পাকিস্তানের রাজনীতি বরাবরই নিয়ন্ত্রণ করেছে ভূস্বামী তথা জমিদাররা। পরে আশির দশকে বড় ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সিন্ধুর জমিদার আর পাঞ্জাবের ধনী ব্যবসায়ীদের হাতেই ছিল রাজনীতির চাবিকাঠি। পাকিস্তানি রাজনীতিতে এই পাঞ্জাবি প্রভাব সেখানে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।
পাঞ্জাবের রাজনীতিকরাই যে শুধু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তা নয়, এমনকি সেনাবাহিনীও নিয়ন্ত্রণ করত পাঞ্জাবি জেনারেলরা। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া পাঞ্জাবের জাট পরিবারের সন্তান হলেও তার জন্ম করাচিতে। একজন পাঞ্জাবি জেনারেলকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেনাপ্রধান হিসেবে বেছে নিলেও ওই সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বেই তিনি ক্ষমতা হারিয়েছেন।
সেনাবাহিনীর কর্পোরেট স্বার্থে তিনি আঘাত করেছিলেন, যা ছিল তার ক্ষমতা হারানোর অন্যতম কারণ। সেদিন পাঞ্জাবি জেনারেল বাজওয়া পাঞ্জাবি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পক্ষে দাঁড়াননি। পাঞ্জাবি প্রভাবাধীন রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর বাইরে ইমরান খান কি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন? ইমরান খান একজন পাঠান, কিন্তু তিনি কি পাঞ্জাবি স্বার্থ উপেক্ষা করতে পারবেন? এটা সত্য যে, পাঞ্জাবি এলিটদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।
অনেক পর্যবেক্ষকই বলার চেষ্টা করছেন যে, দুই পরিবারের (ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ) বাইরে সেনাবাহিনী চেয়েছে এমন একজন ব্যক্তিকে যার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আছে। ইমরান খান এ কারণেই ছিলেন তাদের পছন্দের তালিকায়। পর্দার অন্তরালে থেকেই তাকে সেনাবাহিনী তৈরি করেছিল।
এ কথা পাকিস্তানে বহুল প্রচলিত যে, এই ধর্মীয় গুরুরাই তাকে পরামর্শ দিয়েছিল নারী পীর বুশরা মানিকাকে বিয়ে করার। পাঁচ সন্তানের জননী বুশরা মানিকা ছিলেন তার ধর্মীয় উপদেষ্টা। এমন কথাও শোনা যায়, বুশরা নাকি ইমরান খানকে বলেছিলেন, তিনি যদি তাকে বিয়ে করেন তাহলে তিনি অর্থাৎ ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন! এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে বলা মুশকিল।
তবে চলতি বছরই তার দলের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছিল, ইমরান বুশরা মানিকাকে বিয়ে করেছেন। বুশরার বোরকা পরা ছবি (সম্ভবত পারিবারিক বিয়ে), যেখানে ইমরানও আছেন, এমন একটি ছবি ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যায়। কোনো কোনো সংবাদে আমি এমনটাও দেখেছি যে, ইমরানকে বিয়ে করার জন্য বুশরা মানিকা তার স্বামীকে তালাক পর্যন্ত দিয়েছিলেন!
ইমরান খানের জীবন কখনোই ধর্মসম্মত ছিল না। ১৯৯৫ সালে তিনি একজন ইহুদি ব্যবসায়ীর কন্যা জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেছিলেন। তখন ইমরানের বয়স ৪৩, আর জেমিমার মাত্র ২১। এ বিয়ে টেকেনি।
২০০৪ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি বিয়ে করেন ব্রিটিশ পাকিস্তানি সাংবাদিক রেহাম খানকে। এ বিয়েও টেনেকি। রেহাম সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন, যেখানে তিনি ইমরান খানের নানা অপকর্ম, বিশেষ করে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার একাধিক সন্তান রয়েছে বলেও জানান রেহাম। এরপর ইমরান যখন বুশরা মানিকাকে বিয়ে করেন, তখন নানা কথাবার্তা আকাশে-বাতাসে ভাসতে থাকে।
ইমরান খানের যে ব্যক্তি ইমেজ, তার সঙ্গে বুশরা মানিকার ব্যক্তি ইমেজ মেলে না। বুশরা একজন পীর, তার অসংখ্য মুরিদ আছে। সেই পীর ইমরানের স্ত্রী এটা কোনোভাবেই মেলে না। কিন্তু তার দল পিটিআই যখন এই বিয়ের কথা স্বীকার করে (ডন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮), তখন এ নিয়ে আর প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তার এই ‘ধর্মীয় জীবন’ কি তাকে ক্ষমতায় থাকার আদৌ কোনো নিশ্চয়তা দেয়? ‘ডিপ স্টেট’ (সেনাবাহিনী, আমলা ও বিচার বিভাগ) তাকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু কতদিনের জন্য?
অতীতে দেখা গেছে, বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ তিন তিনবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও ‘ডিপ স্টেটের’ ষড়যন্ত্রের কারণে তারা বারবার ক্ষমতা হারিয়েছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ‘ডিপ স্টেটের’ নিজেদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা বাহ্যত আজও বজায় রয়েছে। তবে স্ট্র্যাটেজিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে।
১৯৯৩ সালের ৬ অক্টোবর বেনজির ভুট্টো বিজয়ী হয়ে আবার সরকার গঠন করছিলেন বটে; কিন্তু ওই ‘ডিপ স্টেটই’ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে। মজার ব্যাপার হল, যে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক তিনি অপসারিত হয়েছিলেন, সেই ফারুক লেঘারি বেনজির ভুট্টো কর্তৃক মনোনীত হয়েছিলেন। পিপিপির টিকিটে তিনি সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। এখানে ‘ডিপ স্টেটের’ স্বার্থটাই ছিল বড়।
এরপর নওয়াজ শরিফ যখন আবার ক্ষমতাসীন হন (দ্বিতীয়বার ১৯৯৭), সেবারও ‘ডিপ স্টেট’ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে (১৯৯৯)। তবে পার্থক্য হল, সেনাবাহিনী জেনারেল পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে এবার সরাসরি ক্ষমতা দখল করে। তিনি দল গঠন করেন (মুসলিম লীগ-কয়েদে আজম)। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য দু’জন প্রধানমন্ত্রী (জাফরুল্লাহ খান জামালী ও চৌধুরী সুজাত হোসেন) দায়িত্ব পালন করলেও শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার টার্ম পূরণ করেন (২০০৭)। তিনিই প্রথম পাকিস্তানি, যিনি তার টার্ম পূরণ করতে পেরেছিলেন। কারণ তার পেছনে সেনাবাহিনী তথা ‘ডিপ স্টেটের’ সমর্থন ছিল।
নওয়াজ শরিফের মতো বেনজির ভুট্টোও ‘ডিপ স্টেটের’ সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি। তিনিও কখনও তার টার্ম পূরণ করতে পারেননি। ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে তিনি কথিত তালেবানদের আত্মঘাতী হামলায় মারা যান। এই মৃত্যুরহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে তার মৃত্যু তার দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর। কিন্তু নির্বাচিত দু’জন প্রধানমন্ত্রীই (ইউসুফ রাজা জিলানী ও রাজা পারভেজ আশরাফ) ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। ‘ডিপ স্টেটের’ আস্থা তারা নিশ্চিত করতে পারেননি।
আদালত অবমাননার অভিযোগে দু’জনই অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে আদালত কর্তৃক নওয়াজ শরিফ আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হন।
ধারণা করা হয়, ‘ডিপ স্টেট’ এবার নতুন স্ট্রাটেজি নিয়েছে। তারা এবার তাদের নিজেদের দল ও প্রার্থীকে বিজয়ী করে নিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনী তথা ‘ডিপ স্টেটের’ প্রার্থীই হচ্ছেন ইমরান খান। বিরোধী পক্ষ এবং সেই সঙ্গে দৈনিক সংবাদপত্র ডেইলি নিউজের প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে যে, নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে (নির্বাচনী আইন ৪৫ অনুযায়ী পোলিং অফিসারের স্বাক্ষর ছিল না শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে)।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নারীবাদে মায়ের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়। তার এই অতি রক্ষণশীল মনোভাব পাকিস্তানে তাকে বিতর্কিত করতে পারে। উপরন্তু পাকিস্তানের ধর্ম অবমাননাবিষয়ক আইনের তিনি সমর্থক। পিটিআই এ আইন সমর্থন করে।
তিনি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী এ কথা বিশ্বাস না করা পর্যন্ত কেউ নিজেকে মুসলমান দাবি করতে পারে না।’ তার এই বক্তব্য আহমদিয়া সম্প্রদায়কে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেবে এখন।
অভিযোগ আছে, তার সঙ্গে আফগান ও পাকিস্তানি তালেবানদের সখ্য রয়েছে, যে কারণে কোনো কোনো মহল থেকে তাকে ‘তালেবান খান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি পাকিস্তানে তালেবানদের কার্যালয় খোলারও দাবি জানিয়েছিলেন। তালেবানরা যখন নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফ জাইয়ের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তখন তিনি এর নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেছিলেন। কাজেই তার এই তালেবান সংশ্লিষ্টতা তাকে বহির্বিশ্বে আরও বিতর্কিত করবে এখন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন ড্রোন হামলার তিনি বরাবর বিরোধিতা করে আসছেন। তিনি গুলি করে ড্রোন নামানোর কথাও একবার বলেছিলেন। তার এ ধরনের বক্তব্যের কারণে ২০১২ সালে একবার কানাডা থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার সময় ইমরান খানকে বিমান থেকে নামিয়ে আটক করা হয়েছিল এবং ড্রোন হামলার ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। ফলে তার শাসনামলে এক ধরনের ‘অস্বস্তিতে’ থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এটা ঠিক, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে জনপ্রিয় হয়েছেন। কিন্তু অন্য দল থেকে যারা তার দলে যোগ দিয়েছেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ফলে তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এক ধরনের অবিশ্বাসের মুখে থাকবে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি অনেক আসনেই বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে নানা ত্র“টির কথা বলেছে বিরোধী দল। কিন্তু তা খুব একটা ধোপে টেকেনি।
তবে একটা আশার কথা হল, আগামী সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকবে। নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ, পিপলস পার্টি, আর মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল (মোট আসন ১১৯) জোট গঠনে রাজি হয়েছে। নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ এখন সংসদে বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করবেন। ইমরান খানকে এখন এই বিরোধীদলীয় জোটকে আস্থায় নিতে হবে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই
Daily Jugantor
18.08.2018
0 comments:
Post a Comment