আমাদের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর গণতান্ত্রিক চরিত্র। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন সংবিধানের প্রথম ভাগেই ১নং অনুচ্ছেদ (সংবিধানের প্রাধান্য), দ্বিতীয় ভাগের ৮নং অনুচ্ছেদ (মূলনীতি), ১০নং অনুচ্ছেদ (সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি), ১১নং অনুচ্ছেদ (গণতন্ত্র ও মানবাধিকার), ১৩নং অনুচ্ছেদ (মালিকানার নীতি), ১৫নং অনুচ্ছেদ (মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা), ১৯ অনুচ্ছেদ (সুযোগের সমতা), ২০ অনুচ্ছেদ (অধিকার), ২২ অনুচ্ছেদ (নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ), প্রতিটি ক্ষেত্রে এই গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। এমনকি তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ২৩টি অনুচ্ছেদ হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা বলে। এর মধ্যে রয়েছে চলাফেরাসহ সমাবেশের স্বাধীনতার কথা।
স্বাধীন সংবাদপত্র গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য সহায়ক। যে দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র নেই, মিডিয়া স্বাধীন নয়, সেই দেশকে কোনোমতেই গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। চীনের প্রয়াত নেতা মাও জে দং একবার বলেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ সম্ভবত মাও জে দং বিপ্লব-পরবর্তী চীনা সমাজে ‘বিভিন্ন মতের যে সহাবস্থান থাকবে’, সে ধরনের একটি মতামতই দিতে চেয়েছিলেন। যদিও চীনের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে তার ওই মতের ব্যাপারে তেমন খুব একটা ব্যাখ্যা আমি পাইনি। একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এভাবে যে, ‘শত মতের’ মধ্য দিয়ে আসল মতটিই এক সময় বেরিয়ে আসবে। তাই একটি সমাজে যদি অনেক সংবাদপত্র থাকে, তাহলে তা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক। সংবাদপত্রে বিভিন্ন মত প্রতিফলিত হতে পারে। সংবাদপত্র সরকারের ভুল-ত্রুটিগুলো তুলে ধরতে পারে। এতে করে সরকারেরই লাভ। একই সঙ্গে ‘বিভিন্ন মত ও পথের’ মধ্য দিয়ে সঠিক মতটি গ্রহণ করে নিতে পারে সমাজ। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যদি খর্ব হয়, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। তাই যারা গণতন্ত্র চর্চা করেন, গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন গণতন্ত্র ও সংবাদপত্র পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। আর গণতান্ত্রিক সমাজেই স্বাধীন সংবাদপত্র বিকশিত হয়। যেখানে গণতন্ত্র নেই, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও নেই। বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খুবই জরুরি।
বাংলাদেশে আমরা ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। গেল ৪৮ বছরে এই সংবিধানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মোট ১৭টি সংশোধনী সংবিধানে যুক্ত হয়েছে। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ফলে সংবিধান এখন ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে গেছে। এক সময় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল- এর উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সময়ে ৭ম, ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওইসব নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেলেও এক সময় এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক’। সুতরাং এ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। এক সময় বিষয়টি উচ্চ আদালতে গেল। উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন অতীত।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদটি ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা’ সংক্রান্ত। ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দুটো আরও স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের’ কথা এবং ‘খ’তে রয়েছে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ অর্থাৎ সংবিধানের ৩৯নং ধারাটি একজন সংবাদকর্মীকে যেমন অধিকার দিয়েছে তার মতপ্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এ ধারাটি একটি রক্ষাকবচ। তবে এ রক্ষাকবচটি বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে- এমন অভিযোগ আমরা এ দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের মুখে শুনেছি। তারা উচ্চ আদালতে একাধিকবার বলেছেন, ৩৯ ধারাবলে একজন সংবাদকর্মী তার মতপ্রকাশের অধিকার রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হয়, তখন ওই সময়ের জাতীয় নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারা সংবিধানে ৩৯নং ধারাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও ৩৯নং ধারার সঙ্গে ৩৬ ও ৩৭নং অনুচ্ছেদ দুটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এবং তা ৩৯নং অনুচ্ছেদের পরিপূরক। ৩৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরার স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই ধারা বলে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া বা চলাচল করার অধিকার রাখেন। আর ৩৭নং ধারায় বলা হয়েছে সমাবেশের স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ একজন নাগরিককে জনসভা তথা শোভাযাত্রা করার অনুমতি দিয়েছে। সংবিধানের এই ৩৬, ৩৭ ও ৩৯নং অনুচ্ছেদ যদি একসঙ্গে পড়ি তাহলে দেখব, এখানেই নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের স্পিরিট। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিকাশ ও স্থায়িত্বের বিষয়টি লুকিয়ে আছে এই অনুচ্ছেদগুলোর অন্তরালে। এর একটি যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের অনেক কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের এই বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও অনেকের অভিমত- ১৯৭৫ সালে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় ৩৯নং অনুচ্ছেদটি কিছুটা হলেও লঙ্ঘিত হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে এ দেশে প্রচুর সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে সোশ্যাল মিডিয়া যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একুশ শতকে এই সোশ্যাল মিডিয়া নতুন এক মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই সোশ্যাল মিডিয়া ভবিষ্যতে সংবাদপত্রের বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়ে যায় কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী এনে আমরা আবার সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে এসেছি। তবে গণতন্ত্রের এই যে ‘দ্বিতীয় যাত্রাপথ’, এই যাত্রাপথে গণতন্ত্রের বিকাশ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে নির্বাচন হচ্ছে। সেই নির্বাচন নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল স্পিরিট, অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস, তাতে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ যেখানে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হতে আমরা দেখি না। নিয়মমাফিক এখানে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকুক আর না থাকুক, সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নির্বাচন হয়। নিঃসন্দেহে নির্বাচন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। সেই সঙ্গে মানবাধিকার আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। একটি সমাজে যদি মানবাধিকারের প্রশ্নটি নিশ্চিত করা না যায়, যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে, তাহলে ওই সমাজকে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে পারব না। যদি সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম ‘সত্য’ কথা বলতে না পারে, তাহলে সেই সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সচেষ্ট রয়েছি বটে; কিন্তু এ যাত্রাপথ খুব সুখের নয়। সংবাদপত্রের কর্মীরা ‘খুন’ হচ্ছেন, গুম হয়ে যাচ্ছেন, দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আক্রান্ত হচ্ছেন, যা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। ২৭ জানুয়ারি (২০২০) একাধিক সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি ছবি- একজন টিভি ক্যামেরাম্যান আক্রান্ত হয়েছেন, রক্তাক্ত তার দেহ। ঢাকা দক্ষিণে মেয়র নির্বাচনী প্রচারণায় দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় তিনি আহত হন। এই ছবি প্রমাণ করে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এ অসহিষ্ণুতা, আস্থাহীনতায় আক্রান্ত হচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য যা সত্যিই বেমানান। এই অসহিষ্ণু পরিবেশের মধ্য দিয়ে একটি ভয়ের আবহ তৈরি করে আর যাই হোক, সত্যিকারের গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না।
আমরা চাই সংবাদপত্র লিখুক। সংবাদকর্মীরা যা দেখেছেন, তা সম্প্রচার করুন। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হোক। সরকারের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া হোক। সমাজের সব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক সংবাদপত্র। তাহলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং গণতন্ত্রকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। যুগান্তর একুশ বছরে পা দিল। প্রথম দিন থেকে এ একুশ বছর আমি যুগান্তরের সঙ্গে ছিলাম। এটি আমার জন্য একটা বড় পাওয়া। যুগান্তরের সম্পাদকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন আমার মতামত দেয়ার। যুগান্তরের বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাই প্রার্থনা- সমাজের সব অনিয়মের বিরুদ্ধে যুগান্তর যেভাবে নিরলস কাজ করে এসেছে, আগামীতেও সেভাবে কাজ করুক। আর এর মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে যুগান্তর কাজ করে যাবে।
Jugantor
1.2.2020
0 comments:
Post a Comment