অতিসম্প্রতি তেহরানে ১৬তম ন্যাম সম্মেলনের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে ন্যাম কি আদৌ উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে? তেহরানে এ শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এমন এক সময় যখন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলি বিমান হামলার সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছে। মার্কিন প্রশাসন যে ইসরায়েলকে উস্কানি দিচ্ছে, এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট কিংবা বলা যেতে পারে, পাকিস্তানের অব্যাহত পাইলটবিহীন ড্রোন বিমান হামলার কথা। ইরান তার জ্বালানি চাহিদা মেটাতে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এটা তার অধিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল চায় না ইরান একটি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হোক। পাকিস্তানে কট্টরপন্থি তালেবানরা নিঃসন্দেহে অন্যায় করছে ও সীমান্তবর্তী এলাকায় নিজস্ব প্রশাসন চালু করে ফেডারেল রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে মার্কিনি ড্রোন বিমান হামলা চালায় কীভাবে? কোনো আন্তর্জাতিক আইন কি এ হামলার অনুমতি দিয়েছে? জাতিসংঘের সনদে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি এ সনদ মানছে? লিবিয়ার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ও মার্কিন বিমান যখন বোমা বর্ষণ করেছিল, তখনও সেদিন জাতিসংঘের অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। এমনকি কর্নেল গাদ্দাফিকে যখন হত্যা করা হলো সেদিনও আন্তর্জাতিক আইন ছিল উপেক্ষিত। গাদ্দাফি যদি তার জনগণের ওপর অত্যাচার করে থাকেন, তার বিচার করবে সে দেশের জনগণ। কিন্তু লিবিয়ার জ্বালানি সম্পদের প্রতি আগ্রহশীল শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো গাদ্দাফিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়নি। আজ সিরিয়ার পরিস্থিতিও ঠিক তেমনই। সিরিয়ার পরিস্থিতি লিবিয়া থেকে কোনো পার্থক্য নেই। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর সিরিয়ার পতন মানেই ইরানের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা। তেহরানের পতনটা তখন সহজ হয়ে যাবে মাত্র। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যেসব দেশ আজ আক্রান্ত হচ্ছে তারা সবাই উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে। আজ যারাই ক্ষমতা থেকে উৎখাত হচ্ছেন তাদের কারও সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো ছিল না অথবা বলা যেতে পারে, তারা মার্কিনি নীতির কঠোর সমালোচক ছিলেন। কোনো একটি ক্ষেত্রে ন্যাম তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। আজ তেহরানে ন্যাম সম্মেলন হোক, এটাও যুক্তরাষ্ট্র চায়নি। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এ সম্মেলনে যোগ দেবেন, এটাও চায়নি ওয়াশিংটন। বান কি মুন যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও সব বাধা উপেক্ষা করে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্যে বক্তৃতায় ইরানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এটাই সঠিক নীতি। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে জোট নিরপেক্ষতার ওপর জোর দেয়। তাই প্রধানমন্ত্রীর যোগদানকে আমি স্বাগত জানাই। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, ১২০টি দেশ ন্যামের সদস্য হলেও খুব কমসংখ্যক দেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপ্রধান তথা সরকারপ্রধান পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব হয়েছিল। সম্ভবত ন্যামের ইতিহাসে এই প্রথমবার এত কমসংখ্যক সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধান যোগ দিয়েছেন। তবে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথাও উল্লেখ করা যায়। \'আরব বসন্তে\'র নেতা মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসির যোগদান ছিল ১৯৭৯ সালের ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর কোনো মিসরীয় নেতার প্রথম ইরান সফর। ন্যামের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বও এবার চোখে পড়েছে। সিরিয়ার সংকটের জন্য মুরসি দায়ী করেছেন সিরীয় নেতৃত্বকে। যে কারণে সিরিয়া মুরসির ভাষণ বয়কট করে। সিরিয়ার সমস্যার সমাধানের জন্য মুরসি একটি আঞ্চলিক সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন, যেখানে ইরানও থাকবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাব সমর্থন করেনি।
যারা ন্যামের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা জানেন, গত সত্তর দশকে একটা পর্যায়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখাপেক্ষী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এটা নিয়ে ন্যাম সদস্যদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়। অন্য কিছু রাষ্ট্র চেয়েছিল ন্যামকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি নিয়ে যেতে। শেষ পর্যন্ত কোনো পক্ষই সফল হয়নি। আজ সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে ন্যামকে আবার যুক্তরাষ্ট্রের \'মিত্র\' হিসেবে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ন্যামের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, ন্যামের নিজস্ব কোনো সচিবালয় নেই। নেই কোনো কর্মকর্তা। তিন বছর পরপর শীর্ষ সম্মেলন হয়, একটা ঘোষণা দেওয়া হয় এবং ওই তিন বছর সম্মেলন আয়োজনকারী দেশ সভাপতির দায়িত্ব পালন করে। ন্যামে ধনী দেশগুলো আছে। এ দেশগুলো তেল সম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু গরিব দেশগুলোর ব্যাপারে তাদের অবদান এক রকম নেই বললেই চলে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার কথা বলতে পারি। পৃথিবীর দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। ১৯৮১ সালে যেখানে এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৫৪৯ মিলিয়ন, সেখানে ২০০৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৯৫ মিলিয়নে। এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জনপ্রতি দৈনিক আয় মাত্র ১ ডলার ২৫ সেন্ট, যা জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী চরম দারিদ্র্য। সে সঙ্গে এ অঞ্চলে ২৫০ মিলিয়ন (অর্থাৎ ২৫ কোটি) শিশু অপুষ্টির শিকার। ৩০ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যায় না। তিন ভাগের ১ ভাগ মহিলা রক্তশূন্যতায় ভোগে। যদি শুধু ভারতের কথা বলি, ভারতে ২০০৪ সালে যেখানে ২৭.৫ ভাগ লোক দরিদ্র ছিল, ২০১০ সালে তা বেড়েছে ৩৭.০২ ভাগে। ৩০ বছরের মধ্যে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে এটা যেমনি সত্য, ঠিক তেমনি এটাও সত্য যে, জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫৩ ভাগের কোনো টয়লেট নেই। ৩৯ ভাগ জনগোষ্ঠীর নেই কোনো রান্নাঘর। দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য দূরীকরণে ন্যাম কোনো ভূমিকা রাখেনি। ভারত ন্যামের অন্যতম উদ্যোক্তা। ১৯৬১ সালে অধুনালুপ্ত যুগোস্ল্নাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে যে ন্যামের জন্ম ওই সম্মেলনে উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন জওয়াহেরলাল নেহরু, ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আজ ৫১ বছর পর ন্যাম যখন শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয় তখন বিশ্ব অনেক বদলে গেছে বটে; কিন্তু মূল স্পিরিট অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বিদেশি আগ্রাসন ইত্যাদি প্রশ্নে নিপীড়িত মানুষের যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম থেমে নেই। নতুন চরিত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ আবির্ভূত হয়েছে। বিদেশি আগ্রাসন আরও বেড়েছে। সুতরাং প্রাসঙ্গিকতা থাকবেই। তবে এ আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে হলে নিজেদের মধ্যে বিরোধী ও বৈষম্য কমাতে হবে। আগ্রাসনের প্রশ্নে সব রাষ্ট্রকে এক হতে হবে। আজ দারিদ্র্য দূরীকরণে ন্যামের ধনী রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সে সঙ্গে ঋণ সমস্যার সমাধান, বাণিজ্য সম্পর্কিত উরুগুয়ে রাউন্ড আলোচনার একটা সমাধান, জনসংখ্যা রোধ, উত্তর-দক্ষিণ সংলাপ, উন্নয়নশীল শিল্প ও উন্নত বিশ্বের মধ্যে একটা অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ন্যাম একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ন্যামের প্রয়োজনীয়তা যেমনি ছিল আজ \'দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ\' চলাকালেও এর ঠিক তেমনি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
Daily SAMAKAL
11.09.12
0 comments:
Post a Comment