আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আওয়ামী লীগও অতীতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন সমর্থন করেনি। মাগুরা ও ভোলার উপনির্বাচন আমাদের কাছে দুটি দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রমাণিত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে প্রভাব খাটায়। তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি উঠেছে, তা যুক্তিযুক্ত।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে যে আস্থা সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশকে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান আর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করলেও বিশ বছর পর এটি একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। যেখানে গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলা হয়, সেখানে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের অবিশ্বাসের, যা গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। রাজনীতিতে বর্তমান অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মূলত একটি কারণেÑ কোন্ সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালিত হবে? বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল শেষ হবে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। সংবিধান অনুযায়ী এর তিন মাস আগে নির্বাচন হতে হবে। অর্থাৎ সবকিছু ঠিক থাকলে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোন সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সমস্যাটা তৈরি হয়েছে সেখানেই। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের দাবি, একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ নির্বাচন হোক। আর সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনে করে সংবিধান অনুযায়ী ও সংবিধানে বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। পরস্পরবিরোধী এ দুই ‘অবস্থানে’ থেকে কোন পক্ষই এতটুকু ছাড় দিচ্ছে না। ফলে রাজনীতির ভবিষ্যৎ একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এ অনিশ্চয়তা গণতন্ত্রের যাত্রাপথের জন্য কোন ভালো সংবাদ নয়। এটা ঠিক, সংবিধানে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে এবং সরকারের শেষ তিন মাস হচ্ছে এই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। অর্থাৎ সরকার থাকবে, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকবেন, সংসদ থাকবে, সংসদ সদস্যরা থাকবেন, তারাই নির্বাচন পরিচালনা করবেন।
অভিজ্ঞতা বলে, ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থেকে যে নির্বাচন করেন, সেই নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনে প্রভাব খাটান। বিরোধী দলের আপত্তিটা সেখানেই। এ ধরনের একটি নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন নাÑ এ কথাটা তারা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন। এই তথাকথিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নিয়েও একটি শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। এর কাঠামো কী হবে, কারা ওই সরকারে থাকবে, এ ব্যাপারে সংবিধানে কোন দিকনির্দেশনা নেই। যদিও প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে এ ধরনের একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে’ যোগ দেয়ার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু লিখিতভাবে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। উপরন্তু কোন্ এখতিয়ারে প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানালেন, তাও স্পষ্ট নয়। ফলে বরফ গলছে না।
এই নির্বাচন নিয়ে সাংবিধানিকভাবে সমস্যা রয়ে গেছে। সংবিধানের ৭২(২) ধারায় বলা আছে, ‘যে কোন সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হইবার ত্রিশ দিনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য সংসদ আহ্বান করা হইবে।’ তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? যেহেতু সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি, সেহেতু ৩৫০ জন (প্রতি আসনে একজন করে মহিলা আসনসহ), একুনে দশম নির্বাচনের পরপরই জাতি মোট ৬৫০ জন সংসদ সদস্য পেল! কে তখন সংসদীয় আসনে প্রতিনিধিত্ব করবেনÑ এ নিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হবে। সাংবিধানিক সমস্যা আরও আছে। সংবিধানের ১২৩(৩) ধারায় বলা আছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ লক্ষ্য করুন, বলা আছে ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার’ কথা। এখন তো সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি। তাহলে সংবিধানের ১২৩(৩) ধারা অনুযায়ী নির্বাচন হবে কিভাবে? সমস্যা আরও আছে। সংসদ নির্বাচন হবে। সংবিধানের ৭২(২) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে সংসদ অধিবেশন আহ্বান করবেন। এক্ষেত্রে আগের সংসদের ৩৫০ জন সদস্যের কী হবে? সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি যে আগের সংসদ ভেঙে যাবে বা সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। বৈসাদৃশ্য আরও আছে। ৭২(৩) ধারা অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে বৈঠকের (সংসদ অধিবেশন) তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে’। এখানে এক ধরনের বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। ৭১(১) ধারায় বলা আছে, ‘এক ব্যক্তি একই সময় একাধিক নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য হইবে না’। এখন নবম জাতীয় সংসদের কোন প্রার্থী পদত্যাগ না করলে তো দশম সংসদে প্রার্থী হতে পারেন না। সংবিধানের ১২১নং ধারায় বলা আছে, ‘সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকায় একটি করিয়া ভোটার তালিকা থাকিবে’। এখন ওই ৯০ দিনের মধ্যে যদি নির্বাচন কমিশন ‘একটি করে ভোটার তালিকা’ প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়, তখন কী হবে?
নির্বাচনের এখনও অনেক দিন বাকি। তারপরও এ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। দেশের সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ, এমনকি হিলারি ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্বও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন প্রত্যাশা করেছেন। এটা ঠিক, সমঝোতা যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়, সেই নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
এ দেশে ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু একটি বড় দল (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ) অংশগ্রহণ না করায় তার কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। অন্যদিকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করায় শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে নির্বাচন। ২০১৩ সালে যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে একটি বড় দল বিএনপি যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সঙ্গত কারণেই ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। একটি দলকে বাদ দিয়ে অন্যদল এককভাবে যেমন গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে পারেনি, ঠিক তেমনি এ দুই দলের একটিকে বাদ দেয়ার কিংবা ‘মাইনাস’ করার কোন ষড়যন্ত্রও সফল হয়নি। এ দল দুটির মাঝে প্রচণ্ড বিরোধ আছে। এই বিরোধ এখন ব্যক্তিপর্যায়ে চলে গেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এ দল দুটির কারণেই গণতন্ত্র এ দেশে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে। আমরা যদি পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, এ দেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট নয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মাঝে ১৯৮৬ (তৃতীয়), ১৯৮৮ (চতুর্থ) ও ১৯৯৬ (ষষ্ঠ) সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বাকি ৬টি সংসদ নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। এক. এ দেশের রাজনীতি দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এ দল দুটির যে কোন একটিকে বাদ দিয়ে এককভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করা অসম্ভব। রাষ্ট্র পরিচালনায় বড় দল দুটির মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। দুই. বড় দল দুটির বাইরে তৃতীয় একটি বড় দলের জš§ হয়নি। তৃতীয় ধারার কথা বারবার বলা হলেও সাধারণ মানুষ এই তৃতীয় ধারার প্রতি আস্থাশীল নয়। জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি নয়। বরং একটি আঞ্চলিক দল এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ‘ঐক্য’ তৃতীয় শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায়। তিন. এককভাবে নির্বাচন করার ফলে সেই নির্বাচনগুলোর কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। চার. এ দেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা দৃশ্যমান। একদিকে ধর্মকে প্রাধান্য করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের একটি ধারা, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষবাদী, এককালের সমাজতন্ত্রী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমর্থকদের একটি ধারা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে যে অচলাবস্থ্া, তার কেন্দ্র মূলত একটি আর তা হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যারা নির্বাচন পরিচালনা করবে। সংবিধানে ১৫তম সংশোধনী আনার ফলে সংবিধানে এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে কিছু নেই। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারই মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আওয়ামী লীগও অতীতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন সমর্থন করেনি। মাগুরা ও ভোলার উপনির্বাচন আমাদের কাছে দুটি দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রমাণিত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে প্রভাব খাটায়। তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি উঠেছে, তা যুক্তিযুক্ত। ইতিমধ্যে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের দাবি উঠেছে, যাতে করে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কথাটা না বলে একটি ‘নির্দলীয় সরকার’ কথাটাও বলা যায়। সরকার সংবিধান সংশোধন করে একটি ‘নির্দলীয় সরকারে’র কাঠামো অন্তর্ভুক্তি করে আন্তরিকতা দেখাতে পারে। তবে সংবিধান সংশোধন না করেও সরকার একটি ‘নির্দলীয় সরকার’ কাঠামোর আওতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। এক্ষেত্রে সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে। সেখানে ‘নির্দলীয় সরকারে’র রূপরেখা থাকবে। মহাজোট সরকারের শরিক যে কেউ (জাসদ অথবা ওয়ার্কার্স পার্টি) সংসদে এ ধরনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে, যাতে বিএনপিসহ সব দলের সমর্থন থাকবে। ওই প্রস্তাবটির ভিত্তি হচ্ছে উচ্চ আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল করে যে রায় দিয়েছিলেন, সেটি। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, আগামী দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং এক্ষেত্রে সংসদ একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জাতীয় সংসদে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিএনপির সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। একটি ‘ফর্মুলা’ উপস্থাপনের আগে বিএনপির যদি আপত্তি থাকে, তাহলে সেই ‘ফর্মুলা’ কোন কাজ দেবে না।
এখন একটি ‘নির্দলীয় সরকার’ কিভাবে গঠিত হবে, সে ব্যাপারে কয়েকটি ‘বিকল্প’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে । এক. বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে মহাজোট সরকার পদত্যাগ করবে এবং একটি নির্দলীয় সরকার শুধু তিন মাসের জন্য দায়িত্ব নেবে; দুই. একটি ‘এলডার্স কাউন্সিল’ নির্দলীয় সরকারের দায়িত্ব নেবে, যারা শুধু নির্বাচন পরিচালনা করবে; তিন. একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির (অথবা একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির) নেতৃত্বে সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে একটি সরকার গঠন। চার. স্পিকারের নেতৃত্বে দুটি বড় দলের সমসংখ্যক সদস্যদের (৫ জন করে) নিয়ে একটি সরকার গঠন। তবে স্পিকার অথবা সদস্যরা কেউই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। পাঁচ. যৌথ নেতৃত্বে (একজন বিএনপি, একজন আওয়ামী লীগ মনোনীত) একটি নির্দলীয় সরকার গঠন, যাদের কেউই নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। ছয়. রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি সরকার।
মোট কথা, ওই তিন মাসের জন্য একটি সরকার গঠিত হবে, যাদের কাজ হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা এবং যারা কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের ক্ষমতাও তাদের দেয়া হবে। এর বাইরেও বিকল্প থাকতে পারে। আর এজন্যই দরকার ‘সংলাপ’। দেশে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দল বড় ধরনের কর্মসূচির ডাক দেবে বলেছে। এতে করে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। রাজনীতিকরাই দেশ চালাবেন। এজন্য যেমন দরকার যোগ্য নেতৃত্ব, ঠিক তেমনি দরকার পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের একটি সংস্কৃতি। এ বিশ্বাস ও আস্থা যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে আমরা বাংলাদেশকে একুশ শতকে নেতৃত্ব দিতে পারব না। একটি সহনশীল, গ্রহণযোগ্য ও বহুমতের অধিকারী বাংলাদেশকেও আমরা গড়ে তুলতে পারব না। রাজনীতিকদের শুভবুদ্ধির উদায় হোকÑ এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
Daily JUGANTOR
14.09.12
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে যে আস্থা সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশকে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান আর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করলেও বিশ বছর পর এটি একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। যেখানে গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলা হয়, সেখানে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের অবিশ্বাসের, যা গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। রাজনীতিতে বর্তমান অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মূলত একটি কারণেÑ কোন্ সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালিত হবে? বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল শেষ হবে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। সংবিধান অনুযায়ী এর তিন মাস আগে নির্বাচন হতে হবে। অর্থাৎ সবকিছু ঠিক থাকলে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোন সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সমস্যাটা তৈরি হয়েছে সেখানেই। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের দাবি, একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ নির্বাচন হোক। আর সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনে করে সংবিধান অনুযায়ী ও সংবিধানে বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। পরস্পরবিরোধী এ দুই ‘অবস্থানে’ থেকে কোন পক্ষই এতটুকু ছাড় দিচ্ছে না। ফলে রাজনীতির ভবিষ্যৎ একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এ অনিশ্চয়তা গণতন্ত্রের যাত্রাপথের জন্য কোন ভালো সংবাদ নয়। এটা ঠিক, সংবিধানে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে এবং সরকারের শেষ তিন মাস হচ্ছে এই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। অর্থাৎ সরকার থাকবে, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকবেন, সংসদ থাকবে, সংসদ সদস্যরা থাকবেন, তারাই নির্বাচন পরিচালনা করবেন।
অভিজ্ঞতা বলে, ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থেকে যে নির্বাচন করেন, সেই নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনে প্রভাব খাটান। বিরোধী দলের আপত্তিটা সেখানেই। এ ধরনের একটি নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন নাÑ এ কথাটা তারা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন। এই তথাকথিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নিয়েও একটি শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। এর কাঠামো কী হবে, কারা ওই সরকারে থাকবে, এ ব্যাপারে সংবিধানে কোন দিকনির্দেশনা নেই। যদিও প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে এ ধরনের একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে’ যোগ দেয়ার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু লিখিতভাবে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। উপরন্তু কোন্ এখতিয়ারে প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানালেন, তাও স্পষ্ট নয়। ফলে বরফ গলছে না।
এই নির্বাচন নিয়ে সাংবিধানিকভাবে সমস্যা রয়ে গেছে। সংবিধানের ৭২(২) ধারায় বলা আছে, ‘যে কোন সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হইবার ত্রিশ দিনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য সংসদ আহ্বান করা হইবে।’ তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? যেহেতু সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি, সেহেতু ৩৫০ জন (প্রতি আসনে একজন করে মহিলা আসনসহ), একুনে দশম নির্বাচনের পরপরই জাতি মোট ৬৫০ জন সংসদ সদস্য পেল! কে তখন সংসদীয় আসনে প্রতিনিধিত্ব করবেনÑ এ নিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হবে। সাংবিধানিক সমস্যা আরও আছে। সংবিধানের ১২৩(৩) ধারায় বলা আছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ লক্ষ্য করুন, বলা আছে ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার’ কথা। এখন তো সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি। তাহলে সংবিধানের ১২৩(৩) ধারা অনুযায়ী নির্বাচন হবে কিভাবে? সমস্যা আরও আছে। সংসদ নির্বাচন হবে। সংবিধানের ৭২(২) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে সংসদ অধিবেশন আহ্বান করবেন। এক্ষেত্রে আগের সংসদের ৩৫০ জন সদস্যের কী হবে? সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি যে আগের সংসদ ভেঙে যাবে বা সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। বৈসাদৃশ্য আরও আছে। ৭২(৩) ধারা অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে বৈঠকের (সংসদ অধিবেশন) তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে’। এখানে এক ধরনের বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। ৭১(১) ধারায় বলা আছে, ‘এক ব্যক্তি একই সময় একাধিক নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য হইবে না’। এখন নবম জাতীয় সংসদের কোন প্রার্থী পদত্যাগ না করলে তো দশম সংসদে প্রার্থী হতে পারেন না। সংবিধানের ১২১নং ধারায় বলা আছে, ‘সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকায় একটি করিয়া ভোটার তালিকা থাকিবে’। এখন ওই ৯০ দিনের মধ্যে যদি নির্বাচন কমিশন ‘একটি করে ভোটার তালিকা’ প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়, তখন কী হবে?
নির্বাচনের এখনও অনেক দিন বাকি। তারপরও এ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। দেশের সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ, এমনকি হিলারি ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্বও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন প্রত্যাশা করেছেন। এটা ঠিক, সমঝোতা যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়, সেই নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
এ দেশে ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু একটি বড় দল (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ) অংশগ্রহণ না করায় তার কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। অন্যদিকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করায় শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে নির্বাচন। ২০১৩ সালে যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে একটি বড় দল বিএনপি যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সঙ্গত কারণেই ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। একটি দলকে বাদ দিয়ে অন্যদল এককভাবে যেমন গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে পারেনি, ঠিক তেমনি এ দুই দলের একটিকে বাদ দেয়ার কিংবা ‘মাইনাস’ করার কোন ষড়যন্ত্রও সফল হয়নি। এ দল দুটির মাঝে প্রচণ্ড বিরোধ আছে। এই বিরোধ এখন ব্যক্তিপর্যায়ে চলে গেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এ দল দুটির কারণেই গণতন্ত্র এ দেশে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে। আমরা যদি পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, এ দেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট নয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মাঝে ১৯৮৬ (তৃতীয়), ১৯৮৮ (চতুর্থ) ও ১৯৯৬ (ষষ্ঠ) সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বাকি ৬টি সংসদ নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। এক. এ দেশের রাজনীতি দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এ দল দুটির যে কোন একটিকে বাদ দিয়ে এককভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করা অসম্ভব। রাষ্ট্র পরিচালনায় বড় দল দুটির মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। দুই. বড় দল দুটির বাইরে তৃতীয় একটি বড় দলের জš§ হয়নি। তৃতীয় ধারার কথা বারবার বলা হলেও সাধারণ মানুষ এই তৃতীয় ধারার প্রতি আস্থাশীল নয়। জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি নয়। বরং একটি আঞ্চলিক দল এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ‘ঐক্য’ তৃতীয় শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায়। তিন. এককভাবে নির্বাচন করার ফলে সেই নির্বাচনগুলোর কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। চার. এ দেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা দৃশ্যমান। একদিকে ধর্মকে প্রাধান্য করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের একটি ধারা, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষবাদী, এককালের সমাজতন্ত্রী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমর্থকদের একটি ধারা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে যে অচলাবস্থ্া, তার কেন্দ্র মূলত একটি আর তা হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যারা নির্বাচন পরিচালনা করবে। সংবিধানে ১৫তম সংশোধনী আনার ফলে সংবিধানে এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে কিছু নেই। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারই মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আওয়ামী লীগও অতীতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন সমর্থন করেনি। মাগুরা ও ভোলার উপনির্বাচন আমাদের কাছে দুটি দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রমাণিত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে প্রভাব খাটায়। তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি উঠেছে, তা যুক্তিযুক্ত। ইতিমধ্যে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের দাবি উঠেছে, যাতে করে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কথাটা না বলে একটি ‘নির্দলীয় সরকার’ কথাটাও বলা যায়। সরকার সংবিধান সংশোধন করে একটি ‘নির্দলীয় সরকারে’র কাঠামো অন্তর্ভুক্তি করে আন্তরিকতা দেখাতে পারে। তবে সংবিধান সংশোধন না করেও সরকার একটি ‘নির্দলীয় সরকার’ কাঠামোর আওতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। এক্ষেত্রে সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে। সেখানে ‘নির্দলীয় সরকারে’র রূপরেখা থাকবে। মহাজোট সরকারের শরিক যে কেউ (জাসদ অথবা ওয়ার্কার্স পার্টি) সংসদে এ ধরনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে, যাতে বিএনপিসহ সব দলের সমর্থন থাকবে। ওই প্রস্তাবটির ভিত্তি হচ্ছে উচ্চ আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল করে যে রায় দিয়েছিলেন, সেটি। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, আগামী দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং এক্ষেত্রে সংসদ একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জাতীয় সংসদে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিএনপির সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। একটি ‘ফর্মুলা’ উপস্থাপনের আগে বিএনপির যদি আপত্তি থাকে, তাহলে সেই ‘ফর্মুলা’ কোন কাজ দেবে না।
এখন একটি ‘নির্দলীয় সরকার’ কিভাবে গঠিত হবে, সে ব্যাপারে কয়েকটি ‘বিকল্প’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে । এক. বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে মহাজোট সরকার পদত্যাগ করবে এবং একটি নির্দলীয় সরকার শুধু তিন মাসের জন্য দায়িত্ব নেবে; দুই. একটি ‘এলডার্স কাউন্সিল’ নির্দলীয় সরকারের দায়িত্ব নেবে, যারা শুধু নির্বাচন পরিচালনা করবে; তিন. একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির (অথবা একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির) নেতৃত্বে সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে একটি সরকার গঠন। চার. স্পিকারের নেতৃত্বে দুটি বড় দলের সমসংখ্যক সদস্যদের (৫ জন করে) নিয়ে একটি সরকার গঠন। তবে স্পিকার অথবা সদস্যরা কেউই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। পাঁচ. যৌথ নেতৃত্বে (একজন বিএনপি, একজন আওয়ামী লীগ মনোনীত) একটি নির্দলীয় সরকার গঠন, যাদের কেউই নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। ছয়. রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি সরকার।
মোট কথা, ওই তিন মাসের জন্য একটি সরকার গঠিত হবে, যাদের কাজ হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা এবং যারা কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের ক্ষমতাও তাদের দেয়া হবে। এর বাইরেও বিকল্প থাকতে পারে। আর এজন্যই দরকার ‘সংলাপ’। দেশে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দল বড় ধরনের কর্মসূচির ডাক দেবে বলেছে। এতে করে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। রাজনীতিকরাই দেশ চালাবেন। এজন্য যেমন দরকার যোগ্য নেতৃত্ব, ঠিক তেমনি দরকার পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের একটি সংস্কৃতি। এ বিশ্বাস ও আস্থা যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে আমরা বাংলাদেশকে একুশ শতকে নেতৃত্ব দিতে পারব না। একটি সহনশীল, গ্রহণযোগ্য ও বহুমতের অধিকারী বাংলাদেশকেও আমরা গড়ে তুলতে পারব না। রাজনীতিকদের শুভবুদ্ধির উদায় হোকÑ এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
Daily JUGANTOR
14.09.12
0 comments:
Post a Comment