সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনী ও সাগর সরোয়ারের হত্যাকাণ্ডের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আজ কোথায়? এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘রাজনীতি’ হোক, এটা আমি চাই না। কিন্তু এই ঢাকা শহরে বেঁচে থাকার যে গ্যারান্টি, সে ব্যাপারে তো নিশ্চিত হতে পারছি না। মৃত্যু একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষকে মারা যেতে হয়। মানুষের জšে§র পর ধীরে ধীরে মানুষ বড় হয়, শরীরের বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জšে§র পর পরই মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকে। এ জন্যই ধর্মে বলা হয়েছে ‘প্রতিটি মানুষকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে’। কিন্তু এ কেমন মৃত্যু? মধ্য ত্রিশের সরোয়ারের এ জীবন আরও প্রলম্বিত হতে পারত। কিন্তু হল না। মেঘের জীবন আরও ‘মধুর’ হতে পারত। এখন থমকে গেল সবকিছু।
এই ঢাকা শহরে স্বামী-স্ত্রীকে ‘খুন’ করে পালিয়ে যাবে খুনিরা, তা কি আমাদের কাম্য? এ পরিস্থিতিতে কি রাজধানীতে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলব? না, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এ ধরনের পরিস্থিতিকে আমি স্বাভাবিক বলতে পারছি না। ঢাকা শহরে ৪১টি থানা হয়েছে। গত ১১ ফেব্র“য়ারি সারা জাতি যখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে জানল রুনী-সরোয়ারের হত্যাকাণ্ডের খবর, ঠিক ওই দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ পালন করছে তাদের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ঢাকা শহরে মানুষ বেড়েছে। বেড়েছে থানা। কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নিশ্চিত করা যায়নি। আমাদের আইজি এখন ‘থ্রিস্টার জেনারেল’। পদমর্যাদা বেড়েছে। তিনি এখন সচিবই নন শুধু, সিনিয়র সচিব। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, পুলিশ বাহিনী আরও ৫টি সিনিয়র সচিবের ‘পদ’ পাবে। সে সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের পদমর্যাদাও বাড়ানো হয়েছে। যেখানে গ্রিসের মতো একটি ইউরোপের দেশ ব্যয় সংকোচের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেবাখাতে সরকারি ব্যয় কমানো হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানো হয়েছে, সেখানে আমরা বিশ্বব্যাপী এই অর্থনৈতিক সংকটের সময়, সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি দিলাম। সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করে সরকারি ব্যয় বাড়ানো হল। আমরা গ্রিসের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুই শিখলাম না!
রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ড দিয়ে আমি ঢাকা শহরের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বিচার করব না। কিন্তু এটা কি একটা বড় ধরনের ঘটনা নয়? যখন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দেন, তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলা যাবে না। কিন্তু গত এক মাসের ঘটনা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে বলতে আমি বাধ্য হব যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। একের পর এক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, বাসায় গৃহকর্ত্রী খুন হচ্ছে, ব্যাংক থেকে অথবা ব্যাংকে যাওয়ার পথে লাখ লাখ টাকা ছিনতাই হয়ে যাচ্ছেÑ কিন্তু পুলিশ কোন কূলকিনারা করতে পারছে না।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনি একাধিকবার পুলিশ বাহিনীর প্রশংসা করেছেন। আমি এতে দোষ দেখি না। বিএনপি আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরাও আপনার মতো কথা বলতেন। ওই চেয়ারে বসলে বোধহয় এভাবেই কথা বলতে হয়! কিন্তু আমি তো আস্থাটা রাখতে পারছি না। আমার স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। গত ৯ ফেব্র“য়ারি র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল যখন একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘এগুলো সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, তখন আমি হিসাবটা ঠিক মেলাতে পারি না। একের পর এক স্বর্ণের দোকানে লুট হবে, ব্যাংক থেকে উত্তোলিত টাকা ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পুলিশ এই প্রবণতা রোধ করতে পারছে না, তখন র্যাবের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কীভাবে বলেন, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা? তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলেন। এগুলো অবশ্যই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অস্বাভাবিক এবং আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
মানুষ তার বাড়িকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করে। এখন সেখানেও মানুষ নিরাপদ নয়। সেখানে ঢুকে রুনী ও সাগরকে খুন করা হল। এই ‘ডাবল মার্ডার’-এর পেছনে কী মোটিভ কাজ করেছে, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব গণমাধ্যমের কাছে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সমাজকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।’ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য এটি। যদিও তিনি উল্লেখ করেননি এই অস্থিতিশীল শক্তি কারা? একদিকে বিএনপি যখন তাদের ১২ মার্চের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে দেশবাসী, সে সময় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব যখন ‘অস্থিতিশীলতার’ প্রশ্ন তোলেন, তখন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তার এই বক্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই বক্তব্যকে হালকাভাবে নিতে চাই না। নিশ্চয়ই তিনি বুঝে-শুনে ‘সমাজে অস্থিতিশীলকারীদের’ সঙ্গে রুনি-সাগরদের হত্যার একটা মিল খুঁজে পেয়েছেন। আমি খুশি হব যদি তিনি তদন্তকারীদের কাছে এই ‘অস্থিতিশীলকারী’দের নাম-ধাম প্রকাশ করেন।
রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক একটি হত্যাকাণ্ড বলে আমার মনে হয় না। প্রথমত, কিলাররা ভাড়া করা কিলার নয়। এরা অপেশাদার। যদি রুনী বা সাগরের কোন প্রতিবেদনের কারণে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করার কথা। এক্ষেত্রে তা হয়নি। খুনিরা অপেশাদার। ফরেনসিক রিপোর্টেই তা প্রমাণিত। দ্বিতীয়ত, খুনিরা গ্রিল কেটে ঢোকেনি। তারা বাইরে থেকে মূল দরজা দিয়েই ঢুকেছে এবং রুনীর পূর্ব পরিচিত। পূর্ব পরিচিত ছাড়া তিনি তাদের ঘরে ঢুকতে দিতেন না। খুনিরা প্রথমে খুন করে রুনীকে, পরে অপেক্ষা করে সাগরের জন্য। সাগর এলে তাকেও খুন করে। তৃতীয়ত, খুনের কারণ কী? কোন পেশাগত দ্বন্দ্বÑ সম্ভবত না। কোন ব্যবসায়িক স্বার্থÑ সেটাও সম্ভবত না। পারিবারিক কোন দ্বন্দ্ব, টাকা-পয়সা লেনদেন সংক্রান্ত কোন দ্বন্দ্বÑ এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। একমাত্র ওই অ্যাপার্টমেন্টের প্রহরিরাই সঠিক তথ্য দিতে পারবেন ওই বাড়িতে রাতে কারা কারা এসেছিল। চতুর্থত, এটা কোন ডাকাতি নয়। ডাকাতি হলে ঘরের কিছু জিনিস খোয়া যেত। আর ডাকাতরা সাধারণত ‘খুন’ করে না। পুলিশ এখন অনেকগুলো ‘থিউরি’ নিয়ে এগুতে পারে। তবে এই ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিলেও কয়েকজনকে আটক করা ছাড়া পুলিশ কোন সুখবর দিতে পারেনি।
রাষ্ট্র তো পুলিশ বাহিনীর জন্য অনেক কিছু করেছে। এখন পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পাঁচজন ‘এ’ গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হবেন। একই সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) প্রথম শ্রেণী ও উপপরিদর্শকদের (এসআই) দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে উন্নীত করা হচ্ছে। গত ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০১২ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে পুলিশ বাহিনীকে সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ বাহিনী চলে, সেই জনগণের কাছে পুলিশের আস্থা এতে কতটুকু বাড়বে? নানা কারণে পুলিশ আজ বিতর্কিত। সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনার মধ্যে দিয়ে পুলিশের ‘সাফল্য’ কতটুকু নিহীত ছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এতে করে পুলিশের ভাবমূর্তি দেশে ও বিদেশে উজ্জ্বল হয়নি, এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই ‘তদবির’ করে আসছিলেন, তাদের জন্য ১০টি ‘সচিব পদ’ সৃষ্টি করা হোক। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার কাছে এর যুক্তি তুলে ধরেছেন। এর প্রয়োজনীয়তা আছে কী নেই, এই বিতর্কে আমি যাব না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ‘পাঁচ সচিব পদ’ সৃষ্টির ঘোষণার একদিন আগে দৈনিক যুগান্তরে যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল (সারা দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বেসামাল), তাতে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মহাজোট সরকারের ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুগান্তর যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল তাতে দেখা যায়, সারা দেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৯ হাজার ১০৪টি, অপহরণ হয়েছে ১ হাজার ২৮০টি, ক্রশফায়ার হয়েছে ৪০৪টি, গুপ্তহত্যা হয়েছে ৭১টি, রাজনৈতিক খুন ৫০০, চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামিকে দণ্ডাদেশ মওকুফ, শাসক দলের ৭ হাজার ১০০ নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান কি আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বাহিনীর জন্য কোন আশার সংবাদ? শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা কি এ সংবাদে খুশি? আমরা সাধারণ আমজনতা, আমরা এ ঘটনায় খুশি নই। পুলিশ বাহিনী এখন ‘পাঁচজন সচিব’ পাবে। তাতে করে আমাদের আমজনতার লাভ কী হল? সচিব পর্যায়ের পদ সৃষ্টি করে সম্মান বাড়ানো যায় না। তবে আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (যার আইজি হওয়ার কথা ছিল) ফণীভূষণ চৌধুরীর বক্তব্যে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছি। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের অনেক ব্যর্থতা আছে। থানায় প্রকৃত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মামলা কিংবা জিডি নিতে চায় না। পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি বাড়ছে। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহারও হচ্ছে।’ ফণীবাবুর এই বক্তব্য (পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে) পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। জানি না আইজিপি হলে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারতেন কীনা? তবুও তাকে সাধুবাদ জানাই সত্য কথা বলার জন্য।
রুনি ও সাগরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন। আমার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আমি শংকায় থাকি। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আমি চাই। একজন সাংবাদিক, যিনি এ দেশের সুশীল সমাজের একটা অংশ, তার নিরাপত্তাই যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে। রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে অভিযুক্ত করলে দোষীরা পার পেয়ে যাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বটা আজ বেশি। তার মন্ত্রণালয় ঠিকমতো চলছে, এটা বলা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই পুলিশের প্রশংসা করুক, আস্থার জায়গাটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। এটা ভালো নয়। কাম্যও নয়। আমরা অবিলম্বে রুনি ও সাগরের হত্যাকারীদের গ্রেফতার দেখতে চাই। দেখতে চাই পুলিশ সত্যিই ‘পারে’।
এই ঢাকা শহরে স্বামী-স্ত্রীকে ‘খুন’ করে পালিয়ে যাবে খুনিরা, তা কি আমাদের কাম্য? এ পরিস্থিতিতে কি রাজধানীতে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলব? না, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এ ধরনের পরিস্থিতিকে আমি স্বাভাবিক বলতে পারছি না। ঢাকা শহরে ৪১টি থানা হয়েছে। গত ১১ ফেব্র“য়ারি সারা জাতি যখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে জানল রুনী-সরোয়ারের হত্যাকাণ্ডের খবর, ঠিক ওই দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ পালন করছে তাদের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ঢাকা শহরে মানুষ বেড়েছে। বেড়েছে থানা। কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নিশ্চিত করা যায়নি। আমাদের আইজি এখন ‘থ্রিস্টার জেনারেল’। পদমর্যাদা বেড়েছে। তিনি এখন সচিবই নন শুধু, সিনিয়র সচিব। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, পুলিশ বাহিনী আরও ৫টি সিনিয়র সচিবের ‘পদ’ পাবে। সে সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের পদমর্যাদাও বাড়ানো হয়েছে। যেখানে গ্রিসের মতো একটি ইউরোপের দেশ ব্যয় সংকোচের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেবাখাতে সরকারি ব্যয় কমানো হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানো হয়েছে, সেখানে আমরা বিশ্বব্যাপী এই অর্থনৈতিক সংকটের সময়, সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি দিলাম। সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করে সরকারি ব্যয় বাড়ানো হল। আমরা গ্রিসের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুই শিখলাম না!
রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ড দিয়ে আমি ঢাকা শহরের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বিচার করব না। কিন্তু এটা কি একটা বড় ধরনের ঘটনা নয়? যখন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দেন, তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলা যাবে না। কিন্তু গত এক মাসের ঘটনা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে বলতে আমি বাধ্য হব যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। একের পর এক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, বাসায় গৃহকর্ত্রী খুন হচ্ছে, ব্যাংক থেকে অথবা ব্যাংকে যাওয়ার পথে লাখ লাখ টাকা ছিনতাই হয়ে যাচ্ছেÑ কিন্তু পুলিশ কোন কূলকিনারা করতে পারছে না।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনি একাধিকবার পুলিশ বাহিনীর প্রশংসা করেছেন। আমি এতে দোষ দেখি না। বিএনপি আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরাও আপনার মতো কথা বলতেন। ওই চেয়ারে বসলে বোধহয় এভাবেই কথা বলতে হয়! কিন্তু আমি তো আস্থাটা রাখতে পারছি না। আমার স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। গত ৯ ফেব্র“য়ারি র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল যখন একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘এগুলো সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, তখন আমি হিসাবটা ঠিক মেলাতে পারি না। একের পর এক স্বর্ণের দোকানে লুট হবে, ব্যাংক থেকে উত্তোলিত টাকা ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পুলিশ এই প্রবণতা রোধ করতে পারছে না, তখন র্যাবের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কীভাবে বলেন, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা? তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলেন। এগুলো অবশ্যই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অস্বাভাবিক এবং আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
মানুষ তার বাড়িকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করে। এখন সেখানেও মানুষ নিরাপদ নয়। সেখানে ঢুকে রুনী ও সাগরকে খুন করা হল। এই ‘ডাবল মার্ডার’-এর পেছনে কী মোটিভ কাজ করেছে, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব গণমাধ্যমের কাছে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সমাজকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।’ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য এটি। যদিও তিনি উল্লেখ করেননি এই অস্থিতিশীল শক্তি কারা? একদিকে বিএনপি যখন তাদের ১২ মার্চের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে দেশবাসী, সে সময় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব যখন ‘অস্থিতিশীলতার’ প্রশ্ন তোলেন, তখন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তার এই বক্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই বক্তব্যকে হালকাভাবে নিতে চাই না। নিশ্চয়ই তিনি বুঝে-শুনে ‘সমাজে অস্থিতিশীলকারীদের’ সঙ্গে রুনি-সাগরদের হত্যার একটা মিল খুঁজে পেয়েছেন। আমি খুশি হব যদি তিনি তদন্তকারীদের কাছে এই ‘অস্থিতিশীলকারী’দের নাম-ধাম প্রকাশ করেন।
রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক একটি হত্যাকাণ্ড বলে আমার মনে হয় না। প্রথমত, কিলাররা ভাড়া করা কিলার নয়। এরা অপেশাদার। যদি রুনী বা সাগরের কোন প্রতিবেদনের কারণে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করার কথা। এক্ষেত্রে তা হয়নি। খুনিরা অপেশাদার। ফরেনসিক রিপোর্টেই তা প্রমাণিত। দ্বিতীয়ত, খুনিরা গ্রিল কেটে ঢোকেনি। তারা বাইরে থেকে মূল দরজা দিয়েই ঢুকেছে এবং রুনীর পূর্ব পরিচিত। পূর্ব পরিচিত ছাড়া তিনি তাদের ঘরে ঢুকতে দিতেন না। খুনিরা প্রথমে খুন করে রুনীকে, পরে অপেক্ষা করে সাগরের জন্য। সাগর এলে তাকেও খুন করে। তৃতীয়ত, খুনের কারণ কী? কোন পেশাগত দ্বন্দ্বÑ সম্ভবত না। কোন ব্যবসায়িক স্বার্থÑ সেটাও সম্ভবত না। পারিবারিক কোন দ্বন্দ্ব, টাকা-পয়সা লেনদেন সংক্রান্ত কোন দ্বন্দ্বÑ এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। একমাত্র ওই অ্যাপার্টমেন্টের প্রহরিরাই সঠিক তথ্য দিতে পারবেন ওই বাড়িতে রাতে কারা কারা এসেছিল। চতুর্থত, এটা কোন ডাকাতি নয়। ডাকাতি হলে ঘরের কিছু জিনিস খোয়া যেত। আর ডাকাতরা সাধারণত ‘খুন’ করে না। পুলিশ এখন অনেকগুলো ‘থিউরি’ নিয়ে এগুতে পারে। তবে এই ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিলেও কয়েকজনকে আটক করা ছাড়া পুলিশ কোন সুখবর দিতে পারেনি।
রাষ্ট্র তো পুলিশ বাহিনীর জন্য অনেক কিছু করেছে। এখন পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পাঁচজন ‘এ’ গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হবেন। একই সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) প্রথম শ্রেণী ও উপপরিদর্শকদের (এসআই) দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে উন্নীত করা হচ্ছে। গত ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০১২ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে পুলিশ বাহিনীকে সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ বাহিনী চলে, সেই জনগণের কাছে পুলিশের আস্থা এতে কতটুকু বাড়বে? নানা কারণে পুলিশ আজ বিতর্কিত। সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনার মধ্যে দিয়ে পুলিশের ‘সাফল্য’ কতটুকু নিহীত ছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এতে করে পুলিশের ভাবমূর্তি দেশে ও বিদেশে উজ্জ্বল হয়নি, এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই ‘তদবির’ করে আসছিলেন, তাদের জন্য ১০টি ‘সচিব পদ’ সৃষ্টি করা হোক। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার কাছে এর যুক্তি তুলে ধরেছেন। এর প্রয়োজনীয়তা আছে কী নেই, এই বিতর্কে আমি যাব না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ‘পাঁচ সচিব পদ’ সৃষ্টির ঘোষণার একদিন আগে দৈনিক যুগান্তরে যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল (সারা দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বেসামাল), তাতে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মহাজোট সরকারের ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুগান্তর যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল তাতে দেখা যায়, সারা দেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৯ হাজার ১০৪টি, অপহরণ হয়েছে ১ হাজার ২৮০টি, ক্রশফায়ার হয়েছে ৪০৪টি, গুপ্তহত্যা হয়েছে ৭১টি, রাজনৈতিক খুন ৫০০, চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামিকে দণ্ডাদেশ মওকুফ, শাসক দলের ৭ হাজার ১০০ নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান কি আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বাহিনীর জন্য কোন আশার সংবাদ? শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা কি এ সংবাদে খুশি? আমরা সাধারণ আমজনতা, আমরা এ ঘটনায় খুশি নই। পুলিশ বাহিনী এখন ‘পাঁচজন সচিব’ পাবে। তাতে করে আমাদের আমজনতার লাভ কী হল? সচিব পর্যায়ের পদ সৃষ্টি করে সম্মান বাড়ানো যায় না। তবে আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (যার আইজি হওয়ার কথা ছিল) ফণীভূষণ চৌধুরীর বক্তব্যে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছি। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের অনেক ব্যর্থতা আছে। থানায় প্রকৃত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মামলা কিংবা জিডি নিতে চায় না। পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি বাড়ছে। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহারও হচ্ছে।’ ফণীবাবুর এই বক্তব্য (পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে) পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। জানি না আইজিপি হলে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারতেন কীনা? তবুও তাকে সাধুবাদ জানাই সত্য কথা বলার জন্য।
রুনি ও সাগরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন। আমার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আমি শংকায় থাকি। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আমি চাই। একজন সাংবাদিক, যিনি এ দেশের সুশীল সমাজের একটা অংশ, তার নিরাপত্তাই যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে। রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে অভিযুক্ত করলে দোষীরা পার পেয়ে যাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বটা আজ বেশি। তার মন্ত্রণালয় ঠিকমতো চলছে, এটা বলা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই পুলিশের প্রশংসা করুক, আস্থার জায়গাটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। এটা ভালো নয়। কাম্যও নয়। আমরা অবিলম্বে রুনি ও সাগরের হত্যাকারীদের গ্রেফতার দেখতে চাই। দেখতে চাই পুলিশ সত্যিই ‘পারে’।
দৈনিক যুগান্তর, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২.
ড. তারেক শামসুর রেহমান
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment