৩০ আগস্ট (রেডিও তেহরান) : জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যাম-এর শীর্ষ
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইরানের রাজধানী তেহরানে। এ সম্মেলনের বিভিন্ন দিক
নিয়ে আমরা কথা বলেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের সঙ্গে। তার সাক্ষাতকারটি
পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
রেডিও তেহরান: জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যাম-এর ষোড়শ শীর্ষ সম্মেলন
হচ্ছে ইরানের রাজধানী তেহরানে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব রাজনীতির এক বিশেষ
পরিস্থিতিতে এবারের এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আপনার দৃষ্টিতে এবারের এ
সম্মেলনের গুরুত্ব কতটুকু?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : ধন্যবাদ আপনাকে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন
ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, যে দৃষ্টিকোণ থেকে এক সময় জোট নিরপেক্ষ
আন্দোলন বা ন্যামের জন্ম হয়েছিল বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই
বিষয়গুলো অত্যন্ত প্রকট হয়ে আমাদের কাছে ধরা পড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাব সারা বিশ্বে যে ব্যাপৃত
হয়েছে তা আমাদের চোখে ধরা পড়ছে এবং সে ক্ষেত্রে আজ উন্নয়নশীল দেশগুলোর
শীর্ষ নেতারা তেহরানে ন্যাম সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করছেন। সঙ্গত কারণে আমার
কাছে যে প্রশ্নটা অত্যন্ত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সেটি হচ্ছে মার্কিন
আগ্রাসনের বিরুদ্ধে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো বিশেষ করে আমাদের মতো
ছোটো ছোটো দেশগুলো, আরব দেশগুলো এবং বিশেষ করে ইরান- যে দেশটি এই
মুহূর্তে সরাসরি চরম আগ্রাসনের সম্মুখীন তারা এ ধরনের একটি সম্মেলনের
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
আমি মনে করি আজকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো নিজেরা একত্রিত হয়ে সব
ধরনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ কর্মসূচি গ্রহণ করবে। ন্যাম যে
পরিস্থিতির ভিত্তিতে শুরু হয়েছিল আজকের বর্তমান পরিস্থিতিকে আমরা অনেকটা
সেই আঙ্গিকে বিচার করতে পারি।
রেডিও তেহরান : দীর্ঘদিন ধরে ন্যামকে অনেকটা অকার্যকর সংগঠন বলে মনে করা
হতো। কিন্তু, এবার ইরান এ সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে এবং এ
কারণে অনেকেই মনে করছেন ন্যাম নতুন করে গতি পাবে। আপনার কি তাই মনে হয়?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে সেটা হতে পারে। কারণ আমি মনে
করি ইরান একটি ইমার্জিং মুসলিম কান্ট্রি। মুসলিম বিশ্বে ইরানের যথেষ্ট
অবদান আছে এবং সে ক্ষেত্রে ইরান যখন ন্যামের দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন আমি
মনে করি ইরানের কাছ থেকে নতুন এবং গতিশীল একটা নেতৃত্ব আমরা পাব। বিশেষ
করে আজ মুসলিম বিশ্ব যে সমস্যা ও সংকটের মুখে ঠিক সেই মুহুর্তে ন্যামে
ইরানের নেতৃত্ব একটা বড় ধরনের কর্মসূচি আমাদের জন্য উপস্থাপন করতে
পারবে।
রেডিও তেহরান : বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার
প্রত্যয় নিয়ে ন্যামের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু, ন্যাম তার সে
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ধরে রাখতে পারেনি। নতুন করে কি এ সংস্থা তার মূল লক্ষ্যে
ফিরে যেতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : দেখুন, ন্যামের ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়
তাহলে দেখব এক ধরনের বিভ্রান্তি সেখানে কাজ করেছিল। ন্যামকে এক সময়
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখাপেক্ষী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আবার
কখনো ন্যামকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
তবে ন্যামের জন্মটা যে কারণে হয়েছিল -তা হচ্ছে এই দুই পরাশক্তির বাইরে
থেকে আলাদাভাবে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একত্রিত করে নেতৃত্ব দেয়া।
আমি তো মনে করি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে ঠিক
তেমনি একটা পরিস্থিতিতে ন্যামের মতো সংগঠনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা
রয়েছে। তবে, এক্ষেত্রে যেটা বড় সমস্যা সেটা হচ্ছে ন্যামভুক্ত দেশগুলো
নানা ধরনের বিভ্রান্তিতে ভুগছে। তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব রয়েছে। ন্যামের
পক্ষে বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক সময় তাদের সমর্থন পাওয়া
যাচ্ছে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিশেষ করে ২০১২ সালের বিশ্ব
রাজনীতির যে পরিস্থিতি আমরা লক্ষ্য করছি সেটা যদি আমরা বিবেচনায় নিই
তাহলে আমি মনে করি এ মুহূর্তে ন্যামের মধ্যে এসে একত্রিত হওয়া ছাড়া আর
কোনো বিকল্প নেই। সব ধরনের বিভেদ, বিভ্রান্তি ভুলে গিয়ে ন্যামের
প্লাটফর্মে সবাইকে একত্রিত হতে হবে।
রেডিও তেহরান : বাংলাদেশ হচ্ছে ন্যামের অন্যতম সদস্য। এ সংস্থা থেকে
বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হতে পারে? আর ন্যামকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে
বাংলাদেশ কি ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : দেখুন, বাংলাদেশ একটি ছোট রাষ্ট্র হলেও মুসলিম
বিশ্বে বাংলাদেশকে অনেক কিছু দেয়ার আছে। মুসলিম বিশ্বের উন্নয়নে অবদান
রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তাছাড়া প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যথেষ্ট এক্সপার্ট রয়েছে। এসব
এক্সপার্টাইজ দিয়ে আমরা কিন্তু মুসলিম বিশ্বে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন
আনতে পারি। এমনকি মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষ থেকে একাধিক দেশে যদি
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যায় সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অবদান
রাখতে পারে।
আমরা যদি অন্যদিক থেকে দেখি যে, ন্যাম কিভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ
করতে পারে- আমার মনে হয় সেটাও সম্ভব। যেহেতু ন্যামের মাধ্যমে বড় একটা
সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে ন্যামও পারে মুসলিম বিশ্বের
বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে বাংলাদেশের মতো ছোটো ছোটো দেশের উন্নয়নে আরো
বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে চিকিতসা বিদ্যায় অবদান রাখতে পারে,
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অবদান রাখা যেতে পারে। এমনকি পারমাণবিক প্রযুক্তিবিদ
উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মধ্যদিয়ে নতুন দিগন্তের
একটা সূচনা করা যেতে পারে। আর ন্যাম এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে
পারে।
রেডিও তেহরান : এবারের ন্যাম সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের প্রতি
আমেরিকা বিশেষ নজর রাখছে। এরইমধ্যে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একজন
কর্মকর্তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক
করেছেন। আপনি কি মনে করেন ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেয়ায় বাংলাদেশ মার্কিন
চাপের মুখে পড়বে?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : দেখুন এ সম্পর্কিত খবরটা আমার চোখেও পড়েছে।
কিন্তু আমি মনে করি যে, এ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে, আমি একটা জিনিষ
সবসময় মনে করি সেটা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক কমিউনিটির
একটি অংশ, বাংলাদেশ যেহেতু জাতিসংঘের চার্টার ফলো করে আর জাতিসংঘ
চার্টারের ২/৪ এবং ২/৭ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে- একটি রাষ্ট্র অন্য
কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বাংলাদেশ
একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অন্য কোনো দেশের দ্বারা পরিচালিত হোক এটা আমরা চাই
না। সুতরাং, বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থেই আজকে ন্যাম সম্মেলনে যোগ
দিয়েছে, অতীতেও যোগ দিয়েছিল এবং আগামীতেও যোগ দেবে। সুতরাং,
যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় দেশ যদি এ নিয়ে কোনো ধরনের কথা বলে থাকে তাহলে
বাংলাদেশ কেন তাদের এ ধরনের কথা গ্রহণ করবে? এটা স্বাধীন সার্বভৌমত্বের
প্রতি হস্তক্ষেপ বলে আমি মনে করি।#
রেডিও তেহরান/জিএআর/এসআই
0 comments:
Post a Comment