রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বেগম জিয়ার ভারত সফর প্রসঙ্গে কিছু কথা

বেগম জিয়া ভারত সফরে যাচ্ছেন। বিবিসির বাংলা বিভাগের সাথে আলাপচারিতায় এটা নিশ্চিত করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি বেগম জিয়াকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওই আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতেই বেগম জিয়া এখন নয়াদিল্লি যাচ্ছেন। বেগম জিয়ার এই নয়াদিল্লি সফর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত বেগম জিয়া ‘ছায়া প্রধানমন্ত্রী’। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে ‘ছায়া প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বেগম জিয়া সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছেন। দ্বিতীয়ত বেগম জিয়ার এই সফর প্রমাণ করে ভারত শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সভাপতিকে ‘গণ্য’ করে না, বরং বিরোধী দলের নেতাকেও ‘গণ্য’ করে। তৃতীয়ত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ‘হাই প্রোফাইল’ ভারত সফর ও তার ঢাকায় দেয়া বিভিন্ন বক্তব্যের পর তিনি এমন একটা ধারণার জন্ম দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের পরবর্তী নেতা হিসেবে বিশ্ব সম্প্রদায় বিশেষ করে ভারত তাঁকে  গণ্য করছে। এখন বেগম জিয়ার এই সফরের পর মানুষের মন থেকে সেই ধারণা চলে যেতে পারে। চতুর্থত ভারতের নীতিনির্ধারকদের মাঝে সম্ভবত একটি ‘শুভবুদ্ধির’ উদয় ঘটেছে। তারা এখন আর শুধুমাত্র আওয়ামী লীগকে নিয়েই চিন্তা করে না বরং প্রধান বিরোধী দলের সাথেও তারা এক ধরনের ‘ডায়লগ’ চায়।
বেগম জিয়ার ভারতে যাওয়া উচিত কি উচিত নয়, এটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। অনেকের সাথে এমনকি যারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ঘরানার, তারাও আমাকে বলেছেন, বেগম জিয়ার নয়াদিল্লি যাওয়া ঠিক নয়। কেননা এতে করে সাধারণ মানুষের মাঝে একটা ‘ভুল সিগন্যাল’ পৌঁছে যেতে পারে। এর পেছনে হয়তো যুক্তি ও আবেগ আছে এটা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। কেননা স্বাধীনতা পরবর্তী ৪০ বছরে ভারত বন্ধুত্বের চাইতে ‘শত্রুতার’ই পরিচয় দিয়েছে বেশি। তারপরও বাস্তবতা যা, তা হচ্ছে সমসাময়িক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত একটা ‘ফ্যাক্টর’। ভারতের অবস্থান, তার অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কে এর একটা প্রভাব পড়বেই। আমাদের বৈদেশিক নীতির সাফল্য সেখানেই যে, আমরা ‘ভারতের এই অবস্থান’ থেকে কতটুকু ফায়দা তুলতে পারব। দুর্ভাগ্য, বর্তমান সরকারের সময় আমরা খুব একটা ফায়দা তুলতে পারিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতা ঢাকতে আমাদের দু’জন উপদেষ্টাকে পর্যন্ত নিয়োগ করতে হয়েছে, যারা সত্যিকার অর্থে বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাহায্য করছেন। এমনি এক পরিস্থিতিতে বেগম জিয়ার ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেগম জিয়ার জন্য একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থকে যথাযথভাবে ভারতের কাছে তুলে ধরার। বলার অপেক্ষা রাখে না মহাজোট সরকারের সময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বার্থ আদৌ রক্ষিত হচ্ছে না। বেগম জিয়া এখন এই কাজটি করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষের যে প্রত্যাশা তা তুলে ধরতে পারেন ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের কাছে। প্রথমত বাংলাদেশ বড় ধরনের ভারতীয় পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন। গঙ্গার পানি বণ্টনে একটি চুক্তি হয়েছে বটে কিন্তু পানি আমরা পাচ্ছি না। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি আসার আগেই উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। তিস্তার পানি বণ্টনে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে। পশ্চিমবাংলার আপত্তিতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না।
সমস্যাটা ভারতের, সমাধান তাদেরকেই করতে হবে। বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়ে দেয়া যে, আন্তর্জাতিক নদী আইন আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করছে। আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারি না। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। খোদ ভারতের অভ্যন্তরে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে এই দু’টো প্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা পানিশূন্য হয়ে যাবে। মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের মানুষ এটা সহ্য করে নেবে না। এ বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়ে দেয়া। দেশ হিসেবে আমরা ‘ছোট’ হতে পারি। কিন্তু আমরা সমমর্যাদার অধিকারী। ভারতের আচরণে সেই সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ ‘ভারতীয় বাণিজ্যনীতির ফাঁদে’ আটকা পড়ে আছে তাদের দিক থেকে। অর্থাৎ ভারতীয় বাণিজ্যনীতি এমন যে একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা ভারত ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও, বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলাদেশের রফতানি আয় কমে গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রফতানি করেছে মাত্র ৪৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের পণ্য (আগের বছরের ৫১ কোটি ২৫ লাখ ডলার)। এতে দেখা যায় রফতানি আয় কমেছে (কালের কণ্ঠ, ১৮ জুলই, ২০১২)। গেল বছর ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তখন ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল ভারত শুল্ক বাধা দূর করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বেগম জিয়া এখন এই বিষয়টি ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে স্পষ্ট করবেনÑ অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। এতে করে বাংলাদেশ তার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে। তৃতীয়ত বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। একতরফাভাবে ভারতীয় বিএসএফ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। এই হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। পৃথিবীর কোনো সীমান্তে এভাবে মানুষ মারা হয় না। এই সীমান্তহত্যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। সীমান্তহত্যা বন্ধের ব্যাপারে ভারতকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে বেগম জিয়া এই ‘ম্যাসেজ’টি পৌঁছে দেবেন ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে। চতুর্থ বেগম জিয়া ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর, সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণের বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেবেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী অনেক আগেই ছিটমহল সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভারত তা করেনি।
বেগম জিয়া দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশের জনগণের কথা তুলে ধরবেন। পঞ্চমত বাংলাদেশের দুর্বল ও ভারতঘেষা পররাষ্ট্রনীতির সুযোগে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে সুকৌশলে ট্রানজিটের নামে করিডোর সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, ‘বহু পাক্ষিকতার আলোকে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে’। বলা হয়েছিল বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানও অনুরূপ সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের জন্য চীন-নেপাল-ভুটানের যে সংযোগ ভারতের উপর দিয়ে যাবে, তা ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে কম। এই সুযোগটি বাংলাদেশ পায়নি। এমনকি ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের মাত্র ২৫ কিলোমিটার স্থল সংযোগ নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ভারত আমাদের সেই সুযোগ দেয়নি। অথচ আমরা এককভাবে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতের ২৮ চাকার ভারী গাড়ি পারাপারের সুযোগ করে দিয়েছি। এজন্য ভারত আমাদের কোনো ট্রানজিট ‘ফি’ও দেয়নি। সাধারণ মানুষের মনোভাব আজ বেগম জিয়াকে তুলে ধরতে হবে। শুধু তাই নয়। ভারত তার নিজ স্বার্থে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের পথ রেখাটি নিজের সুবিধামত রুটে আদায় করে নিয়েছে। ভারতের এই এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের পথরেখাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢুকে ঢাকা ও সিলেট হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করবে। এই পথটি ভারতের জন্য অনুকূল হলেও বাংলাদেশের জন্য দুর্গম,  বেশি দূরত্বের এবং অনিরাপদ হওয়ার ফলে পথটি বাংলাদেশের জন্য মোটেই লাভজনক নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-টেকনাফ-সিত্তোই-আকিয়াব-ইয়াঙ্গুনগামী পথটি বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যে গন্তব্যসমূহে স্থল যোগাযোগের জন্য (সড়ক ও রেলপথ) কম দূরত্ব ও কম দুর্গম ও নিরাপদ হওয়ার ফলে বাংলাদেশের জন্য তা ছিল সুবিধাজনক। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের ভারত তোষণ নীতির কারণে এশিয়ান হাইওয়ের যে পথ আমরা বেছে নিয়েছি, তাতে আমাদের প্রাপ্তি কম। এমনকি ভারতকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের ব্যাপারেও আমরা চুক্তিবদ্ধ। এসব চুক্তি আমরা এখন বাতিল করতে পারব না। কিন্তু বেগম জিয়া ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এটা বোঝাতে পারেন যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারত যদি এককভাবে সুবিধা নেয়, তাতে করে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে। আমদানি-রফতানিতে চট্টগ্রাম বন্দর এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। নতুন করে ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার সুযোগ কম। বিষযটি নিয়ে বেগম জিয়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করতে পারেন।
বাংলাদশের জনগণ ভারতের বন্ধুত্ব চায়। বাংলাদেশের উন্নয়নে ও সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে ভারত যদি সমর্থন করে, তাতে বাংলাদেশে ভারতের ইমেজ নষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষ চায় না ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করুক। তবে বেগম জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। আগামী দিনগুলোতে ভারত একটি ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান গ্রহণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বিএনপির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল বিএনপি ভারতবিরোধী। বেগম জিয়ার ভারত সফর এই বদনাম কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ ‘ছোট’ দেশ হতে পারে। কিন্তু আমাদের অনেক কিছু দেয়ার আছে। ভারত সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলুক, বেগম জিয়ার এই সফরের মধ্যে এটি যদি নিশ্চিত হয়, সেটাই হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া।

0 comments:

Post a Comment