প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট
গঠিত হওয়ার পর অনেক প্রশ্ন এখন আলোচিত হচ্ছে। এবং নিশ্চিত করেই বলতে পারি,
এ প্রশ্নগুলো এখন রাজনীতির ময়দানকে আরো উত্তপ্ত করবে। তবে সবচেয়ে কঠোর
সমালোচনাটি এসেছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। ১৪ অক্টোবর শিবচরে আয়োজিত এক
অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘খুচরা আধুলি’ নিয়ে ঐক্য করেছেন ড. কামাল (কালের
কণ্ঠ)। প্রধানমন্ত্রী হয়তো এ কথাটাই বলতে চেয়েছেন যে যাদের নিয়ে কামাল
হোসেন ঐক্য করেছেন, তাদের গণভিত্তি তেমন নেই। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে
প্রশ্ন তো আছে অনেক। এই ঐক্য কি শেষ পর্যন্ত একটি নির্বাচনী ঐক্যে পরিণত
হবে? এ ক্ষেত্রে আসন ভাগাভাগি হবে কিভাবে? দ্বিতীয়ত, বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয়
ঐক্যজোট রয়েছে। এই ২০ দলের ভূমিকা এখন কী হবে? তাহলে কি ২০ দল প্লাস জাতীয়
ঐক্যফ্রন্ট একটি নির্বাচনী প্ল্যাটফর্ম হবে? তৃতীয়ত, ড. কামাল হোসেন কি
শেষ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীকে মেনে নিলেন? চতুর্থত, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন
করার মধ্য দিয়ে কি বিএনপি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে প্রকারান্তরে
‘মাইনাস’ করল? পঞ্চমত, নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি যে ‘এক্সিট রুট’ খুঁজছিল,
তা কি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হলো?
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে ২০ দলীয় জোটে অস্বস্তি ছিল। বিশেষ করে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টির এক ধরনের অস্বস্তি ছিল। আপাতত এই অস্বস্তি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেলেও নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে ততই নানা ‘প্রশ্ন’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আসনবণ্টন নিয়েই অসন্তোষ বাড়বে। বিএনপি বড় দল। দলটির নেতা ও কর্মীরা দীর্ঘদিন মামলা-মোকদ্দমা মোকাবেলা করে এখনো ‘রাজনীতি’ করে আসছে। এটা ঠিক, নেতাকর্মীরা খুব একটা সক্রিয় ছিল না আন্দোলনে। মাঠপর্যায়ে তাদের নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। শত শত মামলা হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তাদের একটা বড় অংশ জেলা-উপজেলায় টিকতে না পেরে ঢাকায় আশ্রয় নিয়ে আছে। সুতরাং নেতৃপর্যায়ের অনেকেই এবার দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত ছোট ছোট দল অযাচিতভাবে ‘প্রার্থী পদ’ চেয়ে বসতে পারে। এতে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপির মতো বড় দল। বড় আপত্তি উঠবে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে। এই দলগুলো দীর্ঘদিন বিএনপির পাশে থেকে ‘সংগ্রাম’ করে আসছে। তারা স্বাভাবিকভাবেই বেশি আসন চাইবে। ফলে আসনবণ্টন নিয়ে সংকট তৈরি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। ঐক্যফ্রন্ট করে অন্তত আ স ম আবদুর রব কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না তাঁদের নিজেদের ‘আসন’ দুটি নিশ্চিত করতে পারলেন। কেননা তাঁদের দুজনের নির্বাচনী আসনে (লক্ষ্মীপুর ও বগুড়া) শক্তিশালী বিএনপির প্রার্থী রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির সমর্থন পেলে নিঃসন্দেহে তাঁদের ‘বিজয়’ লাভ সহজ হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে ড. কামাল হোসেন থাকলেও তিনি নির্বাচন করবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। কেননা তাঁর নিজের কোনো নির্বাচনী এলাকা নেই। ঢাকার মিরপুর অথবা মগবাজার তাঁর নির্বাচনী এলাকা হতে পারে। কিন্তু এই আসন দুটি তাঁর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাহলে বিএনপি যেখানে জনপ্রিয় (বগুড়া), সে ধরনের একটি নির্বাচনী এলাকায় তিনি প্রার্থী হবেন, নাকি বয়সের কারণে তিনি নির্বাচন করবেন না? তাহলে ঐক্যফ্রন্টের নেতা কে হবেন? বিএনপির তিন থেকে চার নেতা মূলত যৌথভাবে দলটি চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং এখানেও একটা সমস্যা আছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতের কী ভূমিকা হবে, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। তবে জামায়াতের নেতৃত্ব ফ্রন্টের সভায় থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু তারা প্রার্থী হতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে স্থানীয় জামায়াত নেতারা প্রার্থী না হয়ে জামায়াত সমর্থকদের প্রার্থী দাবি করতে পারেন। এতে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে পারবেন না। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। আবারও নির্বাচন ‘বয়কট’ করার শক্তি ও সামর্থ্য বিএনপি রাখে না। ফলে বিএনপির জন্যও এ ধরনের একটি ঐক্যফ্রন্টের প্রয়োজন ছিল। এখন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। এতে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে সনাতন সংসদের যে ‘চিত্র’, তা বদলে যেতে পারে। পঞ্চম জাতীয় সংসদের পর থেকেই এমন একটি সংসদীয় রাজনীতির চিত্র আমরা পাচ্ছি, যেখানে সংসদ বর্জন একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে অভাবনীয় এক ‘ঐক্য’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে দুই বড় দল সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিল। বিএনপি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে আস্থাশীল থাকলেও, বৃহত্তর স্বার্থে সংসদীয় রাজনীতি সমর্থন করেছিল। কিন্তু এই সংসদীয় রাজনীতি ঠিকমতো কাজ করছিল না। সংসদ বয়কট, আস্থাহীনতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ইত্যাদি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির যাত্রাপথকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। এর চূড়ান্ত পরিণতি ২০১৪ সালে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন। বেশ কয়েক বছর ধরে দোষারোপের যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তার ব্যাপ্তি বেড়েছে বৈ কমেনি। সুতরাং ২০১৮ সালে এসে একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে সংসদকে ঠিকমতো কাজ করতে দেওয়ার। ড. কামাল হোসেনের মতো লোক যদি সংসদে আসেন, তাহলে বিরোধী দলের রাজনীতির চিত্র বদলে যেতে পারে। বন্ধ হতে পারে সংসদ বয়কটের সংস্কৃতি এবং সেই সঙ্গে দোষারোপের রাজনীতি। তবে আমি আরো খুশি হতাম যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের প্রস্তাবিত সাত দফা আরো স্পষ্ট করত।
সাত দফায় বেশ কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে; যেমন—১ নম্বর দফায় রয়েছে মূলত দুটি দফা। সরকারের পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে। এটা সংবিধানসম্মত নয়। সব দলের আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সব দল এ ব্যাপারে যে একমত হবে তার যেমন গ্যারান্টি নেই, ঠিক তেমনি সংবিধানসম্মতভাবে এই সরকার কিভাবে করা সম্ভব তার একটি ব্যাখ্যা থাকা উচিত ছিল। ড. কামাল হোসেন নিজে একটা ফর্মুলা দিতে পারতেন। শুধু দাবি জানালে সরকার মেনে নেবে, তা মনে হয় না। ২ নম্বর দফায় রয়েছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র আড়াই মাস। এই স্বল্প সময়ে এটা কি আদৌ সম্ভব? উপরন্তু সরকারি দল বড় দল। তারা কি এ ধরনের কোনো প্রস্তাবে রাজি হবে? কিংবা সরকারকে কি বাধ্য করানো সম্ভব হবে? বিএনপি তো তা পারেনি। এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পারবে বলেও মনে হয় না। বরং নির্বাচন কমিশন কিভাবে নিরপেক্ষ থাকবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট একটা সুপারিশ থাকা উচিত ছিল। ৩ থেকে ৭ নম্বর দফা পর্যন্ত যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, তা খুবই সাধারণ। সরকার এসব দাবি মেনে তাদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতে পারে। এতে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
ঐক্যফ্রন্টের ১১ দফা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সে ব্যাপারেও অস্পষ্টতা রয়েছে। ১ নম্বর লক্ষ্যে সরকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কথা বলা হয়েছে। তথ্যগতভাবে এটা ভালো প্রস্তাব। কিন্তু বর্তমান সংবিধান তো এ বিষয়টি অনুমোদন করে না। সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা উল্লেখ আছে। এটা সত্য, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য কী করে সম্ভব কিংবা রাষ্ট্রপতি কী কী ভূমিকা পালন করলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে এক ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ হয়, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ১১ দফায় তা নেই। ২ নম্বর লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, এ প্রশ্ন করাই যায়। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’ এখন ৭০ অনুচ্ছেদে যদি সংশোধনী আনা হয়, তাহলে সংসদে ‘হর্স ট্রেডিং’ হবে। অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা নানা লোভ-লালসার শিকার হয়ে অন্য দলে যোগ দেবেন এবং সরকার গঠন করতে ওই দলকে সাহায্য করবেন। অথবা টাকার বিনিময়ে নতুন দল গঠন করে কোনো দলকে সরকার গঠনে সহযোগিতা করবেন। সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো সংবাদ হতে পারে না। সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব (১০ নম্বর লক্ষ্য) কিংবা প্রতিরক্ষা বাহিনীকে যুগোপযোগী করা (১১ নম্বর লক্ষ্য) এ সবই সংবিধানে আছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। ফলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা ও ১১ দফা একরকম একটা দায়সারা গোছের কর্মসূচি হয়ে গেছে। বরং আমি খুশি হতাম যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আগামী ৫০ বছরের বাংলাদেশ সামনে রেখে একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করত। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে বাণিজ্যিক সুবিধা পায়, তা ২০২৭ সালে শেষ হয়ে যাবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং চীনে বাংলাদেশের বাণিজ্য হ্রাস পাবে প্রায় ১১ শতাংশ। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে যে সুবিধা পায়, ২০২৭ সালে তা বাতিল হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত, তা ফ্রন্টের কর্মসূচিতে থাকা উচিত ছিল। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। তাদের জন্য কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত সে ব্যাপারেও বিস্তারিত থাকা উচিত ছিল, যা নেই। ফলে সাত দফা ও ১১ দফা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।
তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। মিডিয়া এই ফ্রন্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এখন দেখার পালা ফ্রন্টের নেতারা জনগণের এই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করেন। ড. কামাল হোসেনের বয়স হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতাও রয়েছে। এই অসুস্থতা নিয়ে তিনি ফ্রন্টের পক্ষ হয়ে কতটুকু গণসংযোগ করতে পারবেন—সে প্রশ্ন আছে। বিএনপি বড় দল। এখন তারা যদি ফ্রন্টের রাজনীতি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার চেষ্টা করে, তাহলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। বিএনপিকে এখন ‘লো প্রফাইল’ রাজনীতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল বা জোট থাকা দরকার। জোট রাজনীতি বাংলাদেশের বাস্তবতা। সুতরাং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির জন্য তা হবে মঙ্গল। এর মধ্য দিয়ে দেশে একটি সুস্থ রাজনীতির চর্চাও শুরু হতে পারে।
Daily kalerkontho
21.10.2018
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে ২০ দলীয় জোটে অস্বস্তি ছিল। বিশেষ করে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টির এক ধরনের অস্বস্তি ছিল। আপাতত এই অস্বস্তি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেলেও নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে ততই নানা ‘প্রশ্ন’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আসনবণ্টন নিয়েই অসন্তোষ বাড়বে। বিএনপি বড় দল। দলটির নেতা ও কর্মীরা দীর্ঘদিন মামলা-মোকদ্দমা মোকাবেলা করে এখনো ‘রাজনীতি’ করে আসছে। এটা ঠিক, নেতাকর্মীরা খুব একটা সক্রিয় ছিল না আন্দোলনে। মাঠপর্যায়ে তাদের নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। শত শত মামলা হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তাদের একটা বড় অংশ জেলা-উপজেলায় টিকতে না পেরে ঢাকায় আশ্রয় নিয়ে আছে। সুতরাং নেতৃপর্যায়ের অনেকেই এবার দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত ছোট ছোট দল অযাচিতভাবে ‘প্রার্থী পদ’ চেয়ে বসতে পারে। এতে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপির মতো বড় দল। বড় আপত্তি উঠবে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে। এই দলগুলো দীর্ঘদিন বিএনপির পাশে থেকে ‘সংগ্রাম’ করে আসছে। তারা স্বাভাবিকভাবেই বেশি আসন চাইবে। ফলে আসনবণ্টন নিয়ে সংকট তৈরি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। ঐক্যফ্রন্ট করে অন্তত আ স ম আবদুর রব কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না তাঁদের নিজেদের ‘আসন’ দুটি নিশ্চিত করতে পারলেন। কেননা তাঁদের দুজনের নির্বাচনী আসনে (লক্ষ্মীপুর ও বগুড়া) শক্তিশালী বিএনপির প্রার্থী রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির সমর্থন পেলে নিঃসন্দেহে তাঁদের ‘বিজয়’ লাভ সহজ হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে ড. কামাল হোসেন থাকলেও তিনি নির্বাচন করবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। কেননা তাঁর নিজের কোনো নির্বাচনী এলাকা নেই। ঢাকার মিরপুর অথবা মগবাজার তাঁর নির্বাচনী এলাকা হতে পারে। কিন্তু এই আসন দুটি তাঁর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাহলে বিএনপি যেখানে জনপ্রিয় (বগুড়া), সে ধরনের একটি নির্বাচনী এলাকায় তিনি প্রার্থী হবেন, নাকি বয়সের কারণে তিনি নির্বাচন করবেন না? তাহলে ঐক্যফ্রন্টের নেতা কে হবেন? বিএনপির তিন থেকে চার নেতা মূলত যৌথভাবে দলটি চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং এখানেও একটা সমস্যা আছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতের কী ভূমিকা হবে, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। তবে জামায়াতের নেতৃত্ব ফ্রন্টের সভায় থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু তারা প্রার্থী হতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে স্থানীয় জামায়াত নেতারা প্রার্থী না হয়ে জামায়াত সমর্থকদের প্রার্থী দাবি করতে পারেন। এতে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে পারবেন না। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। আবারও নির্বাচন ‘বয়কট’ করার শক্তি ও সামর্থ্য বিএনপি রাখে না। ফলে বিএনপির জন্যও এ ধরনের একটি ঐক্যফ্রন্টের প্রয়োজন ছিল। এখন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। এতে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে সনাতন সংসদের যে ‘চিত্র’, তা বদলে যেতে পারে। পঞ্চম জাতীয় সংসদের পর থেকেই এমন একটি সংসদীয় রাজনীতির চিত্র আমরা পাচ্ছি, যেখানে সংসদ বর্জন একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে অভাবনীয় এক ‘ঐক্য’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে দুই বড় দল সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিল। বিএনপি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে আস্থাশীল থাকলেও, বৃহত্তর স্বার্থে সংসদীয় রাজনীতি সমর্থন করেছিল। কিন্তু এই সংসদীয় রাজনীতি ঠিকমতো কাজ করছিল না। সংসদ বয়কট, আস্থাহীনতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ইত্যাদি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির যাত্রাপথকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। এর চূড়ান্ত পরিণতি ২০১৪ সালে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন। বেশ কয়েক বছর ধরে দোষারোপের যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তার ব্যাপ্তি বেড়েছে বৈ কমেনি। সুতরাং ২০১৮ সালে এসে একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে সংসদকে ঠিকমতো কাজ করতে দেওয়ার। ড. কামাল হোসেনের মতো লোক যদি সংসদে আসেন, তাহলে বিরোধী দলের রাজনীতির চিত্র বদলে যেতে পারে। বন্ধ হতে পারে সংসদ বয়কটের সংস্কৃতি এবং সেই সঙ্গে দোষারোপের রাজনীতি। তবে আমি আরো খুশি হতাম যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের প্রস্তাবিত সাত দফা আরো স্পষ্ট করত।
সাত দফায় বেশ কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে; যেমন—১ নম্বর দফায় রয়েছে মূলত দুটি দফা। সরকারের পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে। এটা সংবিধানসম্মত নয়। সব দলের আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সব দল এ ব্যাপারে যে একমত হবে তার যেমন গ্যারান্টি নেই, ঠিক তেমনি সংবিধানসম্মতভাবে এই সরকার কিভাবে করা সম্ভব তার একটি ব্যাখ্যা থাকা উচিত ছিল। ড. কামাল হোসেন নিজে একটা ফর্মুলা দিতে পারতেন। শুধু দাবি জানালে সরকার মেনে নেবে, তা মনে হয় না। ২ নম্বর দফায় রয়েছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র আড়াই মাস। এই স্বল্প সময়ে এটা কি আদৌ সম্ভব? উপরন্তু সরকারি দল বড় দল। তারা কি এ ধরনের কোনো প্রস্তাবে রাজি হবে? কিংবা সরকারকে কি বাধ্য করানো সম্ভব হবে? বিএনপি তো তা পারেনি। এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পারবে বলেও মনে হয় না। বরং নির্বাচন কমিশন কিভাবে নিরপেক্ষ থাকবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট একটা সুপারিশ থাকা উচিত ছিল। ৩ থেকে ৭ নম্বর দফা পর্যন্ত যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, তা খুবই সাধারণ। সরকার এসব দাবি মেনে তাদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতে পারে। এতে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
ঐক্যফ্রন্টের ১১ দফা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সে ব্যাপারেও অস্পষ্টতা রয়েছে। ১ নম্বর লক্ষ্যে সরকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কথা বলা হয়েছে। তথ্যগতভাবে এটা ভালো প্রস্তাব। কিন্তু বর্তমান সংবিধান তো এ বিষয়টি অনুমোদন করে না। সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা উল্লেখ আছে। এটা সত্য, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য কী করে সম্ভব কিংবা রাষ্ট্রপতি কী কী ভূমিকা পালন করলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে এক ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ হয়, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ১১ দফায় তা নেই। ২ নম্বর লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, এ প্রশ্ন করাই যায়। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’ এখন ৭০ অনুচ্ছেদে যদি সংশোধনী আনা হয়, তাহলে সংসদে ‘হর্স ট্রেডিং’ হবে। অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা নানা লোভ-লালসার শিকার হয়ে অন্য দলে যোগ দেবেন এবং সরকার গঠন করতে ওই দলকে সাহায্য করবেন। অথবা টাকার বিনিময়ে নতুন দল গঠন করে কোনো দলকে সরকার গঠনে সহযোগিতা করবেন। সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো সংবাদ হতে পারে না। সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব (১০ নম্বর লক্ষ্য) কিংবা প্রতিরক্ষা বাহিনীকে যুগোপযোগী করা (১১ নম্বর লক্ষ্য) এ সবই সংবিধানে আছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। ফলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা ও ১১ দফা একরকম একটা দায়সারা গোছের কর্মসূচি হয়ে গেছে। বরং আমি খুশি হতাম যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আগামী ৫০ বছরের বাংলাদেশ সামনে রেখে একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করত। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে বাণিজ্যিক সুবিধা পায়, তা ২০২৭ সালে শেষ হয়ে যাবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং চীনে বাংলাদেশের বাণিজ্য হ্রাস পাবে প্রায় ১১ শতাংশ। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে যে সুবিধা পায়, ২০২৭ সালে তা বাতিল হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত, তা ফ্রন্টের কর্মসূচিতে থাকা উচিত ছিল। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। তাদের জন্য কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত সে ব্যাপারেও বিস্তারিত থাকা উচিত ছিল, যা নেই। ফলে সাত দফা ও ১১ দফা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।
তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। মিডিয়া এই ফ্রন্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এখন দেখার পালা ফ্রন্টের নেতারা জনগণের এই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করেন। ড. কামাল হোসেনের বয়স হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতাও রয়েছে। এই অসুস্থতা নিয়ে তিনি ফ্রন্টের পক্ষ হয়ে কতটুকু গণসংযোগ করতে পারবেন—সে প্রশ্ন আছে। বিএনপি বড় দল। এখন তারা যদি ফ্রন্টের রাজনীতি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার চেষ্টা করে, তাহলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। বিএনপিকে এখন ‘লো প্রফাইল’ রাজনীতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল বা জোট থাকা দরকার। জোট রাজনীতি বাংলাদেশের বাস্তবতা। সুতরাং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির জন্য তা হবে মঙ্গল। এর মধ্য দিয়ে দেশে একটি সুস্থ রাজনীতির চর্চাও শুরু হতে পারে।
Daily kalerkontho
21.10.2018
0 comments:
Post a Comment