রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

উপসাগরীয় অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি



৩০ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ | পড়া যাবে ৭ মিনিটে 


উপসাগরীয় অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি
ইরান সংকটের পেছনে শিয়া-সুন্নির বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ইসলামের শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বাস করে ইরানে। এর বাইরে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জনসংখ্যার একটা বড় অংশ সুন্নি ধর্মাবলম্বী। তবে এখানে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনও বসবাস করে। ইরাকে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সংখ্যালঘু সুন্নি মুসলমানরা দীর্ঘদিন এই দেশটি শাসন করে আসছিল। সাদ্দাম হোসেন নিজে ছিলেন সুন্নি সম্প্রদায়ের লোক। সাদ্দাম-পরবর্তী জমানায় শিয়ারা নেতৃত্বে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে ইরানি নেতৃত্বের যোগাযোগ রয়েছে। তবে ইরানে শিয়া নেতৃত্বে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরাকে এমনটি হয়নি। উপসাগরীয় অঞ্চলে যে সুন্নি নেতৃত্ব রয়েছে বিভিন্ন দেশে, তাদের ভয় ইরান শিয়াদের নেতৃত্বে গঠিত মিলিশিয়াদের একত্র করে সুন্নি নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ দিতে পারে। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে যে গণবিক্ষোভ হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে এই শিয়ারা। একদিন এই শিয়ারা পুরো উপসাগরীয় অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটি ‘গ্রেটার ইরান’ বা একটি ‘গ্রেটার পারস্য রাষ্ট্র’ গঠন করতে পারে। এমন ধরনের একটি ধারণা কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের।
এখানে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। এর একটি ধর্মীয় দিক আছে, সেই সঙ্গে আছে রাজনৈতিক দিকও। ইসলাম ধর্মে শিয়া-সুন্নি বলে কোনো কথা উল্লেখ করা হয়নি। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর এই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সময়টা ৬৩২ সাল। দ্বন্দ্বটা তৈরি হয়েছিল নেতৃত্বের প্রশ্নে। অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর কার হাতে নেতৃত্ব থাকবে, দ্বন্দ্বটা তৈরি হয়েছিল সেখান থেকেই। সুন্নিরা মূলত ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ নামে পরিচিত। সুন্নি শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘সুন্নাহ’ থেকে। সুন্নাহ শব্দের অর্থ প্রথা, বিধান বা আচরণ। সাহাবিরা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী ও তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেন বিধায় তাঁদের অনুসারীরা সুন্নি নামে পরিচিত। অন্যদিকে শিয়া শব্দটির অর্থ দল বা অনুসারী। হজরত আলী (রা.)-এর অনুসারীরাই শিয়াত-ই-আলী বা আলীর দল নামে পরিচিত। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচনকালে (অর্থাৎ যাঁরা তাঁর মৃত্যুর পর ওই সময়কার রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন) একদল লোক হজরত আলী (রা.)-কে সমর্থন করেন। তিনি ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচাত ভাই ও মেয়ে ফাতেমার স্বামী। তিনি ছিলেন চতুর্থ খলিফা। প্রথম খলিফা ছিলেন হজরত আবু বকর (রা.), দ্বিতীয়জন হজরত ওমর (রা.), তৃতীয়জন হজরত ওসমান (রা.) এবং চতুর্থজন ছিলেন আলী (রা.)। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে হজরত আলী (রা.) আততায়ীর হাতে শহীদ হলে শিয়া আন্দোলন জোরদার হয়। এর কিছু পরে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে হজরত  হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক নৃশংসভাবে শহীদ হলে শিয়া আন্দোলনের উদ্ভব হয় এবং সেই থেকে শিয়া মতবাদ বিকশিত হতে থাকে। রাজনৈতিকভাবেও শিয়া সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করে। পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগই সুন্নি সাম্প্রদায়ভুক্ত। এখানে আরো কিছু তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। হজরত আলী (রা.) ও হজরত হোসাইন (রা.)-এর মৃত্যুর প্রায় এক হাজার বছর পর প্রাচীন সাফাভিদ ((Safavid Empire, 1504-1736) সাম্রাজ্য (আজকে যা ইরান) ইরাকের পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ইরাক বাহ্যত আরবীয় সংস্কৃতি ধারণ করে, আর ইরান পারস্য সংস্কৃতি। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের বৈরিতা তৈরি হয়েছিল, যা সাদ্দাম হোসেনের সময় পর্যন্ত ছিল। পাঠক, ইরান-ইরাক আট বছর যুদ্ধের কথা (১৯৮০-৮৮) স্মরণ করতে পারেন। ইরাকি সুন্নিদের ভয় ছিল ইরাকের শিয়ারা ইরানি শিয়ার নেতৃত্ব দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে। সাফাভিদ সাম্রাজ্যই ইরানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে শিয়া ধর্মকে প্রবর্তন করেছিল। ১৫০১ সালে সাফাভিদ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে ইরানে সুন্নি ধর্মের প্রচলন ছিল। এই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ২০১৪ সালে আইএসের উত্থানের মধ্য দিয়ে। ইরাকের ও সিরিয়ার একটি অংশ দখল করে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের উত্থান ঘটেছিল। আইএস ছিল সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত। ফলে ওই সময় ইরাকের শিয়া নেতৃত্ব আইএস দমনে ইরানের সহযোগিতা চেয়েছিল। ইরান সেই সহযোগিতা দিয়েছিল।
ইরান পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এটা করতে গিয়ে রেভল্যুশনারি আর্মির ভেতরে কুদস নামে একটি প্যারামিলিটারি ফোর্স গঠন করেছিল, যাদের কাজ ছিল বিভিন্ন দেশে বসবাসরত শিয়া ধর্মাবলম্বীদের ভেতরে কাজ করা, তাদের ঐক্যবদ্ধ করা। প্রয়াত মেজর জেনারেল সোলাইমানি ছিলেন এর মূল নেতা। তিনি স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করতেন এবং তা বাস্তবায়ন করতেন। বলা হয়, সোলাইমানি অগাধ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং সরাসরি শীর্ষ নেতা খামেনির তত্ত্বাবধানে তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। সোলাইমানি শুধু তাঁর কাছেই রিপোর্ট করতেন, অন্য কারো কাছে নয়। অভিযোগ আছে, উপসাগরীয় অঞ্চলে যেমন শিয়া-মিলিশিয়া আছে তা ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে।
উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে শিয়া জনগোষ্ঠীর একটা পরিসংখ্যান আমরা এখানে দিতে পারি। বাহরাইনে শিয়া জনগোষ্ঠী শতকরা ৭০ ভাগ, ইরানে ৯০ ভাগ, ইরাকে ৬৩ ভাগ, কুয়েতে ২৫ ভাগ, লেবাননে ৩৬ ভাগ, কাতারে ১৪ ভাগ, সৌদি আরবে ৫ ভাগ, আরব আমিরাতে ১৬ ভাগ, আর ইয়েমেনে ৩৬ ভাগ। একমাত্র ইরান বাদে প্রতিটি দেশেই ক্ষমতায় রয়েছে সুন্নিরা। সাদ্দাম হোসেন পরবর্তী সময়ে ইরাকের শাসনক্ষমতায় অবশ্য শিয়ারা রয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এর বাইরে যেসব দেশ রয়েছে, সেখানে যে অসন্তোষ রয়েছে, সেসব অসন্তোষের পেছনে ‘শিয়া ফ্যাক্টর’ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এই শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে এ অঞ্চলে সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পুনরুত্থান ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন অনেক বিশ্লেষক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আইএসের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পরিচালনা করবে না। এটা একটি ক্লিয়ার মেসেজ আইএস পুনরুত্থানের ব্যাপারে। মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টরা এখন আইএসকে শিয়া গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে।
অনেক বিশ্লেষকই লক্ষ করে আসছেন যে এই অঞ্চলে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে (একদিকে সৌদি আরব, অন্যদিকে ইরান) যে ‘প্রক্সিওয়ার’ চলছে, তাতে বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া জড়িয়ে গেছে।
পারস্য উপসাগরে গ্যাস ও তেলের রিজার্ভ ও একই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহ রয়েছে উভয় বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার। ইরান সংকটও এর সঙ্গে জড়িত। আমরা কয়েকটি পাইপলাইন প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এই গ্যাস পাইপলাইন স্ট্র্যাটেজিকে কোনো কোনো বিশ্লেষক Pipelineistain' ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (দেখুন Paul Cochrane-এর প্রবন্ধ Middle East Eye, 16 April, 2018)। প্রথম পাইপলাইন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে, যা কাতার-সৌদি আরব-জর্দান-সিরিয়া হয়ে তুরস্ক যাবে (কাতার-তুরস্ক পাইপলাইন)। পরে তা ইউরোপের বুলগেরিয়ায় যাবে। দ্বিতীয় পাইপলাইনটি, যা রাশিয়া সমর্থিত, ইরান (ভায়া ইরাক) হয়ে সিরিয়া যাবে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে উভয় পাইপলাইনে সিরিয়া সংযুক্ত রয়েছে। সিরিয়া সংকটের পেছনে এটিও একটা কারণ—এই দুই পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। যদিও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ২০০৯ সালে কাতারি পাইপলাইন প্রজেক্ট বাতিল করে দিয়েছেন। বাতিল করার পেছনে রাশিয়ার একটা অনুরোধ ছিল। কেননা এই পাইপলাইন বাস্তবায়িত হলে ইউরোপে রাশিয়ার যে বিশাল ‘গ্যাসের বাজার’, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে কাতার এই গ্যাস পাইপলাইনের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের সহযোগিতায় সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিল। শুধু রাশিয়ার কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। অনেক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করেছেন যে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটা সরকার বসাতে পারলে, তারা এই কাতার-সৌদি আরব-সিরিয়া পাইপলাইনকে সমর্থন দেবে। এতে ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে। এতে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর ‘চাপ’ বাড়বে। রাশিয়াকে বাগে আনা সম্ভব হবে। সুতরাং ইরান সংকটের ‘আপাতত’ একটা সমাধান হয়েছে বটে; কিন্তু যত দিন পর্যন্ত না শিয়া-সুন্নি বিরোধের অবসান হয়, তত দিন পর্যন্ত উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বিরাজ করবে।

Kalerkontho
30.01.20207
tsrahmanbd@yahoo.com

মন্তব্য



সাতদিনের সেরা

0 comments:

Post a Comment