গত ৭ জানুয়ারি ইরানি রেভ্যুলুশনারি গার্ড কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে হত্যা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ইরাকে মার্কিন ঘাঁটির ওপর মিসাইল হামলার পর উপসাগরীয় অঞ্চলে যে যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা কি শেষ পর্যন্ত এড়ানো সম্ভব হল?
এই প্রশ্নটি উঠেছে এ কারণে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিসাইল হামলার পর হোয়াইট হাউসে যে ব্রিফিং করেছেন, তাতে তিনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ নয়, তিনি শান্তি চান। এটি সবাইকে অবাক করেছে। কারণ ধারণা করা হয়েছিল, মিসাইল হামলার প্রতিক্রিয়ায় তিনি ইরানের বিরুদ্ধে মারাত্মক যুদ্ধের সূচনা করতে পারেন!
আপাতত মনে হচ্ছে, তিনি এই মুহূর্তে তৃতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনা করলেন বা বটে; কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে এক ধরনের অঘোষিত ‘যুদ্ধ’ তিনি চালিয়ে যাবেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরান সংঘাতের পথ পরিহার করে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নজর দেবে। যদি তারা শান্তির পথ বেছে না নেয়, তাহলে দেশটির ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। যদিও এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই তিনি বলেননি। এর আগে ট্রাম্প ইরানের ৫২টি সাংস্কৃতিক স্থাপনা যুক্তরাষ্ট্রের হামলার লক্ষ্যবস্তু বলে হুমকি দিয়েছিলেন।
এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ‘যুদ্ধের’ নির্দেশ দিল না বটে; কিন্তু যারা ট্রাম্পকে চেনেন, তারা জানেন তিনি একজন চরম যুদ্ধবাজ নেতা। তিন মার্কিন অস্ত্র উৎপাদনকারী তথা কট্টরপন্থী সামরিক কমান্ডারদের নির্দেশিত পথেই চলেন। এরা উপসাগরীয় অঞ্চল তথা মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি ‘যুদ্ধ’ চায়। সেই সঙ্গে ইসরাইলি লবির স্বার্থেও তিনি কাজ করেন।
মধ্যপ্রাচ্য ইসরাইল ও সৌদি আরবের পথের কাঁটা হচ্ছে ইরান। ইরানকে বাগে এনে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-সৌদি আরব ত্রিদেশীয় অ্যালায়েন্স। এই মুহূর্তে তাই ‘যুদ্ধ’ এড়ানো গেছে বটে; কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। যুদ্ধ আপাতত হচ্ছে না; কিন্তু স্ট্র্যাটেজি বহাল থাকবে।
ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সোলেমানিকে হত্যা ও পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ক্ষেত্রে এখন ‘রেজিম চেঞ্জের’ ধারণাটি কার্যকর করতে তৎপর হবে। অর্থাৎ ইরানের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন। ‘রেজিম চেঞ্জের’ ধারণাটি একেবারে নতুন নয়।
যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই এ ধারণাটি বাস্তবায়ন করে আসছে। অর্থাৎ কোনো একটি সরকারকে যদি যুক্তরাষ্ট্র তার ‘নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ মনে করে, তাহলে সেই সরকারকে উৎখাত করার উদ্যোগ নেয়। সাধারণত ওই সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানকে উসকে দেয়। অথবা কখনও-সখনও সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনেরও উদ্যোগ নেয়। কোথাও সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে সরকারের পরিবর্তন ঘটায়।
অতীতের দিকে যদি আমরা নাও তাকাই, বিংশ শতাব্দীতেই যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘রেজিম চেঞ্জের’ একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তেল শিল্প জাতীয়করণ করলে সিআইএ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এর মধ্য দিয়ে রেজা শাহ পাহলভি অত্যন্ত ক্ষমতাধর শাসকে পরিণত হন।
১৯৫৪ সালে গুয়েতেমালায়, ১৯৫৬-৫৭ সালে সিরিয়ায়, ১৯৫৭ সালে গ্রিসে, ১৯৭৩ সালে চিলিতে, ১৯৮৩ সালে গ্রানাডায়, ১৯৮৯ সালে পানামায় এবং সাম্প্রতিককালে ২০০৩ সালে ইরাকে, আর ২০১১ সালে লিবিয়ায় এভাবে ‘রেজিম চেঞ্জের’ ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে।
এই উৎখাতের জন্য কখনও-সখনও সেসব দেশের সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে (চিলি, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল)। কোথাও আবার সরাসরি সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে সেখানকার বামপন্থী সরকার (গ্রানাডা) কিংবা বন্ধু নয় এমন সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে (ইরাক)।
লিবিয়ার ক্ষেত্রে সামরিক হস্তক্ষেপে গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়েছে। এখন ইরানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ‘রেজিম চেঞ্জের’ ধারণাটি নিয়ে এগিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে ইরাক ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে যা সম্ভব হয়েছিল, ইরানে কি তা সম্ভব হবে? একটি যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। সেই আশঙ্কা একেবারেই যে নেই, তা বলা যাবে না।
পেন্টাগনে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরে অনেকেই আছেন যারা ইরানের বিরুদ্ধে একটি ‘যুদ্ধ’ চান। একটি ‘যুদ্ধ’ ট্রাম্প তথা ইসরাইলি স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। পেন্টাগনের সাবেক শীর্ষ নেতা কমান্ডার জেনারেল ডেভিড পেট্রায়ুসের মুখেও আমরা শুনেছি সে কথা।
পেট্রায়ুস বলেছেন, ইরানি শীর্ষ সেনা কমান্ডার সোলেমানিকে হত্যা মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি বলেছেন, নির্দিষ্ট উদ্যোগের কারণেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। ওসামা বিন লাদেন এবং আইএস নেতা বাগদাদিকে হত্যার চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হল জেনারেল সোলেমানিকে হত্যা।
এ বক্তব্যের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমরা জানি না। এখন অব্দি মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি কোন কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জেনারেল সোলেমানি জড়িত ছিলেন। তবে এটা ঠিক, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ড বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় ছিলেন। সিরিয়ার অভ্যন্তরে এই গার্ড বাহিনীর নেতৃত্বে একটি সেনা ক্যাম্প পরিচালিত হতো, যেখানে ইসরাইলি বিমান হামলার খবর কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। ইরান তা অস্বীকারও করেনি।
একইসঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহ গ্রুপ কিংবা ইরাকের আধাসামরিক বাহিনী ‘হাশ্দ আল-শাবি’র অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের অন্যতম উৎস ছিল এ রেভ্যুলুশনারি গার্ড বাহিনী। মার্কিন ড্রোন হামলায় হাশ্দ আল-শাবির সহকারী প্রধান আবু মাহদি আল মুহানদিসও নিহত হয়েছেন। মুহানদিস ইরাকে ‘কায়তাব হিজবুল্লাহ’ নামে একটি সংগঠনের প্রধান ছিলেন।
ড্রোন হামলার আগে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা এবং একজন কন্ট্রাক্টরকে হত্যার জন্য হাশ্দ আল-শাবিকে অভিযুক্ত করা হয়। সুতরাং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সোলেমানি ছিলেন ইসরাইলি ও মার্কিন গোয়েন্দাদের টার্গেট। তাকে যে কোনো সময় হত্যা করা হতে পারে, এটা তিনি জানতেন। তবে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না।
উপসাগরীয় অঞ্চল তথা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের অবনতি ঘটল এমন একটি সময়ে, যখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা আসেনি। সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উৎখাত করা যায়নি। সঙ্গত কারণেই তাই প্রশ্ন উঠেছে, ইরানের বিষয়ে এখন স্ট্র্যাটেজি কী হবে? মূল টার্গেট সেখানকার ইসলামী সরকারকে উৎখাত- সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে না।
ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায়, বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনায় আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি বিমান-বোমা হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না; কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। মার্কিনবিরোধী জনমত সারা মধ্যপ্রাচ্যে আরও শক্তিশালী হবে এতে করে। যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া অনেক।
১. সারা মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের ‘গেরিলা যুদ্ধের’ (‘হিট অ্যান্ড রান’) সূচনা করবে ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ড। এতে করে মার্কিন স্থাপনাগুলো থাকবে এক ধরনের ঝুঁকির মুখে। ২. হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে রেভ্যুলুশনারি গার্ড বাহিনী। এতে বিশ্বে জ্বালানি তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। একটি তথ্য দেই। হরমুজ প্রণালি দিয়ে ২০১৫ সালে প্রতিদিন ১৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল (বিশ্বের মোট সরবরাহকৃত তেলের ২০ শতাংশ) সরবরাহ করা হয়েছে। এই তেলের ওপর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরশীল। অন্যদিকে পারসীয় গালফ অঞ্চল থেকে বিশ্বে প্রতিদিন যে ২৫ শতাংশ তেল এবং ৩৫ শতাংশ এলএনজি সরবরাহ করা হয়, তাতে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ফলে বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে। এতে করে আমাদের মতো দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৩. ইরান সংকট ঘনীভূত হলে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর ধারণা আরও শক্তিশালী হবে। ইতিমধ্যে চীন-রাশিয়া-ইরানের মাঝে ‘ঐক্য’ হয়েছে। এই তিন শক্তি সাম্প্রতিক একটি সামরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। যে কোনো ‘যুদ্ধে’ চীন ও রাশিয়ার মতো শক্তিকে ইরানের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আমরা দেখব। ৪. ইতিমধ্যে ইরান ঘোষণা দিয়েছে, তারা ৬ জাতি পারমাণবিক চুক্তি (২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত এবং ২০১৬ থেকে কার্যকর) থেকে সরে আসছে। দেশটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তেহরান আর পারমাণবিক কর্মসূচিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, মজুদ, গবেষণা ও উন্নয়ন সীমিত রাখার শর্ত মেনে চলবে না। এর অর্থ পরিষ্কার- ইরান পারমাণিক বোমা তৈরির প্রক্রিয়ায় নিজেদের আবারও জড়িত করবে। এটা ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না।
৫. সোলেমানিকে হত্যা ও ইরানে নতুন একটি ফ্রন্ট ‘ওপেন’ করার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিনেটে তার বিরুদ্ধে যে ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে, তা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এমনটা করেছিলেন ১৯৯৮ সালে ইরাকে বিমান হামলার নির্দেশ দিয়ে। এখন নিঃসন্দেহে সিনেটে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। যদিও এটা ঠিক, সিনেটে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।
চলতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ইসরাইলে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইরান সংকটের সঙ্গে বিষয়টি সরাসরি জড়িত। ২০১৯ সালে ইসরাইলে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়।
ফলে ১৭ মার্চ নির্বাচন হবে এবং এখন ইরানের বিরুদ্ধে যে কোনো ‘যুদ্ধ’ তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। ইতিমধ্যে নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্পের জন্য খারাপ খবর হচ্ছে- ইরাক থেকে সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছে জার্মানি, ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়া। এটা উপসাগরীয় অঞ্চলে ট্রাম্পের ‘অবস্থান’ দুর্বল করবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ‘মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ নয়, শান্তি চান’। তার এ কথার পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে।
Daily Jugantor
11.1.2020
0 comments:
Post a Comment