প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে সদ্য গঠিত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপির যোগদান যে প্রশ্নটিকে
সামনে নিয়ে এসেছে, তা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায় যোগদানের মধ্য দিয়ে বিএনপির
প্রাপ্তি কী? বিএনপি কী পেল আসলে? রাজনৈতিক অঙ্কে বিএনপি কি বিজয়ী হলো,
নাকি একটি ঝুঁকি নিল? এই মুহূর্তে মন্তব্য করা বোধহয় সঠিক হবে না, কিন্তু
একটি মূল্যায়ন অবশ্যই করা যায়। প্রথমত, বিএনপি আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি জোটে
নিজেদের জড়িত করতে পেরেছে। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট বিএনপির জন্য। এই জোট
শেষ পর্যন্ত যদি একটি নির্বাচনী জোট হয়, তাহলেও বিএনপির লাভ। সিট বণ্টন
নিয়ে আলোচনা কোন পর্যায়ে যাবে, বিএনপি কতটুকু ছাড় দেবে, সে প্রশ্ন ভিন্ন।
এক্ষেত্রে বিএনপি একটি ‘মালয়েশিয়ান ফর্মুলা’ নিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার
নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটি সমঝোতায় যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া
বিএনপিকে একটি সুযোগ করে দিল একাদশতম জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার। এর
আগে বিএনপির নেতৃবৃন্দ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন বেগম
জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। সব দলের অংশগ্রহণ যখন সবাই
চাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য জোটের ব্যানারে বিএনপি নির্বাচনে অংশ
নেওয়ারও সুযোগ পেল। সরকারের জন্যও এটা ভালো। কিন্তু জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া
নিয়ে মন্ত্রীদের অশালীন মন্তব্যে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তৃতীয়ত,
বেগম জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া কোনো সুনির্দিষ্ট দাবি
উত্থাপন করেনি। তাদের পাঁচ দফায় বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নেই। ঐক্য
প্রক্রিয়ার নেতারা মনে করেন বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়টি বিএনপির। বিএনপি
দলীয়ভাবে বেগম জিয়ার মুক্তি দাবি করতে পারে, তাতে তাদের আপত্তি নেই। তবে
ঐক্য প্রক্রিয়া সবার মুক্তি দাবি করেছে। বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিটি সরাসরি
পাঁচ দফায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায়, স্ট্র্যাটেজিক্যালি এটা বিএনপির একরকম
ব্যর্থতা! চতুর্থত, ড. কামাল হোসেন বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে
মন্তব্যটি করেছিলেন, তাতে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেছিলেন,
বর্তমান সরকারের অধীনে (অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে রেখে) নির্বাচনে যেতে নীতিগতভাবে তার আপত্তি নেই। পরে তিনি এর একটি
ব্যাখ্যা দেন। তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, তারা যে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন
করেছেন, সরকার তা মেনে নিলে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে তার
আপত্তি নেই। তবে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা
করেননি, এটাও তিনি জানিয়েছেন। পঞ্চমত, ড. কামাল ও বি চৌধুরী স্পষ্ট করেই
জানিয়েছেন, জামায়াতকে মাইনাস না করলে এই ঐক্য হবে না। বিএনপির কাছে
অগ্রাধিকার কী এখন? জামায়াত নাকি ঐক্য প্রক্রিয়া? জামায়াতের কিছু ‘ভোট
ব্যাংক’ রয়েছে। তাদের প্রশিক্ষিত একটি কর্মীবাহিনীও রয়েছে। অন্যদিকে
গণফোরাম, জেএসডি, বিকল্প ধারা ‘কাগুজে সংগঠন’, এদের কোনো ‘ভোট ব্যাংক’ নেই।
জামায়াতের বিরুদ্ধে একটা জনমত রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলে জামায়াত
এখনো আছে, যদিও জামায়াতের নিবন্ধন নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের
সম্পর্ক কোন পর্যায়ে যায়, তা দেখার বিষয়। বিএনপির জন্য বিষয়টি অত সহজ নয়।
জামায়াতকে বাদ দিয়ে ঐক্য প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত বিকল্পধারা, গণফোরাম,
জেএসডির সঙ্গে ‘নির্বাচনী ঐক্য’ করে বিএনপি কতটুকু লাভবান হবে, সেটাও
বিবেচনায় নিতে হবে। ষষ্ঠত, বিএনপির সঙ্গে ২০-দলীয় জোটে আছে এমন কয়েকটি দলের
(কল্যাণ পার্টি, এলডিপি, ন্যাপ) ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কিছুটা
‘রিজার্ভেশন’ আছে বলেই মনে হয়। ২২ সেপ্টেম্বরের ‘নাগরিক সমাবেশে’ এই তিন
দলের কোনো প্রতিনিধিই উপস্থিত ছিলেন না। এদের নেতিবাচক মনোভাবও সংবাদপত্রে
প্রকাশিত হয়েছে। এই ‘ঘটনা’ প্রমাণ করে ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে ২০-দলে মিশ্র
প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এলডিপি, কল্যাণ পার্টি যদি ২০-দল থেকে বের
হয়ে যায়, আমি অবাক হব না। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় কর্নেল (অব.) অলি
আহমদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বাজারে একটি ‘গুজব’ রয়েছে। অতীতেও বিএনপির সঙ্গে
এলডিপির দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এখন আবারো এলডিপি এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে
যাচ্ছে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। সপ্তমত, বিএনপি ঐক্য প্রক্রিয়ায় আছে।
কিন্তু মূল নেতা বিএনপির কেউ নন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিকল্পধারার মাহী
বি চৌধুরীর এক ধরনের ‘অ্যালার্জি’ রয়েছে বিএনপিকে নিয়ে। তিনি ও তার নানান
বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি বিএনপিকে বাদ
দিয়েই যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে গণফোরামের ঐক্য চান! বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষেত্রে
সবারই কিছু কিছু নমনীয় হওয়া উচিত। বিএনপি একটি দুর্বল অবস্থানে আছে, সন্দেহ
নেই তাতে। কিন্তু দেশের জনগোষ্ঠীর ৩২ থেকে ৩৫ ভাগের সমর্থন রয়েছে বিএনপির
প্রতি। বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো বৃহৎ ঐক্যই কাজ করবে না। এক্ষেত্রে মাহী বি
চৌধুরী যত কম কথা বলবেন, ততই বৃহৎ ঐক্যের জন্য তা মঙ্গল। অষ্টমত, ঐক্য
প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে যে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে দুটি
দাবি খুব গুরুত্বপূর্ণ- একটি হচ্ছে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া ও একটি
নিরপেক্ষ সরকার। যদিও এর বিস্তারিত রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়নি। এটা সত্য
যে, এটা বিএনপিরও দাবি ছিল। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে,
সরকার সংবিধানের বাইরে যাবে না। এক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেন, যিনি সংবিধান
প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তিনি এর একটি ব্যাখ্যা দিতে পারতেন।
সংবিধানের আলোকে কীভাবে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার একটি
ফর্মুলা তিনি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা দেননি। এমনকি এই দাবি বিএনপির
হলেও, বিএনপির পক্ষ থেকে কখনো নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়নি।
সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রশ্নে সাংবিধানিক ব্যাখ্যাটা এ রকম- রাষ্ট্রপতি পূর্বে
ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হইলে
সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ (৭২-৩)। দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২০১৪
সালের ২৯ জানুয়ারি। এর অর্থ ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সংবিধানমতে এ
সংসদ বলবৎ থাকবে। এক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে।
তিনি সংসদ তখনই ভেঙে দেবেন, যখন এ ব্যাপারে সব দলের মধ্যে একটি ‘সমঝোতা’
হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই ‘সমঝোতা’ সম্ভব। অথবা বিকল্প হিসেবে
আন্দোলনের মুখে সরকারকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করাও সম্ভব। কিন্তু বিএনপি
সেই আন্দোলন করতে পারেনি। এখন ড. কামাল হোসেনদের সঙ্গে নিয়ে ঐক্য
প্রক্রিয়া ওই আন্দোলন করতে পারবে বলেও মনে হয় না। সরকারকে বাধ্য করা না
গেলে সরকার সংসদ ভেঙে দেবে না। আর নির্বাচনকালীন সরকার? সংবিধানের ৫৭(৩)
ধারায় বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা
পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এবং অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই
অযোগ্য করিবে না।’ এর অর্থ কী? ডিসেম্বরে (২০১৮) নির্বাচন হবে। আর
জানুয়ারিতে সরকার গঠিত হবে (২০১৯)। এই সময়সীমা পর্যন্ত শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাচ্ছেন! সুতরাং সরকারের মন্ত্রীরা যে বলছেন শেখ
হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে, এর একটি সাংবিধানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। এই
সরকারের অধীনেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। তারা বুঝে শুনেই এই কাজটি
করেছেন। বিএনপি বা ঐক্য প্রক্রিয়া যদি কোনো দিন সরকার গঠন করতে পারে, তারাও
সংবিধান সংশোধন করতে পারবে! তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার। একটি
নির্বাচনকালীন সরকারের যে দাবি উত্থাপিত হয়েছে, তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব,
যদি প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও ইচ্ছা থাকে। কেননা, সংবিধানের ৫৬(১)-এ বলা আছে,
‘প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী,
প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকিবেন।’ এখানে ৫৬(২) ধারায় এক দশমাংশ সদস্য
(মন্ত্রিসভার) সংসদের বাইরে থেকে নেওয়ার বিধান রয়েছে। এই ধারা প্রয়োগ করে
প্রধানমন্ত্রী ন্যূনতম দুই থেকে তিনজন সদস্যকে (বিরোধী দল, যারা সংসদে নেই)
মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এটা পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার
ওপর নির্ভর করে। বিএনপি কিংবা ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে একটা ফর্মুলা
দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু তারা তা দেয়নি। হতে পারে, বিতর্ক হতে পারে এই
বিবেচনায় এ ধরনের প্রস্তাব তারা দেয়নি। এখন এ ধরনের প্রস্তাব না থাকায়,
সরকার যে সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে, তা আমরা অস্বীকার করি কীভাবে?
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া মিডিয়ায় কিছুটা হলেও
আলোড়ন তুলেছে। বাস্তব ক্ষেত্রে কিছু ‘কাগুজে সংগঠন’ নিয়ে বিএনপির প্রাপ্তি
খুব বেশি নয়। উপরন্তু বিএনপিকে নিয়ে ড. কামাল হোসেন যতটা না উৎকণ্ঠিত, তার
চাইতে বেশি উৎকণ্ঠিত বিকল্পধারা, বিশেষ করে মাহী বি চৌধুরী নিজে। বিএনপি
‘দুর্বল অবস্থানে’ থাকায়, তাদের ‘চাপের মুখে’ রেখে বড় ঐক্য গড়ে উঠতে পারে
না। বিকল্পধারা কিংবা গণফোরামের মতো সংগঠনের কয়টি নির্বাচনী এলাকা রয়েছে,
কিংবা দলীয়ভাবে তারা ক’জনকে প্রার্থী করতে পারবে- তা আমরা সবাই মোটামুটি
জ্ঞাত। সুতরাং বিকল্পধারা যখন ‘বড় জোটে’ কার্যক্রম শুরু করার আগেই নানা
ধরনের শর্ত জুড়ে দেয়, তখন ঐক্য প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়
বৈকি!
বিএনপি একটি ‘সঙ্কটে’ আছে, সন্দেহ নেই
তাতে। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানের অবর্তমানে বিএনপির কার্যক্রমে কিছুটা
হলেও শ্লথগতি এসেছে। কিন্তু কর্মীদের মধ্যে ঐক্য এখনো আছে। গত প্রায় দশ
বছরে বিএনপির খুব কম সংখ্যক কর্মীই দল ত্যাগ করেছেন। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে
কর্মীরা এখনো দলের প্রতি আস্থাশীল। তবে বিএনপির নেতৃত্বে আরো ‘নতুন মুখ’
আনা প্রয়োজন। যেসব নেতৃত্ব গত দশ বছরে রাস্তায় আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়েছেন,
তাদের উপদেষ্টা পরিষদে পাঠিয়ে নেতৃত্বের গুণাবলিতে প্রমাণিত তরুণ
নেতৃত্বকে স্থায়ী পরিষদে পদোন্নতি দেওয়া প্রয়োজন। বিএনপি নির্বাচনে যাক,
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে তারা নির্বাচনে অংশ নিক। একটি সুষ্ঠু ও
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। আর এ জন্য সরকারের দায়িত্ব যেমনি বেশি, ঠিক তেমনি
প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিরও দায় আছে। একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু
নির্বাচনই পারে দেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে।
Daily Bangladesher Khobor
02.10.2018
0 comments:
Post a Comment