২৩ নভেম্বর (২০১৭) বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং ১৯ ডিসেম্বর দেশ দুটি একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করার ৮ মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফিরে যায়নি। ফলে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা কি আদৌ তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবেন? এরই মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প দেখে গেছেন। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রেসিডেন্ট পিটার মাউরাও মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল সফর করে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু ফলাফল কী? মিয়ানমারের নেতাদের মানসিকতায় তো আদৌ কোনো পরিবর্তন আসেনি। ‘সময়ক্ষেপণ’ করার যে স্ট্র্যাটেজি তারা গ্রহণ করেছেন, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘চাপ’ থাকা সত্ত্বেও তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ৮ আগস্ট মিয়ানমার সফরে যান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী। সঙ্গে নিয়ে যান জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের ১৪ সদস্যকে। ১০ আগস্ট তাদের রাখাইন অঞ্চল হেলিকপ্টারযোগে ঘুরে দেখানো হয়। ১২ আগস্ট তারা জানান, ‘অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে এ সফরটি বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। কারণ আগের সফরে মিয়ানমার সরকার সবকিছু কেমন যেন লুকাতে চাইত; কিন্তু এবার সড়কপথে ও হেলিকপ্টারযোগে তারা সবকিছু দেখাতে কার্পণ্য করেনি।’ (মানবজমিন, ১৫ আগস্ট)। কিন্তু যা আমাকে একটু দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, তা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্রে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ শব্দটি বাদ দিতে ঢাকার সম্মতি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের সময় মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র অফিসে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেয়াও তিন্ত সুযির মধ্যকার বৈঠকে এ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় বলে রেডিও সাউথ এশিয়ার খবরে বলা হয়েছে। (শীর্ষ নিউজ, ১৪ আগস্ট)। রোহিঙ্গাদের আইডিতে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ শব্দের পরিবর্তে ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ শব্দটি বসাতে বাংলাদেশ রাজি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এতকিছু করেও কি মিয়ানমার রাজি হবে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে? উপরন্তু ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ নয় শব্দটি ব্যবহার না করায় আমরা কি পরোক্ষভাবে মিয়ানমার সরকারের বক্তব্যই সমর্থন করলাম না? মিয়ানমার তো প্রথম থেকেই বলে আসছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন! অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মিয়ানমার এর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি তারা পালন করেনি। এ নিয়ে দুই দেশের মাঝে একাধিক বৈঠক হলেও তা কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিছু রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নিয়ে গেছে; কিন্তু ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা, যারা নিবন্ধিত নয়, তারা বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে গিয়েছিল। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো আরও সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দিয়ে নিঃসন্দেহে মানবতার পরিচয় দিয়েছিল। বাংলাদেশের এই ভূমিকা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি অথবা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা জরুরি ছিল। বাংলাদেশ সেটা করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটিতে থেকে যেতে পারে! সুতরাং মিয়ানমার সরকারের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে, এটা আমরা বলতে পারি না। তাদের কোনো কার্যকলাপে তা প্রমাণিত হয় না। সেজন্য একটা আশঙ্কা এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে যে, মিয়ানমার তথাকথিত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে কালক্ষেপণ করছে। এই কালক্ষেপণের স্ট্র্যাটেজি তাদের অনেক পুরানো। এবারও এমনটি হতে যাচ্ছে। ২৩ জানুয়ারি একটি তারিখ নির্ধারিত হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখন অবধি শুরু হয়নি। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর ১২ মাস পার হয়েছে। এই ১২ মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আন্তর্জাতিক ভিআইপি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তুরস্কের ফার্স্টলেডি, পোপ ফ্যান্সিস, মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি দলসহ একাধিক ব্রিটিশ মন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন, রোহিঙ্গারা ফিরে যাবেন। আন্তর্জাতিক কমিউনিটির চাপে শেষ অব্দি গেল এপ্রিলে একজন মিয়ানমারের মন্ত্রীও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। আর এরই মাঝে ঘুরে গেছেন তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারা ঢাকায় এসে রোহিঙ্গা প্রশ্নে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আইআরসি’র প্রেসিডেন্ট যখন বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরার কোনো পরিবেশ নেই, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, মিয়ানমারের আসল উদ্দেশ্যটা কী। তারা কালক্ষেপণ করছে এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে বিভ্রান্ত করছে। এখন জাতিসংঘের মহাসচিব বলছেন, ‘চাপ’ প্রয়োগের কথা। কিন্তু এই ‘চাপ’ প্রয়োগ কীভাবে হবে? নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না। কেননা চীন ও রাশিয়ার সমর্থন তাতে পাওয়া যাবে না। উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা যাবে না। বাস্তবতা এটাই। কিন্তু আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কনসার্নকে আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে শরণার্থী সংক্রান্ত একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, যা ‘বালি প্রসেস’ নামে পরিচিত। ৪৮ দেশের মন্ত্রীদের নিয়ে এ ‘বালি প্রসেস’ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আরও সহায়তা ও সুরক্ষা প্রদানে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের আহ্বানে কি আদৌ কোনো কাজ হবে? মিয়ানমার সরকার এ ধরনের আহ্বানকে আদৌ কোনো গুরুত্ব দেয় না। মিয়ানমার যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগকে কোনো গুরুত্বই দেয় না, তার একটি বড় প্রমাণ গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের যে উদ্যোগ জনৈক কৌঁসুলি নিয়েছিলেন, মিয়ানমার তা খারিজ করে দিয়েছে। আইসিসির কৌঁসুলি ফাতোও বেনসুদার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসি মিয়ানমার ও একই সঙ্গে বাংলাদেশের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল। আইসিসি ২৭ জুলাই মিয়ানমারকে জবাব দেওয়ার জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ তার জবাব দিলেও মিয়ানমার আইসিসিকে জানিয়ে দিয়েছিল, তারা জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। এ থেকেই বোঝা যায়, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে কোনো গুরুত্বই দেয় না।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ খুব শক্ত অবস্থানে গিয়েছেÑ এটা আমার মনে হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পরবর্তী কার্যক্রম বলে দেয়, বাংলাদেশ একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল! কিন্তু মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার কোনো কৌশল অবলম্বন করেনি। জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হয়েছে। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান একটি ঘৃণিত অপরাধ। আন্তর্জাতিক আইনে তা দ-নীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। এরই মধ্যে বসনিয়া-হারজেগোভিনা, কঙ্গো, লাইবেরিয়া কিংবা রুয়ান্ডাতে যারা জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানে জড়িত ছিলেন, সেসব সেনা কর্মকর্তার বিচার হয়েছে। রায়ও দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিক সেনা কর্মকর্তাকে মিয়ানমারে গণহত্যার জন্য চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ এদের বিচারের দাবি করতে পারত। তাহলে অন্তত মিয়ানমার সরকার একটা ‘চাপ’ এর মুখে থাকত। কিন্তু বাংলাদেশ তা করেনি। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে একটি ‘সফট ডিপ্লোম্যাসি’র আশ্রয় নিয়েছে। ২৫ আগস্টে (২০১৭) রোহিঙ্গা গণহত্যা ও রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী, বিশেষ করে চীন ও ভারতের ‘সাহায্য’ নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করার ব্যাপারে বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শেষ অবধি চীন নিজ উদ্যোগে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল এবং সেই প্রস্তাব অনুসরণ করেই মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু এ আলোচনা আদৌ কোনো ফল দেবে না। হেলিকপ্টারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাখাইনে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করা। এটি তারা খুব সাফল্যের সঙ্গেই করতে পেরেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগস্টের (২০১৮) মিয়ানমার সফরের সময় ‘দুই পক্ষ মত দিয়েছে, প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরু হওয়া উচিত। প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক।’ মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের অফিস থেকে এ তথ্যটি আমরা জানতে পেরেছি। (কালের কণ্ঠ, ১১ আগস্ট)। পাঠক লক্ষ করুন, ‘মিয়ানমারের বক্তব্যে বলা হয়েছে, প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক।’ প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গারা কি স্বেচ্ছায় যাবেন? তাদের কি নিরাপত্তা সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে? রোহিঙ্গারা যেখানে তাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না, সেখানে তারা ফিরে যাবেন না। উপরন্তু তাদের নিরাপত্তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে রাজি হয়েছেন যে, রোহিঙ্গাদের আইডিতে মিয়ানমারের নাগরিকের পরিবর্তে ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ লিখতে হবে। রোহিঙ্গারা কি এটা লিখতে রাজি হবে? আমাদের ‘ডিপ্লোম্যাসি’ খুব শক্ত নয়। আমরা মিয়ানমারের সব কথাতেই রাজি হয়েছি। কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হবে না। নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে বিলম্ব করবে। আমরা চাই, মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত নিক। এটা যত দ্রুত করা সম্ভব, তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গল।
Daily Alokito Bangladesh
19.08.2018
0 comments:
Post a Comment