দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়ছে। গেল সপ্তাহে ভারত বেশ কয়েকটি
প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। একই সঙ্গে অনেকটা নীরবে প্রতিরক্ষা
বাহিনী আধুনিকীকরণও করে ফেলেছে ভারত। এসব কারণে পাকিস্তানের নয়া সরকার যে
এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একটি
বিরূপ মন্তব্যও করেছেন। পাকিস্তানের নয়া প্রেসিডেন্ট আলফি মন্তব্য করেছেন
এভাবে যে, ভারতের ‘আক্রমণাত্মক আচরণ’ দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক স্থিতিশীলতা
নষ্ট করছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, কিছু দেশ ভারতকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে
দিচ্ছে। ভারত ফ্রান্সের সঙ্গে রাফাল চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পৃথিবীর সেরা
যুদ্ধবিমানগুলোর অন্যতম হচ্ছে এ রাফাল। ভারত রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করছে। মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানগুলোর আধুনিকীকরণের কাজও
সেরে ফেলেছে ভারত। ফলে পাকিস্তান যে এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকবে, তা বলাই
বাহুল্য। শুধু পাকিস্তান কেন, চীনও ভারতের সামরিক সজ্জাকে ভালো চোখে দেখছে
না। সম্প্রতি মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীনাপন্থি হিসেবে পরিচিত
ইয়ামিন হেরে গেছেন। এর পেছনে ভারতের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এটা
চীনের জন্য একটা ‘সেটব্যাক’। মালদ্বীপে ভারত ও চীনের স্বার্থ রয়েছে। মালেতে
একটি বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য ভারতের একটি কোম্পানি কন্ট্র্রাক্ট
পেয়েছিল; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন সে চুক্তিটি বাতিল করে একটি চীনা
কোম্পানিকে দিয়েছিলেন। চীন সেখানে বিশাল বিনিয়োগ করছে। ডিসেম্বরে (২০১৭)
চীনের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। চীন
যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে, সেখানে মালদ্বীপের স্ট্র্যাটেজিক
অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে চীন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চায়। এতে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়টি সমুদ্রবন্দর ‘কানেক্টেড’ থাকবে এবং চীন তা
তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, পাকিস্তানের
গাওদারে (বেলুচিস্তান) ও শ্রীলঙ্কার হামবানতোতায় চীন গভীর সমুদ্রবন্দর
নির্মাণ করেছে। এর ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা চীনের হাতে। ভারত এ বিষয়টিকে
তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলেই মনে করে। হামবানতোতায় চীনা
সাবমেরিনের উপস্থিতির রেশ ধরে শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তন পর্যন্ত হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘চীনঘেঁষা’ নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে পরাজিত
(২০১৬) হয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি রাজাপাকসে আবারও পাদপ্রদীপের আলোতে
এসেছেন। তিনি আগেই সংসদ নির্বাচন দাবি করেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট
সিরিসেনাকে ভারতঘেঁষা বলে মনে করা হয়। সিরিসেনা শ্রীলঙ্কায় চীনা প্রভাব
কমাতে চাচ্ছেন। ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তারা এ অঞ্চলে
চীনের উপস্থিতি ‘সহ্য’ করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (২০১৫) এ
মেসেজটিই তারা দিয়েছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও
মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও এ দুটি দেশে সামরিক ঘাঁটি
স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে এ
‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার
প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ভারত প্রাচীনকালে
তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি
করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা
বিকাশে ভারতীয় প-িতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে
দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী
ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌবাণিজ্যের যে
প্রাচীন রুট তাতে দেখা যায়Ñ ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিশর, আফ্রিকার
মাদাগাস্কার, আবার অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মল্লিকা
প্রণালি), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি
সরকার এ ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা
তথা সুতি এ সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। একদিকে চীনা নেতা শি জিন
পিং তার ‘সিল্ক রুট’-এর ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের
কর্তৃত্ব যেমন প্রতিষ্ঠা করতে চান, এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তার পুরোনো
‘কটন রুট’-এর ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হয়েছে সেখানেই।
বাণিজ্যনির্ভর এ দ্বন্দ্ব শেষ অবধি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার
নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরও বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী
শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয়, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তিÑ চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে, যা চীনের স্বার্থের বিরোধী। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃক প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এ ‘সিল্ক রোড’টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ ‘সিল্ক রোড’-এর মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য, সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথাও আমরা জানি, যা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, মালয়েশিয়ায় এসেছিল। পরে তারা স্থায়ী হয়ে যায়, এমন কথাও বলা হয়Ñ ব্রুনাইয়ে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে চীনাদের অবদান ছিল বেশি। ২০১২ সালে আমি তুরস্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে চীনাদের এ সিল্ক রুটের আগ্রহের কথা জানতে পারি। এ সিল্ক রুটের যে অংশ তুরস্কে পড়েছে, আমি সে পথ ধরেও বেশ কিছুটা পাড়ি দিয়েছি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তার প্রথম সফরে কাজাখস্তানে গিয়ে ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন। এর পরের মাসে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে তিনি দ্বিতীয় ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথাও বলেন। এতে একটা ধারণার জন্ম হয় যে, চীন শুধু মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। ইরানে যে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেক পাঠকই জানেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেক পর্যবেক্ষকই করেন, তা হচ্ছে চীনের এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর নীতি ভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক। কেননা, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার নিজস্ব মডেলে ‘ভারতীয় মনরো ডকট্রিন’-এর কাঠামো গড়ে তুলছে। অর্থনৈতিক প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। ‘ছায়াযুদ্ধ’-এর ধারণাটা তাই এখান থেকেই তৈরি হয়েছে। এ ‘ছায়াযুদ্ধ’ ও যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সিরিয়ায় পাঠকরা চতুর্ভুজ উদ্যোগ বা ছঁধফৎরষধঃবৎধষ ওহরঃরধঃরাব-এর কথা স্মরণ করতে পারেন। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এ উদ্যোগটি নিয়েছে। বলা হচ্ছে, এ উদ্যোগ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর বিকল্প। এর অর্থ হচ্ছে, চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’-এর জন্ম হচ্ছে, আর এতে যোগ হচ্ছে চার শক্তি। দোকলামের ঘটনা (২০১৭) নিশ্চয়ই পাঠক স্মরণ করতে পারেন, যেখানে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনী একটি ‘যুদ্ধ’-এর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। একই সঙ্গে অরুণাচল, অন্যদিকে কাশ্মীরÑ দুটি বিষয় নিয়েও দুই দেশের মাঝে দ্বন্দ্ব আছে। মাঝেমধ্যে চীন অরুণাচল নিয়ে তার দাবি উত্থাপন করলেও সেখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে। বিতর্কিত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সড়ক পথটি চলে গেছে, যা বেলুচিন্তানের গাওদারে গিয়ে শেষ হয়েছে। এ সড়কপথের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। এ দুটি বিষয় বাদ রেখেই গেল বছর দোকলাম উপত্যকার কর্তৃত্ব নিয়ে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকুকÑ আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি। যদি দোকলাম নিয়ে উত্তেজনা অব্যাহত থাকে, তাতে সুবিধা পাবে তৃতীয় পক্ষ। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে ভারতের অনুদান তহবিল থেকে বার্ষিক বাজেটের বাইরে আরও ২০ হাজার কোটি রুপি দাবি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। শুধু তা-ই নয়, আগামী ৫ বছর প্রতিরক্ষা বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার কোটি রুপি করারও আবেদন করেছে মন্ত্রণালয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ২ লাখ ৭৪ হাজার ১১৩ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬২ শতাংশ। ভারত নয়াদিল্লি ও মুম্বাইয়ে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করেই বোঝা যায়, নয়াদিল্লির ভয়টা আসলে পাকিস্তানকে নিয়ে নয়, বরং চীনকে নিয়েই। ভারত এখন চুক্তির ফলে নিজেরাই এফ-১৬ বিমান তৈরি করবে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও তারা কিনছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটা তো ঠিক, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ‘মিত্র’ হিসেবে চাইছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে পাশের দেশগুলোর যে বিবাদ, তাতে চীনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি ভারত। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত দোকলামে দুইপক্ষকে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এখানে মেসেজটি স্পষ্ট। ভারত ও চীন কেউ কাউকে ‘ছাড়’ দিতে চায় না। উভয় দেশই দক্ষিণ এশিয়ার স্থানীয় সমস্যায় সুবিধা নিতে চায়। এখানে বলতেই হয়, চীনের অবস্থান কিছুটা শক্তিশালী। পাকিস্তানের পর মালদ্বীপে বড় স্বার্থ ছিল চীনের। এখন মালদ্বীপে চীনের স্বার্থ ক্ষুণœ হতে চলেছে। কিন্তু ভারতপন্থি একজন প্রেসিডেন্ট সেখানে দায়িত্ব নিলেও চীনের যে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, সে ব্যাপারে কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে হত্যা করতে চাচ্ছে! এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক না কেন, মালদ্বীপে সরকার পরিবর্তনের পর ভারতের ভূমিকা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো পাকিস্তানের উদ্বেগ। ভারতের সমরসজ্জা এখন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেয় কি নাÑ সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Alokito Bangladesh
22.10.2018
বলা হয়, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তিÑ চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে, যা চীনের স্বার্থের বিরোধী। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃক প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এ ‘সিল্ক রোড’টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ ‘সিল্ক রোড’-এর মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য, সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথাও আমরা জানি, যা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, মালয়েশিয়ায় এসেছিল। পরে তারা স্থায়ী হয়ে যায়, এমন কথাও বলা হয়Ñ ব্রুনাইয়ে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে চীনাদের অবদান ছিল বেশি। ২০১২ সালে আমি তুরস্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে চীনাদের এ সিল্ক রুটের আগ্রহের কথা জানতে পারি। এ সিল্ক রুটের যে অংশ তুরস্কে পড়েছে, আমি সে পথ ধরেও বেশ কিছুটা পাড়ি দিয়েছি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তার প্রথম সফরে কাজাখস্তানে গিয়ে ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন। এর পরের মাসে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে তিনি দ্বিতীয় ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথাও বলেন। এতে একটা ধারণার জন্ম হয় যে, চীন শুধু মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। ইরানে যে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেক পাঠকই জানেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেক পর্যবেক্ষকই করেন, তা হচ্ছে চীনের এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর নীতি ভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক। কেননা, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার নিজস্ব মডেলে ‘ভারতীয় মনরো ডকট্রিন’-এর কাঠামো গড়ে তুলছে। অর্থনৈতিক প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। ‘ছায়াযুদ্ধ’-এর ধারণাটা তাই এখান থেকেই তৈরি হয়েছে। এ ‘ছায়াযুদ্ধ’ ও যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সিরিয়ায় পাঠকরা চতুর্ভুজ উদ্যোগ বা ছঁধফৎরষধঃবৎধষ ওহরঃরধঃরাব-এর কথা স্মরণ করতে পারেন। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এ উদ্যোগটি নিয়েছে। বলা হচ্ছে, এ উদ্যোগ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর বিকল্প। এর অর্থ হচ্ছে, চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’-এর জন্ম হচ্ছে, আর এতে যোগ হচ্ছে চার শক্তি। দোকলামের ঘটনা (২০১৭) নিশ্চয়ই পাঠক স্মরণ করতে পারেন, যেখানে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনী একটি ‘যুদ্ধ’-এর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। একই সঙ্গে অরুণাচল, অন্যদিকে কাশ্মীরÑ দুটি বিষয় নিয়েও দুই দেশের মাঝে দ্বন্দ্ব আছে। মাঝেমধ্যে চীন অরুণাচল নিয়ে তার দাবি উত্থাপন করলেও সেখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে। বিতর্কিত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সড়ক পথটি চলে গেছে, যা বেলুচিন্তানের গাওদারে গিয়ে শেষ হয়েছে। এ সড়কপথের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। এ দুটি বিষয় বাদ রেখেই গেল বছর দোকলাম উপত্যকার কর্তৃত্ব নিয়ে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকুকÑ আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি। যদি দোকলাম নিয়ে উত্তেজনা অব্যাহত থাকে, তাতে সুবিধা পাবে তৃতীয় পক্ষ। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে ভারতের অনুদান তহবিল থেকে বার্ষিক বাজেটের বাইরে আরও ২০ হাজার কোটি রুপি দাবি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। শুধু তা-ই নয়, আগামী ৫ বছর প্রতিরক্ষা বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার কোটি রুপি করারও আবেদন করেছে মন্ত্রণালয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ২ লাখ ৭৪ হাজার ১১৩ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬২ শতাংশ। ভারত নয়াদিল্লি ও মুম্বাইয়ে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করেই বোঝা যায়, নয়াদিল্লির ভয়টা আসলে পাকিস্তানকে নিয়ে নয়, বরং চীনকে নিয়েই। ভারত এখন চুক্তির ফলে নিজেরাই এফ-১৬ বিমান তৈরি করবে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও তারা কিনছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটা তো ঠিক, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ‘মিত্র’ হিসেবে চাইছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে পাশের দেশগুলোর যে বিবাদ, তাতে চীনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি ভারত। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত দোকলামে দুইপক্ষকে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এখানে মেসেজটি স্পষ্ট। ভারত ও চীন কেউ কাউকে ‘ছাড়’ দিতে চায় না। উভয় দেশই দক্ষিণ এশিয়ার স্থানীয় সমস্যায় সুবিধা নিতে চায়। এখানে বলতেই হয়, চীনের অবস্থান কিছুটা শক্তিশালী। পাকিস্তানের পর মালদ্বীপে বড় স্বার্থ ছিল চীনের। এখন মালদ্বীপে চীনের স্বার্থ ক্ষুণœ হতে চলেছে। কিন্তু ভারতপন্থি একজন প্রেসিডেন্ট সেখানে দায়িত্ব নিলেও চীনের যে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, সে ব্যাপারে কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে হত্যা করতে চাচ্ছে! এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক না কেন, মালদ্বীপে সরকার পরিবর্তনের পর ভারতের ভূমিকা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো পাকিস্তানের উদ্বেগ। ভারতের সমরসজ্জা এখন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেয় কি নাÑ সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Alokito Bangladesh
22.10.2018
অসাধারণ লিখেছেন স্যার।
ReplyDeletethank you sir
ReplyDelete