১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙন ও সমাজতন্ত্রের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল, পুঁজিবাদী সমাজের মঙ্গল আনতে পারে (?) যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কনজারভেটিভ তাত্তি্বক (ফুকিয়ামা) এই ধারণার স্বপক্ষে তাদের লেখনি অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল, পুঁজিবাদও সমাজ বিকাশে কোন অবদান রাখতে পারছে না। পুঁজিবাদী সমাজেই একটি বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সে কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৯৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভাগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ বহন করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর জোসেফ স্ট্রিগলিৎনের মতে, শীর্ষে থাকা এই ৯ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে পধংড়সঢ় পধঢ়রঃধষরংস। অথচ পরিসংখ্যান বলে, সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। পার্কে জমায়েত হওয়া অনেক তরুণ জানিয়েছেন তারা গ্রাজুয়েশন করার পর চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ ২০১০ সালে কর্পোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ১৩ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এই যে বৈষম্য, একই ধরনের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই। এক ধরনের ্তুপষধহ ধিংঃধমব্থ বা শ্রেণী যুদ্ধের সূচনা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে। 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'গুলো তার বড় প্রমাণ। এই শ্রেণীযুদ্ধের কথা বলেছিলেন মার্কস। মার্কসের বিশ্লেষণ এই শ্রেণীদ্বন্দ্ব কোনো সমাজে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বিখ্যাত ঞযব পড়সসঁহরংঃ সধহরভবংঃড় গ্রন্থে এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন ্তু...ধ ভরমযঃ ঃযধঃ বধপয ঃরসব বহপষড়ফ, বরঃযবৎ রং ধ ৎবাড়ষঁঃরড়হধৎু ৎবপড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ ংড়পরবঃু ধঃ ষধৎমব, ড়ৎ রহ ধ পড়সসড়হ ৎঁরহ ড়ভ ঃযব পড়হঃবহফরহম পষধংংবং। অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে অথবা উভয় শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটবে। মার্কস চূড়ান্ত বিচারে শোষিত শ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব সনাতন। আজ এত বছর পরও শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটছে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্কস আজো বেঁচে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের এই শ্রেণীদ্বন্দ্বকে কীভাবে নিষ্পেষণ করতেন, বলতে পারবো না। তবে নোয়াম চমস্কির লেখনিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার চমৎকার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে আখ্যায়িত করেছেন চষঁঃড়পৎধপু হিসেবে, অর্থাৎ সম্পদশালী ধনী শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। নোয়াম চমস্কি লিখছেন, Increasingly, wealth concentrated in the financial sector। Politicians faced with the rising cast of campaigns, were driven एवर deeper into the pockets of wealthy backers. এটাই হচ্ছে আসল কথা। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু ধনিক শ্রেণীর হাতে। রাজনীতি, অর্থনীতি এরাই পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে বলা হয় ্তুইরষষরড়হধরৎব ভৎরবহফষু্থ। ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস। ধনীদের টাকায় কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হন। এরপর কংগ্রেস সদস্যরা ধনীদের আরো সুযোগ-সুবিধা দেন। নোয়াম চমস্কি তাই আমেরিকার এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্টে' এতটুকুও অবাক হননি! তিনি লিখেছেন, The most exciting aspect of the occupy movement is the construction of the linkage that are taking place all over. If they can be sustained and expanded, occupy can lead to dedicated efforts to set society on a moral human course ।মার্কস যেখানে বিপ্লবের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলছেন Moral human course| এর কথা। বিশ্বজুড়ে যে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটা সমন্বয় থাকা দরকার_ এটাও চমস্কির অভিমত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী সমাজে একটি পরিবর্তন আসন্ন। কেননা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজে অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ইউরোপীয় ঐক্যে একটি বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস ও ইতালির পরিস্থিতির রেশ ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এই বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণীবৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে একটি ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও, দেশটিতে দরিদ্রতার হার ৬ ভাগ, আর বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ ভাগ। সুইজারল্যান্ড ইইউর সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৮, আর ৭ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এই হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ ভাগ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে বেকারত্ব ও দরিদ্রতার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও ১৮ ভাগ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর খবর আমরা জানি। কেননা এসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে ওইসব দেশেও 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর জন্ম হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। মানবিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছেন। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'কে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিত শ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবকে সংঘটিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তৎকালীন সময়ে জার্মান ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জেডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকের এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অক্ষমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী একটি পরিবর্তন আনছেন। এই পরিবর্তনকে 'বিপ্লব' বলা যাবে কি না, জানি না; কিন্তু একুশ শতকে বিশ্ব যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এই পরিবর্তন সমাজকে কতটুকু বদলে দেবে বলা মুশকিল। রাশিয়ায় বিপ্লবের পর সমাজ বদলে গিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৭০ বছর দেখা গেল সেখানে একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা সমাজতন্ত্রের নামে ক্ষমতা ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানেও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। আশির দশকের শেষের দিকে আমি পূর্ব ইউরোপে এই বৈষম্য দেখেছি। রাশিয়ায়ও এই বৈষম্য আমার চোখে পড়েছিল। মাওজে ডং একবার বলেছিলেন, পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দাও। তেং সিয়াও পিং পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দেননি। কিন্তু অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। পবিরর্তন সেখানে এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কী পরিবর্তন আসছে? যেভাবে আমেরিকার সমাজ বিকশিত হচ্ছে, সেভাবে আর বিকশিত হবে না। পরিবর্তন সেখানে আসবেই। একসময় মার্কসবাদীরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। এখন তারা সশস্ত্র পথ পরিত্যাগ করে (নেপালি মাওবাদীরা) সমাজে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। এটা একটা নতুন দিক। বিপ্লবের ধরন বদলে গেছে। একুশ শতকে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে এক নতুন ধরনের বিপ্লব। আর যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণঅভ্যুত্থান এই বিপ্লবের নতুন একটি মাত্রা দেবে।
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment