সারা দেশের মানুষ যখন গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের খবরটি শোনার জন্য, তখন ১৩ সেপ্টেম্বর ৭ জন মন্ত্রী শপথ নিলেন। মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে নেয়ার এটা কোনো উদ্যোগ কি না বলতে পারবো না, তবে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এ কথাটাই ফিরছে চলতি সপ্তাহের প্রতিটি দিন। রোববার পর্যন্ত হলমার্ক ঘটনায় কেউই গ্রেফতার হয়নি। মিডিয়ায় এ ঘটনায় সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগসাজশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একজন উপদেষ্টার দিকে বারবার ইঙ্গিত করা হচ্ছে। অথচ সরকারের কারো মাথাব্যথা নেই। মানুষের এই উৎকণ্ঠার দিকে আদৌ নজর না দিয়ে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ করা হলো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে মন্ত্রী হলেন হাসানুল হক ইনু। আর তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রী হননি। ১৩ সেপ্টেম্বরের প্রতিটি পত্রিকায় হেডিং ছিল তোফায়েল মন্ত্রী হচ্ছেন। এমনকি মন্ত্রী পরিষদের সচিবও বিবিসির বাংলা বিভাগকে জানিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে আমরা শুনলাম তাঁকে আদৌ আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কার কথা সত্যি, আমরা বলতে পারবো না। তবে তোফায়েল আহমেদ শপথ নেননি, এটাই বাস্তব। তিনি একটা যুক্তি দেখিয়েছেন, মানসিকভাবে তিনি প্রস্তুত নন এই মুহূর্তে। তোফায়েল আহমেদ পরিপূর্ণভাবে সুস্থ। একটি সংসদীয় কমিটির সভাপতিও তিনি। উপরন্তু কাপাসিয়া উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নির্বাচন তিনি পরিচালনা করছেন। যে ক’জন মন্ত্রী হয়েছেন, তার মাঝে তিনি নিঃসন্দেহে যোগ্য। অসুস্থতা তাকে এখনও কাবু করতে পারেনি। অতীতেও মন্ত্রী ছিলেন। বাণিজ্য মন্ত্রী। মিডিয়ায় অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছিল সরকারের অদক্ষ মন্ত্রিসভাকে দক্ষ ও সচল করতে অচিরেই তোফায়েল আহমেদকে মন্ত্রী বানানো হবে। সেই সাথে রাশেদ খান মেননের কথাও আলোচিত হচ্ছিল বেশ জোরেশোরে। অথচ কেউ মন্ত্রী হলেন না। আওয়ামী লীগের যে ছ’জন মন্ত্রী হলেন, তাদের মাঝে একজন মহিউদ্দীন খান আলমগীর বাদে বাকিরা সবাই আনকোরা। এমনকি সংসদীয় কার্যক্রমেও তাদের সক্রিয় হতে দেখিনি। কিন্তু তাদের কপাল খুলে গেল। মন্ত্রী হলেন। তবে আমি তোফায়েল আহমেদের ব্যাপারে একটু আশ্চর্য হয়েছি বৈ কি! হতে পারেন তিনি সংস্কারবাদী। কিন্তু যোগ্যতায় তিনি অনেকের চাইতে এগিয়ে। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তার। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি কিছু কথা বলেছিলেন বটে। কিন্তু মূলধারা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। তার মন্ত্রী না হওয়ার সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই। ‘শেষ বেলা’য় মন্ত্রী তাকে নতুন কোনো মর্যাদায় নিয়ে যাবে না। মেনন মন্ত্রী হননিÑ এটা দলীয় সিদ্ধান্ত। সম্ভবত মেনন সাহেবের কাছে যা বিবেচ্য হয়েছে বেশি, তা হচ্ছে সরকারের সকল ‘অপরাধের’ দায়ভার গ্রহণ না করা। দ্বিতীয়ত আরেকটি চিন্তা তার ভেতরে কাজ করে থাকতে পারে। আর তা হচ্ছে আগামীতে মহাজোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে বামন্থীদের সমন্বয়ে তৃতীয় একটি ‘ধারা’র সূচনা করা। তবে তাতে তিনি সফল হবেন, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। জনাব হাসানুল হক ইনুর মন্ত্রিসভায় যোগদানে আমি অবাক হইনি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেই ইনু সাহেবরা প্রথম বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ থেকে শুরু করে গণবাহিনীর জন্ম দিয়েছিল জাসদ। জাসদের গণভিত্তি কতটুকু তার পরিসংখ্যান শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, আমাদের কাছেও আছে। ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে তিনি নির্বাচন না করলে (নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন), তিনি তার জামানত ফিরে পেতেন কি না, আমি নিশ্চিত নই। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘সাবেক মন্ত্রী’ এ পরিচয়টা তিনি দিতে পারবেন বটে, কিন্তু আগামী তের মাসের যে রাজনীতি তাতে আদৌ গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবেন না। ইনু সাহেবের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির মধ্যে দিয়ে এখন মহাজোট সরকারে আওয়ামী লীগের বাইরে তিনটি দলের প্রতিনিধিত্ব ঘটলো। জাতীয় পার্টি, সাম্যবাদী দল ও জাসদ। জি এম কাদের ও হাসানুল হক ইনু নির্বাচিত সংসদ সদস্য হলেও, দিলীপ বড়–য়া সংসদ সদস্য নন। তার নিজের সংসদীয় নির্বাচনের রেকর্ড খুবই খারাপ। অতীতে কখন পাঁচশত ভোটের উপর তিনি পাননি। মহাজোটে জাতীয় পার্টির অন্তর্ভুক্তিতে স্ট্রাটেজিকলি শেখ হাসিনা ও তার সরকার নিঃসন্দেহে উপকৃত হয়েছেন। জাতীয় পার্টির বেশ ক’জন সংসদ সদস্য রয়েছেন, যারা লাঙ্গল মার্কা নিয়েই বিজয়ী হয়েছেন, ইনু সাহেবদের মত তাদের ‘নৌকা’ প্রতীক নিতে হয়নি। তবে এই জাতীয় পার্টিকে কি শেখ হাসিনা মহাজোটে পাবেন আগামী দিনে! এরশাদ সাহেব তো এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও নিন্দুকেরা এরশাদের এই ঘোষণায় ‘অন্য কিছু’র গন্ধ খুঁজে পান।
প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করলেন। এটা তার অধিকার। তিনি যখন ইচ্ছা মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করতে পারেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা করে কতটুকু লাভবান হবেন তিনি? মন্ত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। এতে করে বাড়লো রাষ্ট্রের খরচ। সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এখনও যখন স্থিরতা আসছে না, ইউরোপের অনেক দেশে যখন এখনও কৃচ্ছ্রতাসাধন চলছে, তখন আমাদের মত দেশে এত বড় একটি মন্ত্রিসভা রাখার আদৌ প্রয়োজন নেই। অনেক মন্ত্রীর অদক্ষতা ও দুর্নীতি দেশে ও দেশের বাইরে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, সেখানে এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভার কলেবর বৃদ্ধি করার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। সরকার নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত। সর্বশেষ হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে পুরো অর্থনীতি এখন ঝুঁকির মুখে। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে শুধু সোনালী ব্যাংকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, এতে আরো ২৯টি ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হলমার্কের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বাইরেও ডেসটিনির ৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার অর্থ পাচার, যুবক এর ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ইউনিপেটুইউর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট কিংবা আইটিসিএলের ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনার সাথে সরকারের প্রভাবশালী মহল জড়িত। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়া ও ইব্রাহিম খালেদ তদন্ত রিপোর্টে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিচার হয়নি। কাকতালীয়ভাবে কি না জানি না, রেলওয়ের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকাসহ বিজেবির হাতে ধরা পড়ার পর মন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সুরঞ্জিত ফিরে এসেছিলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে। আজ হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে সারা জাতি যখন ওই একটি বিষয়ের দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখছেন এবং বামমনা দলগুলো যখন আওয়ামীবলয়ের বাইরে একটি ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে, ঠিক তখনই মন্ত্রিসভায় ৭ জন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হলেন। কিন্তু তাতে করে কি মানুষ হলমার্ক কেলেঙ্কারি ভুলে যাবে? নানা ফ্রন্টে সরকারের পারফরমেন্স খুব আশাপ্রদ নয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে জটিলতা এখনও কাটেনি। অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের ফিরে না আসার সম্ভাবনাই বেশি। ড. ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরকারের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল এখন সরকারের গলার কাঁটা। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এখন ভর্তুকি কমানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত অর্থের বিনিমেয় এই ‘বিদ্যুৎ সেবা’ নিতে হচ্ছে। ২০০৬ সালের আগে যেখানে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়নি, সেখানে গত অর্থবছরে দিতে হয়েছিল ৬ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। আর গত তিন মাসে এ খাতে তেলে ভর্তুকির পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা। (আমার দেশ, ১২ সেপ্টেম্বর)। কিন্তু তারপরও লোডশেডিং এখন খোদ ঢাকা শহরে দু’ ঘণ্টার ওপরে প্রতিদিন।
মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমবাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেখান থেকে নিত্য কর্মীরা দেশে ফিরে আসছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এক বছরে ব্যবসা সক্ষমতা সূচকে ১০ ধাপ অবনমনের ফলে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে ঠেকেছে। ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮ তম, অথচ এক বছর আগেও ছিল ১০৮তম। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ০.৮০ ভাগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১ ভাগ। এসব বিষয় সরকার প্রধানের গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া উচিত। কেননা সরকারকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে। তাদের দক্ষতা দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে নজর না দিয়ে শুধু মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে আর যাই হোক জনগণের আস্থা অর্জন করা যাবে না।
সরকারের বয়স আর আছে মাত্র তের থেকে পনের মাস। সরকার নিজেও জানে যে বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছিল, তা তারা পূরণ করতে পারেনি। সুশাসন তারা নিশ্চিত করতে পারেনি বরং উল্টোটি ঘটেছে। দুর্নীতি আজ সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে গেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যখন দুর্নীতি হয় এবং তা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন তা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে বৈকি! দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছিলেন। অথচ আজ এমন একজন মন্ত্রী হলেন, তিনি ওই আবুল হোসেনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘সাকো’র এমডি। তাহলে ওই নয়া মন্ত্রীর মাধ্যমে কি দুর্নীতি ছড়াবে না? এ প্রশ্ন আজ অনেকের। ত্যাগী, যোগ্য ও সৎ লোক আওয়ামী লীগে আছে। তাদেরকে বাদ দিয়ে অচেনা, অযোগ্য লোকদের যখন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন প্রশ্ন উঠবেই। ‘কালো বিড়াল’কে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা, অযোগ্য লোকদের মন্ত্রী বানানোর মধ্যে দিয়ে আর যাই হোক সরকারের ইমেজ বৃদ্ধি হবে না। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের চাইতেও এই মুহূর্তে যা জরুরি তা হচ্ছে দুর্নীতি রোধের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হওয়া, বিরোধী দলের সাথে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার গঠনে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে দশম জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। সরকার প্রধান এ পথে হাঁটছেন না। ইতিহাস থেকে তিনি শিক্ষা নেননি। অযোগ্য, মূর্খ লোকদের মন্ত্রী বানিয়ে তিনি সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। কিন্তু সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেননি।
0 comments:
Post a Comment