সড়ক ব্যবস্থাপনা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল, যা তাদের করার কথা নয়। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, যদি ‘ইচ্ছা’ ও ‘আগ্রহ’ থাকে তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তারা দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে এক লাইনে গাড়ি চালাতে হয়, সড়কে শৃঙ্খলা কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়। ওরা রোদে পুড়ল, বৃষ্টিতে ভিজল। কিন্তু তারপর আমরা যা দেখলাম, তা আমাদের শুধু হতাশার মাঝেই ফেলে দেয়নি, বরং সমাজ কোন পথে যাচ্ছে, তার একটি ‘কালো অধ্যায়’ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম।
গুজব ছড়ানো হল। আওয়ামী লীগ প্রধানের কার্যালয় আক্রান্ত হল। পুলিশের পাশাপাশি হেলমেটধারীরা আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করল। তাদের রক্তাক্ত করল। আমরা দেখলাম ছোট ছোট বাচ্চাদের রক্তাক্ত ছবি, কারও মাথা ফেটে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। কারও চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কিশোরদের ‘সড়ক নিরাপত্তার’ আন্দোলন চলে গেল অন্য খাতে! সাংবাদিকরা আক্রান্ত হলেন।
বিদেশি এজেন্সিতে কর্মরত একজন ফটোসাংবাদিককে পেটানোর দৃশ্য ভাইরাল হয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাংবাদিক সমাজ প্রতিবাদী হল। তথ্যমন্ত্রী চিঠি লিখলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। এরই মাঝে খুব দ্রুততার সঙ্গে মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন পাস হল, যা এখন সংসদে যাবে এবং সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
কিশোরদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন বিএনপির একজন শীর্ষ নেতার অডিও রেকর্ড ফাঁস হল। যেখানে তিনি বিএনপির কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য। তার নামে মামলা হয়েছে, যদিও এখন অব্দি তিনি গ্রেফতার হননি। মামলা হয়েছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নামেও, যদিও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন এতে তিনি বিচলিত নন, কারণ তার নামে আরও ৮৪টি মামলা আছে! এক অভিনেত্রী গ্রেফতার হয়েছেন গুজব ছড়ানোর অভিযোগে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন আলোকচিত্রী গ্রেফতার হয়েছেন ‘বিদেশি মিডিয়ায় ভুল তথ্য দেয়ার’ জন্য!
সব মিলিয়ে কিশোরদের এ আন্দোলন প্রশংসিত এবং সব শ্রেণীর মানুষের সমর্থন পেলেও তা রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। প্রশ্ন এক. কিশোরদের এই আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়ে গেল? প্রশ্ন দুই. প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি ‘তৃতীয় পক্ষ’ ঢুকে গিয়েছিল ওই আন্দোলনে। এরা কারা? প্রশ্ন তিন. পুলিশের পাশে থেকে ‘হেলমেটধারীরা’ আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হল।
কিশোরদের আন্দোলন যে যৌক্তিক ছিল, তা একবাক্যে সবাই স্বীকার করেছেন। অনেক মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের অনেক সিনিয়র নেতা এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনে যখন ‘অন্য শক্তি’ জড়িয়ে যায়, তখন তা লক্ষ্যচ্যুত হয়। শেষদিকে এসে এ আন্দোলনে জড়িয়ে যায় কোটা আন্দোলনকারীরা। জড়িয়ে যায় বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে আন্দোলনটি ‘কক্ষচ্যুত’ হয়ে পড়ে।
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নানা গুজব ছড়ানো হয়েছে। একজন অভিনেত্রী গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি যেভাবে আবেগতাড়িত হয়ে ফেসবুক লাইভে এসেছিলেন, তা তার উচিত হয়নি। তার উচিত ছিল গুজব যাচাই-বাছাই করা। নিশ্চয়ই আমরা এ থেকে শিখব। আমাদের কারও এমন কিছু করা উচিত নয়, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের স্ব স্ব ক্যাম্পাসে ফিরে গেছে। তাদের আন্দোলন ‘ব্যর্থ’ হয়েছে এটা বলা যাবে না।
ওরা সমাজের ‘ক্ষতচিহ্ন’গুলো চিহ্নিত করেছে। আমাদের সবার উচিত হবে এই ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলা। কিন্তু তা কি আমরা পারব, কিংবা তা কি আমরা করব? ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই গত ৭ আগস্ট আমি দেখলাম ঢাকার সেই চিরচেনা চিত্র- সড়কে গাড়ি কম, কিন্তু কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে গাড়িগুলো চলছে, সেগুলোর ‘ফিটনেস’ আছে কিনা সন্দেহ! রংচটা, ভাঙা, ব্যাকলাইট না থাকা, সড়কে টেম্পো চালকদের দৌরাত্ম্য (এদের আদৌ কি লাইসেন্স আছে? ফিটনেস আছে?)- এ সবই ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।
শুনতে খারাপ শোনায়, বর্তমান ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এই সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ‘অর্থ’ একটি ফ্যাক্টর। এই অর্থের বিষয়টি যদি আমরা বন্ধ করতে না পারি, তাহলে এই সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি হবে না। ডিএমপি কমিশনার ‘সচিব’ হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ধন্যবাদ তাকে। কিন্তু নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি কী ভূমিকা রেখেছেন? মিরপুর এক নম্বর সড়কের (বাঙলা কলেজের আশপাশ এলাকা) একটা অংশ ‘দখল’ হয়ে গেছে। সেখানে এখন বাজার বসে।
ফুটপাতের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে এখন মুদি দোকান। তাহলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? মিরপুরের দৃষ্টান্ত দিলাম এ কারণে যে এই ‘দৃশ্য’ প্রায় সব বড় সড়কেই দেখা যায়। ডিএমপি কমিশনার সম্মানিত হবেন এবং সবার প্রশংসা পাবেন, যদি তিনি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, যদি সড়ক থেকে বাজার উঠিয়ে দেন, যদি ফুটপাত দখলমুক্ত করেন। বাচ্চারা যে আন্দোলন করল, ডিএমপির কমিশনার তার প্রশংসা করেছেন। তাকে এ জন্য সাধুবাদ জানাই।
শুধু অনুরোধ থাকবে, বাচ্চাদের এই আন্দোলনের প্রতি সম্মান জানিয়ে সড়ক দখলমুক্ত করুন- মানুষ আপনাকে স্মরণে রাখবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সড়ক দখলে প্রভাবশালীরা জড়িত। তাদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মডেল অনুসরণ করতে পারি আমরা। প্রয়োজনে সড়ক ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। সরকারের নীতিনির্ধাকরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। সড়কে সেনাবাহিনী থাকলে ক্ষতি কী?
প্রস্তাবিত সড়ক আইন আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ‘গরু-ছাগল চিহ্নিত করতে পারা’ চালকদের অষ্টম শ্রেণী পাস ও সহকারীর পঞ্চম শ্রেণী পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সমস্যা হবে অনেক : ১. ভুয়া অষ্টম শ্রেণীর সার্টিফিকেটে সয়লাব হয়ে যাবে দেশ। নীলক্ষেতের বাকুশা মার্কেট এখন পরিণত হবে ‘সার্টিফিকেট উৎপাদন’ কেন্দ্রে!
এটা আমরা নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে? এখানে একটা ‘ক্লজ’ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে এবং ভুল তথ্যের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২. সহকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এই সহকারীরাই পরে বাসচালক হয়। তাহলে? ওই পঞ্চম শ্রেণী ‘পাস’ নিয়েই তো সে বাসচালক হচ্ছে! এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রতিটি চালককে প্রশিক্ষণ নিতে হব। এর ব্যবস্থা করবেন মালিকরা।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করতে হবে প্রতিটি উপজেলায়। প্রতিটি উপজেলায় যে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সার্টিফিকেট ছাড়া কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। এ জন্য মালিক ও চালকের শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঢাকার বিআরটিএ নিয়ে অভিযোগ স্বয়ং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর। এলাকা ভিত্তিতে ঢাকায় বিআরটিএ’র আরও ন্যূনতম ১০টি শাখা গঠন করা প্রয়োজন। এটা যুগের চাহিদা। বিআরটিএ অফিসে গাড়ির ফিটনেস কার্যক্রম মেশিনের পরিবর্তে ব্যক্তিনির্ভর। যেখানে ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকে, সেখানে দুর্নীতি হবেই। সুতরাং মেশিন দিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে গাড়ির ফিটনেস নিশ্চিত করতে হবে।
প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে এর শাস্তির বিধান। বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত হলে বা প্রাণহানি ঘটলে এ সংক্রান্ত অপরাধ পেনাল কোডের ৩০২, ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এখানে একটা শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। কোনো দুর্ঘটনায় ‘অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে কিনা, তা কে নির্ধারণ করবে?
কোন প্রক্রিয়ায় তা নির্ধারিত হবে? একজন পুলিশ পরিদর্শক যখন এর ‘তদন্ত’ করবেন, তার ওপর কি আস্থা রাখা যাবে? তাই দুর্ঘটনায় হত্যাকাণ্ডে আদৌ কোনো চালককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া যাবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর (আগে ছিল ৩ বছর) করা হয়েছে। এটা যথেষ্ট নয়। চালকের লাইসেন্স বাতিলের কথাও বলা হয়নি।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মিম ও রাজিবের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। এই অর্থ নিহতদের পরিবারের সাহায্যে আসবে সন্দেহ নেই। কিন্তু যা উচিত ছিল তা হচ্ছে, এ টাকা মালিকদের দিতে বাধ্য করা। চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, চালকদের নিয়োগপত্র দেয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। কিন্তু আমরা কি পারব এগুলো নিশ্চিত করতে? রুটে গাড়িপ্রতি মালিকরা অর্থ নির্ধারণ করে দেন। এটা বন্ধ না হলে প্রতিযোগিতা থাকবেই।
একটি শক্তিশালী চক্র এই পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার অসহায়। যারা মালিক, তারাই যেন আবার শ্রমিক। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলে তারা। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী এর সঙ্গে জড়িত। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রভাবশালী ওই মন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে (যা আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল) তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। হয়তো আগামী দিনে প্রমাণিত হবে ওই মন্ত্রী সরকারের জন্য আশীর্বাদ নয়, ‘বোঝা’। মানুষ এটা বোঝে যে, একসঙ্গে মালিক ও শ্রমিক নেতা হওয়া যায় না।
শিশু-কিশোররা সমাজকে একটা বড় ‘ধাক্কা’ দিয়ে স্কুল-কলেজে ফিরে গেছে। কিন্তু এর রেশ তো থাকবেই। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শেষদিকে ‘ছিনতাই’ হয়ে গিয়েছে। এটাও একটা শিক্ষা। আন্দোলন ‘রক্তাক্ত’ হয়েছে- সুস্থ আন্দোলনের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ‘হত্যাকাণ্ডের’ পরও সমাজ জেগেছিল। মানুষ প্রতিবাদী হয়েছিল। তারপর? এই সমাজ কি ওই বাসচালককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পেরেছিল?
না, পারেনি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে ওই ঘাতক চালক হয়তো এখনও গাড়ি চালাচ্ছে। একটা মৃত্যু ঘটে, সাময়িকভাবে আমরা জেগে উঠি, তারপর ভুলে যাই। মিম ও রাজিবের ‘হত্যাকাণ্ডে’ ছোট ছোট বাচ্চারা জেগে উঠেছিল, সমাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পর এর মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব? প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহলের ‘নিয়ন্ত্রণ’ থেকে যদি সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের ‘মুক্ত’ করা না যায়, তাহলে এ ধরনের মৃত্যু আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করতে থাকব। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
পুনশ্চ : সম্ভবত কিছু কিশোর ‘অভিযুক্ত’ হয়ে জেলে আছে। অনুরোধ থাকবে তাদের দ্রুত জেল থেকে মুক্তি দেয়ার
Daily Jugantor
12.08.2018
it is a helpful blog
ReplyDelete