৎখাত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রতি গুলি ছোড়া হয়নি। মিসরের রাজধানী কায়রোতে দীর্ঘ ১৮ দিন অবস্থান করে মিসরবাসী যে ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করেছিলেন, সেখানে কি গুলিবর্ষণ করেছিল পুলিশ? হ্যাঁ, সিরিয়াতে আধা-সামরিক বাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা গেছে সত্য, কিন্তু সিরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলানো যাবে না। সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশে আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছি। গণতন্ত্র সহিষ্ণুতা শেখায়। পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে শেখায়। কিন্তু পুলিশ যদি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তাহলে গণতন্ত্রের ভিতটা দুর্বল হয়ে যায়। বিরোধী দলের গণমিছিল যদি শান্তি-শৃংখলা বিঘিœত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করত, সেই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পুলিশ ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারত। টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, জলকামান, রাবার বুলেট ইত্যাদি পুলিশ তো হরহামেশাই ব্যবহার করে। তাহলে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর আর রাজশাহীতে গুলি হল কেন? এ প্রশ্ন আমি সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে করব না। কিন্তু উলঙ্গ লিমনের চ্যাংদোলা ছবি যখন দেখি, তখন ‘থ্রিস্টার জেনারেল’-এর র‌্যাংক ব্যাজ পরা আইজিপি সাহেবের ছবি আমার কাছে মূল্যহীন মনে হয়। আমি দুঃখিত, আমি খুশি হতে পারলাম না।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment