আমাদের
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশি
আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন একটি জাতীয় দৈনিকে গত
২২ জুলাই ২০১৪ তারিখে। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘তালপট্টি থাকলে
ক্ষতিগ্রস্ত হতো বাংলাদেশ’ (সকালের খবর)। দীপু মনি আদালতে বাংলাদেশ সরকারের
প্রধান এজেন্ট ছিলেন। তার ডেপুটি ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবেক
কর্মকর্তা ও বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব পর্যায়ে কর্মরত রিয়ার
এডমিরাল (অব.) খুরশীদ আলম। খুরশীদ আলম নেভিতে থাকার কারণে সমুদ্রসীমা,
সমুদ্র আইন ইত্যাদি নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। মূলত তার এই অভিজ্ঞতার কারণেই
তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তার এই অভিজ্ঞতার পাশাপাশি
দীপু মনির তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এ বিষয়ে তিনি পড়ালেখা করেছেন, এমন
তথ্যও আমার জানা নেই। কিন্তু তারপরও একজন পূর্ণমন্ত্রী হয়ে তিনি আদালতে
ছিলেন প্রধান এজেন্ট, যেখানে ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব। উক্ত সাক্ষাৎকারে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তার
সারসংক্ষেপ অনেকটা এ রকম : ১. তালপট্টি কোনো দ্বীপ ছিল না, ২. তালপট্টি
থাকলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতাম, ৩. ১৯৮০ সালের পর ম্যাপে তালপট্টিকে ভারতের
দিকে দেখানো হয়েছে, ৪. বাংলাদেশ সালিশি আদালতে ন্যায্য দাবি নিয়ে যায়।
বিএনপি-জামায়াত জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালন করেনি, ৫. মামলা করে
আমরা ৮০ শতাংশ পেয়েছি, আর ভারত পেয়েছে ২০ শতাংশ। সুতরাং ভারত এটাকে বিজয়
বলতেই পারে, ৬. ভারতের দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবই আমরা পেয়েছি। তিনটি ব্লকের
সামান্য একটু অংশ ভারত পেয়েছে। এখন ইজারাদাররা আসবে। দীপু মনির এই
বক্তব্য নিয়ে বলার কিছু নেই। ইতোমধ্যে এ নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়েছে। তার
বক্তব্য অনেকটাই ‘রাজনৈতিক’ ও নিজের অবস্থানকে বড় করে দেখানো। তালপট্টি
দ্বীপ ছিল কি-না, তা খুরশীদ আলমের নিজের লেখাতেই প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি
একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ‘নতুন গোল পোস্ট’ তত্ত্ব উপস্থাপন
করেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ার আগে তিনি সমুদ্র আইন ও
সমুদ্রসীমা নিয়ে লেখালেখি করেছেন। সেমিনারে বক্তব্যও রেখেছেন। একজন দক্ষ ও
অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে এই সময় তার বক্তব্য বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। তালপট্টি
দ্বীপের যে অস্তিত্ব ছিল, তা খুরশীদ আলমের লেখনীতেও আমরা পেয়েছি। এমনকি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের
লেখনীতেও এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব ছিল। এখন জলবায়ু
পরিবর্তনের কারণে এটা ডুবে যেতে পারে, কিন্তু তার অস্তিত্ব নেই, এটা বলা
যাবে না। গুগল আর্থে এখনো তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব দেখানো আছে। ওখানে তেল
ও গ্যাসের রিজার্ভের বেশ সম্ভাবনাও রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের
ডিফেন্স ফোরাম ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ভারত ২০০৬ সালে
হাড়িয়াভাঙ্গার মুখের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ১০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস
পেয়েছে। এখানে গ্যাসের সর্বোচ্চ মজুদ রয়েছে। কৃষ্ণ-গোদাবরি অঞ্চলে যে
গ্যাস পাওয়া গিয়েছিল, তার পরিমাণ ছিল ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ভারতের দৈনিক
টেলিগ্রাফের ২৭ নভেম্বরের সংখ্যায়ও এই পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছিল। অর্থনীতিবিদ
আনু মুহাম্মদ একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১৮ জুলাই (২০১৪) যে প্রবন্ধ লেখেন,
তাতে তিনি এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তালপট্টি দ্বীপ যে আমাদের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে গভীর ও
অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে ২৮ ব্লকে এলাকাটিকে ভাগ
করেছিল তার মাঝে ২১নং ব্লকে অন্তর্ভুক্ত ছিল দক্ষিণ তালপট্টি। হেগের সালিশি
আদালতের রায় অনুযায়ী হাড়িয়াভাঙ্গা নদী বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়,
বাংলাদেশ এর আশপাশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে উদ্যোগ নেবে কি-না, সেটাই
একটা প্রশ্ন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ও টিভি টকশোতে (আরটিভি) অধ্যাপক হোসেন
মনসুর (চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলা) আমাকে জানিয়েছেন, দক্ষিণ তালপট্টি এলাকায়
জ্বালানি সম্পদ আছে (তেল ও গ্যাস), এ তথ্য তার জানা নেই। আমি জ্বালানি
বিশেষজ্ঞ নই। ফলে কার বক্তব্য সত্য, এটা নিয় প্রশ্ন থাকবেই। ভারত
বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র ১০০ টিসিএফ গ্যাস ও বিলিয়ন ব্যারেল তেল আবিষ্কার
করেছে। মিয়ানমার করেছে ৭.৭ টিসিএফ গ্যাস। ২০০৬ সালে ভারত সরকার তাদের ২৪টি
গভীর সমুদ্র ব্লক টেন্ডার প্রদানের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে ব্লক
ডি ২৩ (৮৭০৬ বর্গকিলোমিটার) ও ব্লক ডি ২২ (৭৭৯০ বর্গকিলোমিটার) বাংলাদেশ
সরকার ঘোষিত ১৯৯১ সালের ২১টি ব্লকের অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে। এখন নয়া রায়ের
ফলে দেখতে হবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্লকগুলোর কটি এখন পুনর্বিন্যাস করতে
হবে। মহীসোপান নিয়েও একটা বিভ্রান্তি আছে। এমনকি ‘ধূসর এলাকা’ নিয়েও আছে
প্রশ্ন।
তবে এটা বলতেই হবে এই রায়ে বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করল। বাংলাদেশের সালিশি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিল সঠিক ও যুক্তি সঙ্গত। চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই ১৯৭৪ সাল থেকেই আলোচনা চলে আসছিল। ফলাফল ছিল শূন্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ রয়েছে 3rd united Nations convention on the Law of Sea (UNCLOS 111)। এটি ১৯৮২ সালে গৃহিত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর। ভারত ১৯৮৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে UNCLOS 111 অনুমোদন করে। বাংলাদেশ অনুমোদন করে অনেক পরে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই (অনুস্বাক্ষর ১৯৮২) নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে সমুদ্রসীমার দাবির স্বপক্ষে তথ্য, উপাত্ত উপস্থাপন করতে হতো। বাংলাদেশ ২০১১ সালের জুলাইয়ের পর তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়ার পরই আদালত এই সিদ্ধান্ত নিল। তখন আদালতের এই রায় আমাদের জন্য যেমনি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল, ঠিক তেমনি দায়িত্বও বেড়ে গেল। সমুদ্রে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। প্রচুর তেল-গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি খনিজ ও মৎস্য সম্পদের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে সমুদ্রে। যেহেতু মিঠা পানির মাছের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের আমিষের একটা সম্ভাবনা হলো সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ। এই সম্পদ আহরণে আমাদের পর্যাপ্ত আধুনিক ট্রলার নেই। ছোট ছোট নৌকা বা ছোট ট্রলারে করে মৎস্য আহরণ করা হয়। কিন্তু এগুলো গভীর সমুদ্রে যেতে পারে না। ফলে আমাদের এলাকা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ড ও ভারতীয় জেলেরা। বাংলাদেশ সরকারকে এখন উদ্যোগী হয়ে বড় বড় ট্রলার তৈরি ও মৎস্যজীবীদের মাঝে সমবায়ের ভিত্তিতে বিতরণ করতে হবে, যাতে এরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে পারেন। দক্ষ ও জনশক্তি আমাদের নেই। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা হয় কম। বাংলাদেশ নেভি তাদের স্বার্থে কিছু গবেষণা করে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে দুটি সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ আছে। চট্টগ্রামে একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব সিদ্ধান্ত ভালো। বরিশাল ও পটুয়াখালী (যা সমুদ্রে এলাকায় অবস্থিত) বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে নেভির তথা সমুদ্র অধিদফতর থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের এসব বিভাগে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে আইন অনুষদ আছে, সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে সমুদ্র আইন সংক্রান্ত একটি বিষয় চালু করতে হবে। দীর্ঘদিন পর মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলো। কিন্তু কাজ অনেক বাকি। সরকারের একটি বড় উদ্যোগের প্রতি তাকিয়ে থাকবে এখন সবাই। এখন বিজয় উৎসবের সময় নয়। এ নিয়ে কৃতিত্ব নেয়ারও কিছু নেই। আমরা ভারতের দৃষ্টান্ত দেখে শিখতে পারি। ভারতে এটা নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। লেখালেখিও তেমন চোখে পড়েনি। একটা রায় হয়েছে এবং আমাদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তখন দেখতে হবে এই ‘অধিকারকে’ আমরা কীভাবে ব্যবহার করি। আমরা দুটি রায়ই পেলাম। রায়ের আলোকে অতি দ্রুত সীমানা নির্ধারণ করে সেখানে আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ জন্য সমুদ্র অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের UNCLOS ডেস্ককে আরো শক্তিশালী করাও জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরুণ কর্মকর্তাদের নির্দেশে পাঠিয়ে এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বঙ্গোপসাগর হচ্ছে ২.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের এক বিশাল এলাকা। এর মাঝে একটা সীমিত এলাকা আমাদের। তবে এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। শুধু মৎস্য সম্পদ আহরণ করে আমরা আমাদের আমিষের ঘাটতি মেটাতে পারি। আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব পড়বে। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারত এ অঞ্চলে তাদের নৌ তৎপরতা বাড়াচ্ছে। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৫০ শতাংশ পরিচালিত হয় এই রুট দিয়ে। আর চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৬০ শতাংশ বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়বে। এ জন্য আমাদের নৌ বাহিনী ও কোস্টাল গার্ডকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। বহিঃসমুদ্রে টহল বাড়াতে হবে। বঙ্গোপসাগর নিয়ে গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় ‘বিস’ এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘বিস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তবে এখানে বঙ্গোপসাগর নিয়ে কোনো কাজ হয় না। এখন হতে পারে। সিঙ্গাপুরের জমিন পূর্ব এশিয়ান ইনস্টিটিউটের সঙ্গেও যৌথভাবে গবেষণা কর্ম পরিচালনা করা সম্ভব। আমরা একটা ‘রায়’ পেয়েছি বলে যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, তাহলে আমরা ভুল করব। আমাদের কাজ আরো বাড়ল। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। মহীসোপানের বিষয়টিরও সমাধান হয়নি। এটা সমাধান করবে জাতিসংঘের অপর একটি সংস্থা। ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় মহীসোপান। উপরের অংশ, অর্থাৎ জলরাশি দিয়ে মহীসোপানের বিচার করা হয় না। মহীসোপানের বিচার করা হয় পানির নিচের অংশ দিয়ে, যেখানে তেল, গ্যাসসহ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। মহীসোপানে আমাদের সীমানা নির্ধারিত হলেই আমরা মহীসোপানে অর্থাৎ সাগরের নিচে আমাদের কর্মকাণ্ড চালাতে পারব। এই মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণের জন্য আমাদের ন্যূনতম চার থেকে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণত ৩৫০ থেকে ৪০০ নটিক্যাল মাইলকে মহীসোপানের সীমানা ধরা হয়। বাংলাদেশ ২০১১ সালে তার মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘে জমা দেয়। মোট ৫২টি দেশের আবেদনপত্র জাতিসংঘ বিবেচনা করছে। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন সরকারকে এখন খুব দ্রুত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। রায়ের পর সরকার সময় পাবে ৫ বছর। নিয়মানুযায়ী কোনো দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর প্রথম ৫ বছর সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথোরিটিকে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। কিন্তু ৫ বছরের পর থেকে আহহৃত মোট সামুদ্রিক সম্পদের একটা অংশ এই কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমুদ্র অধিদফতরকে রেখেও একটি বৃহৎ পরিসরে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নৌ বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া সিনিয়র কর্মকর্তাদের এই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জড়িত করা প্রয়োজন। এর ফলে তাদের মেধা ও যোগ্যতাকে আমরা কাজে লাগতে পারব। একজন অদক্ষ আমলাকে দিয়ে এই কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। একটা রায় পেয়েছি। এটা নিয়ে যদি আমরা বসে থাকি, আমরা অনেক বড় ভুল করব। আমাদের যেতে হবে অনেক দূরে। আমরা কি পেয়েছি, কি হারিয়েছি, এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, ততই আমাদের মঙ্গল। দীপু মনি তার সাক্ষাৎকারে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এটা অনভিপ্রেত। আমাদের এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। কোনোকিছুতেই আমরা অতীতকে টেনে আনি, বিরোধী পক্ষের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করি, এটা ঠিক নয়। সবাইকে নিয়েই দেশ। এখন সীমানা নির্ধারিত হলো এটাই বড় কথা। কাউকে ছোট করে নিজেকে বড় করা যায় না। বড় হতে হয় কর্মে ও অভিজ্ঞতায়। মামলা করে আমরা ৮০ শতাংশ পেয়েছি এটার পুরোপুরিভাবে সঠিক নয়। সালিশি আদালতে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না। কেননা তিন ভাগে সমুদ্র সীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক আদালত ও আরব্রিটাল ট্রাইব্যুনাল বা সালিশি আদালত। ভারত প্রথম দুটি কোর্টের ব্যাপারে তার আপত্তি আগেই দেয়ায় তৃতীয় বিকল্প অর্থাৎ সালিশি আদালতে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নির্ধারণে কিন্তু সালিশি আদালতে যায়নি। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে এই বিবাদ মীমাংসিত হয়েছিল। তবে এটা সত্য, সালিশি আদালতে যাওয়ার পরও ভারত আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি। সুতরাং সমুদ্র সীমা নিয়ে আমরা আর কোনো বিতর্ক চাই না। এটা এখন মীমাংসিত বিষয়। Daily Manob Kontho 27.07.14
তবে এটা বলতেই হবে এই রায়ে বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করল। বাংলাদেশের সালিশি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিল সঠিক ও যুক্তি সঙ্গত। চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই ১৯৭৪ সাল থেকেই আলোচনা চলে আসছিল। ফলাফল ছিল শূন্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ রয়েছে 3rd united Nations convention on the Law of Sea (UNCLOS 111)। এটি ১৯৮২ সালে গৃহিত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর। ভারত ১৯৮৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে UNCLOS 111 অনুমোদন করে। বাংলাদেশ অনুমোদন করে অনেক পরে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই (অনুস্বাক্ষর ১৯৮২) নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে সমুদ্রসীমার দাবির স্বপক্ষে তথ্য, উপাত্ত উপস্থাপন করতে হতো। বাংলাদেশ ২০১১ সালের জুলাইয়ের পর তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়ার পরই আদালত এই সিদ্ধান্ত নিল। তখন আদালতের এই রায় আমাদের জন্য যেমনি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল, ঠিক তেমনি দায়িত্বও বেড়ে গেল। সমুদ্রে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। প্রচুর তেল-গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি খনিজ ও মৎস্য সম্পদের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে সমুদ্রে। যেহেতু মিঠা পানির মাছের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের আমিষের একটা সম্ভাবনা হলো সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ। এই সম্পদ আহরণে আমাদের পর্যাপ্ত আধুনিক ট্রলার নেই। ছোট ছোট নৌকা বা ছোট ট্রলারে করে মৎস্য আহরণ করা হয়। কিন্তু এগুলো গভীর সমুদ্রে যেতে পারে না। ফলে আমাদের এলাকা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ড ও ভারতীয় জেলেরা। বাংলাদেশ সরকারকে এখন উদ্যোগী হয়ে বড় বড় ট্রলার তৈরি ও মৎস্যজীবীদের মাঝে সমবায়ের ভিত্তিতে বিতরণ করতে হবে, যাতে এরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে পারেন। দক্ষ ও জনশক্তি আমাদের নেই। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা হয় কম। বাংলাদেশ নেভি তাদের স্বার্থে কিছু গবেষণা করে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে দুটি সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ আছে। চট্টগ্রামে একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব সিদ্ধান্ত ভালো। বরিশাল ও পটুয়াখালী (যা সমুদ্রে এলাকায় অবস্থিত) বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে নেভির তথা সমুদ্র অধিদফতর থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের এসব বিভাগে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে আইন অনুষদ আছে, সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে সমুদ্র আইন সংক্রান্ত একটি বিষয় চালু করতে হবে। দীর্ঘদিন পর মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলো। কিন্তু কাজ অনেক বাকি। সরকারের একটি বড় উদ্যোগের প্রতি তাকিয়ে থাকবে এখন সবাই। এখন বিজয় উৎসবের সময় নয়। এ নিয়ে কৃতিত্ব নেয়ারও কিছু নেই। আমরা ভারতের দৃষ্টান্ত দেখে শিখতে পারি। ভারতে এটা নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। লেখালেখিও তেমন চোখে পড়েনি। একটা রায় হয়েছে এবং আমাদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তখন দেখতে হবে এই ‘অধিকারকে’ আমরা কীভাবে ব্যবহার করি। আমরা দুটি রায়ই পেলাম। রায়ের আলোকে অতি দ্রুত সীমানা নির্ধারণ করে সেখানে আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ জন্য সমুদ্র অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের UNCLOS ডেস্ককে আরো শক্তিশালী করাও জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরুণ কর্মকর্তাদের নির্দেশে পাঠিয়ে এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বঙ্গোপসাগর হচ্ছে ২.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের এক বিশাল এলাকা। এর মাঝে একটা সীমিত এলাকা আমাদের। তবে এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। শুধু মৎস্য সম্পদ আহরণ করে আমরা আমাদের আমিষের ঘাটতি মেটাতে পারি। আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব পড়বে। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারত এ অঞ্চলে তাদের নৌ তৎপরতা বাড়াচ্ছে। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৫০ শতাংশ পরিচালিত হয় এই রুট দিয়ে। আর চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৬০ শতাংশ বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়বে। এ জন্য আমাদের নৌ বাহিনী ও কোস্টাল গার্ডকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। বহিঃসমুদ্রে টহল বাড়াতে হবে। বঙ্গোপসাগর নিয়ে গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় ‘বিস’ এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘বিস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তবে এখানে বঙ্গোপসাগর নিয়ে কোনো কাজ হয় না। এখন হতে পারে। সিঙ্গাপুরের জমিন পূর্ব এশিয়ান ইনস্টিটিউটের সঙ্গেও যৌথভাবে গবেষণা কর্ম পরিচালনা করা সম্ভব। আমরা একটা ‘রায়’ পেয়েছি বলে যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, তাহলে আমরা ভুল করব। আমাদের কাজ আরো বাড়ল। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। মহীসোপানের বিষয়টিরও সমাধান হয়নি। এটা সমাধান করবে জাতিসংঘের অপর একটি সংস্থা। ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় মহীসোপান। উপরের অংশ, অর্থাৎ জলরাশি দিয়ে মহীসোপানের বিচার করা হয় না। মহীসোপানের বিচার করা হয় পানির নিচের অংশ দিয়ে, যেখানে তেল, গ্যাসসহ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। মহীসোপানে আমাদের সীমানা নির্ধারিত হলেই আমরা মহীসোপানে অর্থাৎ সাগরের নিচে আমাদের কর্মকাণ্ড চালাতে পারব। এই মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণের জন্য আমাদের ন্যূনতম চার থেকে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণত ৩৫০ থেকে ৪০০ নটিক্যাল মাইলকে মহীসোপানের সীমানা ধরা হয়। বাংলাদেশ ২০১১ সালে তার মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘে জমা দেয়। মোট ৫২টি দেশের আবেদনপত্র জাতিসংঘ বিবেচনা করছে। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন সরকারকে এখন খুব দ্রুত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। রায়ের পর সরকার সময় পাবে ৫ বছর। নিয়মানুযায়ী কোনো দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর প্রথম ৫ বছর সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথোরিটিকে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। কিন্তু ৫ বছরের পর থেকে আহহৃত মোট সামুদ্রিক সম্পদের একটা অংশ এই কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমুদ্র অধিদফতরকে রেখেও একটি বৃহৎ পরিসরে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নৌ বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া সিনিয়র কর্মকর্তাদের এই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জড়িত করা প্রয়োজন। এর ফলে তাদের মেধা ও যোগ্যতাকে আমরা কাজে লাগতে পারব। একজন অদক্ষ আমলাকে দিয়ে এই কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। একটা রায় পেয়েছি। এটা নিয়ে যদি আমরা বসে থাকি, আমরা অনেক বড় ভুল করব। আমাদের যেতে হবে অনেক দূরে। আমরা কি পেয়েছি, কি হারিয়েছি, এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, ততই আমাদের মঙ্গল। দীপু মনি তার সাক্ষাৎকারে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এটা অনভিপ্রেত। আমাদের এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। কোনোকিছুতেই আমরা অতীতকে টেনে আনি, বিরোধী পক্ষের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করি, এটা ঠিক নয়। সবাইকে নিয়েই দেশ। এখন সীমানা নির্ধারিত হলো এটাই বড় কথা। কাউকে ছোট করে নিজেকে বড় করা যায় না। বড় হতে হয় কর্মে ও অভিজ্ঞতায়। মামলা করে আমরা ৮০ শতাংশ পেয়েছি এটার পুরোপুরিভাবে সঠিক নয়। সালিশি আদালতে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না। কেননা তিন ভাগে সমুদ্র সীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক আদালত ও আরব্রিটাল ট্রাইব্যুনাল বা সালিশি আদালত। ভারত প্রথম দুটি কোর্টের ব্যাপারে তার আপত্তি আগেই দেয়ায় তৃতীয় বিকল্প অর্থাৎ সালিশি আদালতে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নির্ধারণে কিন্তু সালিশি আদালতে যায়নি। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে এই বিবাদ মীমাংসিত হয়েছিল। তবে এটা সত্য, সালিশি আদালতে যাওয়ার পরও ভারত আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি। সুতরাং সমুদ্র সীমা নিয়ে আমরা আর কোনো বিতর্ক চাই না। এটা এখন মীমাংসিত বিষয়। Daily Manob Kontho 27.07.14
0 comments:
Post a Comment