ইমরান খান একজন সাবেক ক্রিকেটার। এমনও শোনা যায়, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হয়, ওই মার্চে ইমরান খান ঢাকায় খেলতে এসেছিলেন। পরে গণহত্যা শুরু হলে তিনি করাচি চলে যান। এরপর দীর্ঘ সময় একজন পাকিস্তানি হিসেবে ওই গণহত্যার জন্য তিনি নিজে ক্ষমা চেয়েছেন—এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ রোধ করে তাঁকে মাফ করে দেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া যায় (The Express Tribune, November 24th, 2015)। পাকিস্তান সংসদে এ ঘটনার নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, যেখানে পিটিআইয়ের সদস্যরা (যাঁরা এখন সরকার গঠন করেছেন) উত্থাপিত (পিপিপি কর্তৃক) ওই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। তবে এটা ঠিক পাকিস্তানের রাজনীতিকরা ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইলেও পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি অংশ এই ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে ছিল। ২০০৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মবার্ষিকীতে ইসলামাবাদে জিওটিভির প্রধান নির্বাহী হামিদ মিরের নেতৃত্বে একটি সমাবেশ হয়েছিল। তারা একটি ব্যানার বহন করছিল। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘Dear Bangladeshi’s sorry for 71th genocide from Pakistan media and Lawyers’. পাকিস্তানে হামিদ মিরের বাবা ওয়ারিস মির একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক ছিলেন। তিনি এ গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছিলেন ওই সময়। কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজও নিন্দা জানিয়েছিলেন। ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। ওই সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণপত্র দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময় বাংলাদেশ হিনা রব্বানির কাছে দুটি দাবি উত্থাপন করে। ১. ১৯৭১ সালে যেসব পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচার করা; ২. পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া। সংগত কারণেই তাই প্রশ্নটি উঠেছে যে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন যে সরকার, সেই সরকার তাদের সেনাবাহিনীর কৃতকর্মের জন্য আদৌ ক্ষমা চাইবে কি না? এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য সেনাবাহিনী যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী সেনাবাহিনীকে যারা চালিয়েছে। স্পষ্টতই তিনি ওই সময়কার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু তার পরও তিনি ও তাঁর দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। এখন তাঁর জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমা চাওয়ার। কিন্তু যে সেনাবাহিনী তাঁকে পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেই সেনাবাহিনীর কৃতকর্মের জন্য তিনি ক্ষমা চাইবেন, এটা মনে হয় না।
কতগুলো বিষয় সামনে রেখে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক আটকে আছে। এগুলো হচ্ছে—১. পাকিস্তানের কাছে পাওনা টাকা আদায়; ২. বাংলাদেশে বসবাস করা পাকিস্তানি নাগরিকদের (বিহারি) পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারকে রাজি করানো; ৩. সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ না দেওয়া; ৪. সার্ককে শক্তিশালী করা। ২০১৬ সালে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ইসলামাবাদে। কিন্তু উরির সন্ত্রাসবাদী ঘটনার (২০১৬) সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত—এই অভিযোগে ভারত সার্ক সম্মেলন বয়কট করলে সার্কের প্রায় প্রতিটি দেশ ওই সম্মেলন বয়কট করেছিল। এরপর আর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্ক সম্মেলনে যোগ না দিলেও (২০১৬) ১৯৯৭ সালে তিনি ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পাকিস্তান সফর করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ঢাকা সফরের পর ফিরতি সফরে ১৯৯২ সালেও পাকিস্তানে গিয়েছিলেন বেগম জিয়া। বলা ভালো, ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৪) পাকিস্তানে গিয়েছিলেন (লাহোর) ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। গত ৪৪ বছরের যে ইতিহাস তাতে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক এত উষ্ণ ছিল না। বেশ কিছু সমস্যা আছে, যা গত ৪৪ বছরেও সমাধান হয়নি। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদের বিষয়টি এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে প্ল্যানিং কমিশন দুই হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা পাওনা দাবি করে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭১ সালের যুক্ত পাকিস্তানের সম্পত্তি, জনসংখ্যা, সংখ্যাসাম্য নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সম্পদের পরিমাণ হিসাব করে এই পাওনা টাকার দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু গত ৪৪ বছরে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পাকিস্তান বাংলাদেশ বিমানকে একটি পুরনো টাইপের বোয়িং বিমান দিয়েছিল, যা যুক্ত পাকিস্তানের সম্পদের তুলনায় ছিল নগণ্য। ১৯৮০ সালে এ ব্যাপারে একটি আন্ত মন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হলেও কমিটি সম্পদ ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় পাকিস্তান নীতিগতভাবে এ ব্যাপারে একটি কাউন্সিল গঠন করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু বেনজির ভুট্টোর উপদেষ্টাদের বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ওই অর্থের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো যে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলারের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী পাওনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংস্থাকে পরিশোধ করেছে।
বাংলাদেশে আটকে পড়া ওই সময়কার আড়াই লাখ পাকিস্তানি নাগরিকের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জটিলতা আজও দূর হয়নি। ওই সব পাকিস্তানির সংখ্যা আজ বেড়ে ২০ লাখ বা তার বেশি এখন। ওই সব নাগরিকের প্রায় সবাই পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায়। একসময় সৌদি আরবভিত্তিক ইসলামিক সাহায্য সংস্থা রাবিতা আল ইসলাম আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সে ব্যাপারেও অগ্রগতি হয়েছে কম। ১৯৯২ সালের জুন মাসে প্রত্যাবাসনের কিছু কাজ শুরু হয়েছিল এবং কিছু নাগরিক পাকিস্তানে চলেও গিয়েছিল। কিন্তু তা থেমে গেছে। এসব নাগরিক পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। প্রয়াত বেনজির ভুট্টো তাদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং পাকিস্তান তাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিল। পারভেজ মোশাররফ কিংবা পরবর্তী সময়ে নওয়াজ শরিফের শাসনামলে এ পাকিস্তানি নাগরিকদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ পাকিস্তানি নাগরিকরা, যারা ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের করাচিতে চলে গিয়েছিল (যারা মুহাজির হিসেবে সেখানে পরিচিত) তারা খোদ পাকিস্তানের জন্য একটি সমস্যা তৈরি করছে। মুহাজিরদের পক্ষ থেকে করাচি ও হায়দরাবাদ শহরকে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবিও উঠেছে! করাচি মূলত এদের নিয়ন্ত্রণে। এরা মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে কাজ করে। এমকিউএম এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ নির্বাচন বর্জন করেছে; অন্য ভাগ ইমরান খানের সরকারে যোগ দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে যারা আছে, পাকিস্তান তাদের ফেরত নেবে—এটা আমার মনে হয় না। তবে বাংলাদেশকে তাদের দাবি অব্যাহত রাখতে হবে।
এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে পাকিস্তান কোনো কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে সাহায্য ও সমর্থন করছে। লস্কর-ই-তৈয়বা ও এর নেতা হাফিজ সাইদ জাতিসংঘ কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত ও নিষিদ্ধ। কিন্তু হাফিজ সাইদ ও তাঁর দলকে এবার পাকিস্তানের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল; যদিও তারা ভালো করেনি এবং একটি আসনেও বিজয়ী হয়নি। কিন্তু হাফিজ সাইদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তটি নয়া সরকারের জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। পাকিস্তান যত দিন পর্যন্ত না নিষিদ্ধ ঘোষিত এসব সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকবে তত দিন পর্যন্ত সার্কভুক্ত দেশগুলোর আস্থা পাকিস্তান নিশ্চিত করতে পারবে না। ইমরান খানের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ, তিনি তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছেন। তাঁর শাসনামলে পাকিস্তানপন্থী তালেবানরা শক্তিশালী হবে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশ হচ্ছে পাকিস্তানের অষ্টম বাজার। বাংলাদেশ পাকিস্তানে রপ্তানি করে কম, আমদানি করে বেশি। ২০০৯-১০ সালে রপ্তানি-আমদানির রেশিও ছিল ১ঃ৪, অর্থাৎ চার গুণ বেশি পণ্য আমরা আমদানি করতাম (৭৭.৬৭ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি, ৩২৩.৭ মিলিয়ন ডলার আমদানি)। ২০১৫-১৬ সালে এই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ গুণে, অর্থাৎ ওই সময় রপ্তানি করা হয় ৪৭.০৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ আমদানি করা হয় ৫০৭.৪৬৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এক ‘নতুন পাকিস্তানের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইমরান খান। একজন ক্রিকেটার হিসেবে তিনি বাংলাদেশে জনপ্রিয়। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সেই ‘জনপ্রিয়তা’ ধরে রাখতে পারবেন কি না, তা একটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ক্ষমা চান, তাতে সম্পর্ক উন্নতি হতে পারে। সেনাবাহিনীর ‘চাপ’ উপেক্ষা করে তিনি এ কাজ করবেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
Daily Kalerkontho
19.08.2018
0 comments:
Post a Comment