আজ
উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ পর্ব। এ পর্যন্ত তিন দফা নির্বাচনের পর যে
প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এ নির্বাচন আমাদের কতটুকু আশাবাদী
করতে পারছে? সংঘর্ষ, ভোট কেন্দ্র দখল, জালভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের
রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি প্রথম দু’দফা নির্বাচনে। তৃতীয়
দফায় (১৫ মার্চ) সহিংসতা ও অনিয়মের মাত্রা আরও বেড়েছে। তবে একটা পার্থক্য
লক্ষ্য করার মতো- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা তৃতীয় দফায় চেয়ারম্যান
পদে বিজয়ী হয়েছেন বেশি (৩৫ জন আর বিএনপির ২৭ জন)। অথচ এর আগের দু’দফায়
বিএনপির পাল্লা ভারি ছিল (প্রথম দফায় বিএনপি ৪৩, আওয়ামী লীগ ৩৪। দ্বিতীয়
দফায় বিএনপি ৫৩, আওয়ামী লীগ ৪৪)। তৃতীয় দফায় ভোটের ফলাফলের ‘চিত্র’ পাল্টে
গেল। আমার ধারণা, চতুর্থ ও পঞ্চম দফা নির্বাচনেও আমরা প্রত্যক্ষ করব একই
ফলাফল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়।এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ
বিজয়ী হল, না বিএনপি বিজয়ী হল, আমি এটাকে গুরুত্ব দিই না। আমি গুরুত্ব দিই
যে বিষয়টিকে তা হচ্ছে, আমরা গণতন্ত্রের চর্চাকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে
দিলাম কি-না। একটি হাস্যস্পদ নির্বাচন আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ৫ জানুয়ারি।
সেটা ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পৃথিবীর কোথাও এভাবে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস নেই। বিরোধী দলকে সরকারে
রেখে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমরা জন্ম দিলাম, তাকে আমরা গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতি বলব কি-না, আমি সে ব্যাপারেও সন্দিহান। আগামীতে দেশে গণতন্ত্রের এ
চর্চাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। যারা বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্র চর্চা
সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, তারা ন্যূনতম একটি দেশের দৃষ্টান্ত দিতে
পারেন। সে দেশটি হচ্ছে রাশিয়া। সেখানেও এক ধরনের গণতন্ত্র চর্চা হয়। সংসদ
আছে। রাজনৈতিক দল আছে। ভোটও হয়। কিন্তু যা দৃশ্যমান তা হচ্ছে একটি গোষ্ঠী
ঘুরেফিরে ক্ষমতায় থাকছে। পুতিন প্রথমে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ২০০০ সালে
(প্রধানমন্ত্রী, আগস্ট ১৯৯৯)। সংবিধান অনুযায়ী তৃতীয় টার্ম প্রেসিডেন্ট হতে
না পারায় তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী (২০০৮)। তারপর আবার প্রেসিডেন্ট। অর্থাৎ
ঘুরেফিরে ক্ষমতায় থাকা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ গণতন্ত্র চর্চাকে বিভিন্ন
নামে নামকরণ করেছেন। এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন
করার সময় এসেছে।
৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাই শুধু বাড়িয়ে দেয়নি, বরং গণতন্ত্র চর্চায় নতুন একটি মাত্রা দিয়েছিল। কারণ গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হয় তৃণমূল পর্যায়ে। তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চাকে আরও শক্তিশালী করে। তাই যে কোনো বিবেচনায় তৃণমূল পর্যায়ের এ নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কিন্তু ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ (বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও বামমনা দলগুলো) সত্ত্বেও উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আচরণ (জাল ভোট, ভোট কেন্দ্র দখল, সহিংসতা) প্রমাণ করল বাংলাদেশ গণতন্ত্র চর্চার নতুন এক ধাপে প্রবেশ করেছে। এখানে জনগণের অধিকার প্রয়োগটাই বড় কথা নয়। বরং যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখাই হল আসল কথা।পাঠক, উপজেলা নির্বাচনের (তৃতীয় পর্যায়ে) পর সংবাদপত্রে যেসব সংবাদ ও ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতে চাই। যুগান্তরের শীর্ষ সংবাদ ছিল : ‘সহিংসতা, জাল ভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাই’ (১৬ মার্চ)। আরেকটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল : ‘এ যেন চরদখলের লড়াই’। পোলিং অফিসার নিজেই ভোট দিয়েছেন সিন্দুরপুর ইউনিয়নের মাছিমপুর বিদ্যালয় কেন্দ্রে- এ ছবিও আছে সংবাদপত্রে (নির্বাচন কমিশন কি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে?)। চাঁদপুরে ছাত্রলীগ নেতার হুমকি ‘ক্যামেরা দে, না হলে গুলি করব’- এ সংবাদও আছে কাগজে। এখানে মিনিটে ৬টি ভোটের খবর দিয়েছে সংবাদপত্র। বাবুগঞ্জে ছাত্রলীগের সভাপতি একাই দিয়েছেন ৪০০ ভোট। আর নির্বাচন কমিশনার কী বলেছেন দেখুন। আবদুল মোবারক (তিনি এখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার) বললেন, প্রতি মিনিটে ১৩-১৪টি ভোট স্মার্টনেসের পরিচায়ক। তিনি খুশি হয়েছেন সহিংসতায় ৩ জনের বেশি মারা যায়নি বলে। এ জাতির দুর্ভাগ্য, আবদুল মোবারকের মতো লোকজন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পান। কোন বিবেচনায় তিনি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন, জানি না। কিন্তু ইসিতে জমা দেয়া তার জীবনবৃত্তান্ত ঘেঁটে দেখলাম, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিলেন (১৯৯৯-২০০১)। যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসরে যান ২০০৩ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র। পাস করেছেন ১৯৭০ সালে। কিন্তু অনেক পর ১৯৮৪ সালে বিসিএস দিয়ে নিয়োগ পান (এর আগে ১০ বছর চাকরি করেছেন টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনে)। এহেন একজন লোক যখন বলেন, মিনিটে ১৩-১৪টি ভোট স্মার্টনেসের পরিচায়ক, তখন ভাবতে অবাক লাগে, রাষ্ট্র এ ধরনের লোককেও সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেয়! এসব লোকের কারণেই নির্বাচন কমিশন তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারে না। আরও একটা কথা গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন রেখে সিইসি ছুটিতে যান কীভাবে? তিনি কি আদৌ ফিরে আসবেন?এখন উপজেলা পরিষদের যে নির্বাচন হয়ে গেল, তার মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব? বলতে দ্বিধা নেই, এক্ষেত্রেও অনেকটা আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল। অনেক উপজেলা চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। এরই মধ্যে তিন দফা নির্বাচনের একটি ফলাফল আমরা পেয়ে গেছি। পরপর তিন পর্যায়ের নির্বাচনেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা ভালো করেছে। এতে করে একটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। সুতরাং এটা বিবেচনায় নিতে হবে। স্বীকার করতেই হবে, এ নির্বাচন আবারও প্রমাণ করল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। জাতীয় পর্যায় তো বটেই, স্থানীয় পর্যায়ে এ দুই দলের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। যদিও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে মেলানো যাবে না, তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে এ দল দুটির গণভিত্তি অনেক শক্তিশালী। আর এ গণভিত্তিই জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়। যেহেতু এ নির্বাচন প্রমাণ করেছে, বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন প্রক্রিয়া চিন্তা করা যাবে না, সেহেতু এ উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলকে ধারণ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।উপজেলা নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেনি। এর অর্থ পরিষ্কার। বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিযায় থাকতে চায়। অর্থাৎ জাতীয় পর্যায়ের যে সংসদ নির্বাচন, সে ব্যাপারে বিএনপি একটি মেসেজ দিল যে তারা এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারেও সিরিয়াস। এ নির্বাচন প্রমাণ করল স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীরও একটা অবস্থান রয়েছে। জামায়াতের প্রার্থীরা বিএনপির সমর্থন নিয়ে একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে অন্য দলের সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছে। সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়কে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। একই সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ভরাডুবি প্রমাণ করল, জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ভূমিকায় স্থানীয় পর্যায়ের ভোটাররা অসন্তুষ্ট। এটা জাতীয় পার্টির জন্য একটি মেসেজও বটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি বিকশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে এ সত্যটাই বেরিয়ে আসে, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় পার্টি। যদিও এর প্রায় পুরো কৃতিত্বই ব্যক্তি এরশাদের। বাহ্যত বৃহত্তর উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক এ দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যক্তি এরশাদের কারণে। এর বাইরে অন্যত্র জাতীয় পার্টি কিছুটা হলেও তার প্রভাব বাড়িয়েছিল, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা পার্টির জন্য কোনো ‘শুভ’ সংবাদ বয়ে আনেনি। একদিকে সরকারে থাকা, আবার বিরোধী দলেও থাকা- এই যে ‘রাজনীতি’, এ রাজনীতি মানুষ গ্রহণ করেনি। উপজেলা নির্বাচন এর বড় প্রমাণ।উপজেলা নির্বাচনেও সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এত ব্যাপকতা ছিল না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনারের ব্যর্থতা ছিল চোখে পড়ার মতো। নির্বাচন কমিশন সহিংসতা রোধের ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যেসব জায়গায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গাতেই উপজেলা নির্বাচনের সময় সহিংসতা বেশি হয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচনের আগে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা তারা করেনি। বাংলাদশের রাজনীতিতে ‘ব্লেম গেম’ অর্থাৎ পরস্পরকে দোষারোপ করার যে সংস্কৃতি, তা উপজেলা নির্বাচনেও প্রতিফলিত হয়েছে। তৃতীয় দফা নির্বাচনের পরপরই বিএনপির মুখপাত্র বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়া, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি ঘটনার জন্য সরকারি দল তথা প্রশাসনযন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ঠিক তেমনি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাও অভিযোগ করেছেন, ‘বিএনপি মিথ্যা কথার জাল বুনছে।’ বিএনপির অভিযোগের পেছনে সত্যতা যে নেই, তা বলা যাবে না। ২০ ফেব্র“য়ারি এক শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত একজন কর্মকর্তা ব্যালট পেপারে সিল মারছেন। এর কোনো ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন থেকে দেয়া হয়নি। একই ধরনের ছবি ছাপা হয়েছে ১৬ মার্চের পত্রিকায়। সংবাদপত্রের ভাষায় ‘উনি পোলিং ভোটার’ (আমাদের সময়)। যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠার ছবি- ছিনতাইয়ের পর পরিত্যক্ত ব্যালট পেপার কুড়াচ্ছে আনসার সদস্যরা। শেরে বাংলা নগরের নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে এসব ছবির গুরুত্ব কত, আমি জানি না। কিন্তু আমাকে যা শংকায় ফেলেছে তা হচ্ছে, আমরা কি সামনের দিকে এগোচ্ছি, নাকি পেছনের দিকে হাঁটছি? ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন, সবাই মিলে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া, পরবর্তীকালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন- সবই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে পেরেছিলাম। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী আমাদের সব অর্জনকে পেছনে ফেলে দিল।ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমরা সহিংসতা লক্ষ্য করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় তিন পর্বের উপজেলা নির্বাচনেও আমরা সহিংসতা দেখলাম। ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তায় পুরো ভোটদান প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে পড়ল। ভোটাধিকার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদানের যে চিত্র আমরা দেখলাম, যে কোনো বিবেচনায় তা অগ্রহণযোগ্য। এ সহিংসতা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। আগামীতে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিতে আসার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তারা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করেও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেল না। তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনেও যখন সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ, তখন এ কমিশনের কাছ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করি কীভাবে? এই নির্বাচন কমিশন তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। বিগত নবম জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারত নির্বাচন কমিশন। সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি না জানিয়ে ইসি বিতর্কিত হয়েছিল। কমিশন ২৮ জুলাই (২০১৩) নিজের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত আরপিওর ৯১(ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও পরে প্রতিবাদের মুখে ইসি সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। মিথ্যা হলফনামা দিয়ে কেউ নির্বাচিত হলে তার নির্বাচন বাতিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে ফলাফল স্থগিত ও বাতিল করার ক্ষমতা ইসির নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা যদি ইসির কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলেও সে নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা ইসির নেই। আর্থিক বিষয়গুলোয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ অবমুক্তির দাবিরও কোনো সমাধান হয়নি। এর ফলে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযোগ থেকে যায়। ইসির বর্তমান কাঠামোয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যে সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হল।উপজেলা নির্বাচনের বিশেষ গুরুত্ব থাকলেও নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনকে আদৌ গুরুত্ব দেয়নি। এর বড় প্রমাণ তৃতীয় দফা নির্বাচন শুরুর আগের দিন বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাউকে নির্বাচন কমিশনে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংবিধানিক কর্মকাণ্ড উপেক্ষা করে ‘ছুটি’ কাটাতে যান, সেখানে ইসিতে কাউকে খুঁজে না পাওয়া যাওয়াই বুঝি স্বাভাবিক! তাই ধরে নিতেই হবে, নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনের ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নয়! জানি, নির্বাচন কমিশনের কাছে এর ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু যখন সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করেন এবং ‘ব্যর্থ’ বলে মন্তব্য করেন, তখন বুঝতেই হবে নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা পাঁচে উন্নীত করেও ইসির গ্রহণযোগ্যতা আমরা বাড়াতে পারিনি।আরও দু’দফায় এ নির্বাচন সম্পন্ন হবে। কে জিতল, কে হারল- এর হিসাব হতেই পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার, তার দলের লোকজন যে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত হতে দেয় না, এটাই প্রমাণিত হল। আর নির্বাচন কমিশন পরিণত হল ‘কাগুজে বাঘে’। উপজেলা নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চাকে আরও শক্তিশালী করতে পারল না।বি.দ্র. গত ১৫ মার্চ প্রকাশিত আমার কলামের একা জায়গায় উল্লেখ করেছিলাম, জওহরলাল নেহেরু তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেসের সভাপতি বানিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। প্রকৃতপক্ষে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৫৯ সালে। Daily JUGANTOR 23.03.14
৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাই শুধু বাড়িয়ে দেয়নি, বরং গণতন্ত্র চর্চায় নতুন একটি মাত্রা দিয়েছিল। কারণ গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হয় তৃণমূল পর্যায়ে। তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চাকে আরও শক্তিশালী করে। তাই যে কোনো বিবেচনায় তৃণমূল পর্যায়ের এ নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কিন্তু ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ (বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও বামমনা দলগুলো) সত্ত্বেও উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আচরণ (জাল ভোট, ভোট কেন্দ্র দখল, সহিংসতা) প্রমাণ করল বাংলাদেশ গণতন্ত্র চর্চার নতুন এক ধাপে প্রবেশ করেছে। এখানে জনগণের অধিকার প্রয়োগটাই বড় কথা নয়। বরং যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখাই হল আসল কথা।পাঠক, উপজেলা নির্বাচনের (তৃতীয় পর্যায়ে) পর সংবাদপত্রে যেসব সংবাদ ও ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতে চাই। যুগান্তরের শীর্ষ সংবাদ ছিল : ‘সহিংসতা, জাল ভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাই’ (১৬ মার্চ)। আরেকটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল : ‘এ যেন চরদখলের লড়াই’। পোলিং অফিসার নিজেই ভোট দিয়েছেন সিন্দুরপুর ইউনিয়নের মাছিমপুর বিদ্যালয় কেন্দ্রে- এ ছবিও আছে সংবাদপত্রে (নির্বাচন কমিশন কি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে?)। চাঁদপুরে ছাত্রলীগ নেতার হুমকি ‘ক্যামেরা দে, না হলে গুলি করব’- এ সংবাদও আছে কাগজে। এখানে মিনিটে ৬টি ভোটের খবর দিয়েছে সংবাদপত্র। বাবুগঞ্জে ছাত্রলীগের সভাপতি একাই দিয়েছেন ৪০০ ভোট। আর নির্বাচন কমিশনার কী বলেছেন দেখুন। আবদুল মোবারক (তিনি এখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার) বললেন, প্রতি মিনিটে ১৩-১৪টি ভোট স্মার্টনেসের পরিচায়ক। তিনি খুশি হয়েছেন সহিংসতায় ৩ জনের বেশি মারা যায়নি বলে। এ জাতির দুর্ভাগ্য, আবদুল মোবারকের মতো লোকজন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পান। কোন বিবেচনায় তিনি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন, জানি না। কিন্তু ইসিতে জমা দেয়া তার জীবনবৃত্তান্ত ঘেঁটে দেখলাম, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিলেন (১৯৯৯-২০০১)। যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসরে যান ২০০৩ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র। পাস করেছেন ১৯৭০ সালে। কিন্তু অনেক পর ১৯৮৪ সালে বিসিএস দিয়ে নিয়োগ পান (এর আগে ১০ বছর চাকরি করেছেন টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনে)। এহেন একজন লোক যখন বলেন, মিনিটে ১৩-১৪টি ভোট স্মার্টনেসের পরিচায়ক, তখন ভাবতে অবাক লাগে, রাষ্ট্র এ ধরনের লোককেও সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেয়! এসব লোকের কারণেই নির্বাচন কমিশন তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারে না। আরও একটা কথা গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন রেখে সিইসি ছুটিতে যান কীভাবে? তিনি কি আদৌ ফিরে আসবেন?এখন উপজেলা পরিষদের যে নির্বাচন হয়ে গেল, তার মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব? বলতে দ্বিধা নেই, এক্ষেত্রেও অনেকটা আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল। অনেক উপজেলা চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। এরই মধ্যে তিন দফা নির্বাচনের একটি ফলাফল আমরা পেয়ে গেছি। পরপর তিন পর্যায়ের নির্বাচনেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা ভালো করেছে। এতে করে একটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। সুতরাং এটা বিবেচনায় নিতে হবে। স্বীকার করতেই হবে, এ নির্বাচন আবারও প্রমাণ করল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। জাতীয় পর্যায় তো বটেই, স্থানীয় পর্যায়ে এ দুই দলের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। যদিও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে মেলানো যাবে না, তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে এ দল দুটির গণভিত্তি অনেক শক্তিশালী। আর এ গণভিত্তিই জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়। যেহেতু এ নির্বাচন প্রমাণ করেছে, বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন প্রক্রিয়া চিন্তা করা যাবে না, সেহেতু এ উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলকে ধারণ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।উপজেলা নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেনি। এর অর্থ পরিষ্কার। বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিযায় থাকতে চায়। অর্থাৎ জাতীয় পর্যায়ের যে সংসদ নির্বাচন, সে ব্যাপারে বিএনপি একটি মেসেজ দিল যে তারা এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারেও সিরিয়াস। এ নির্বাচন প্রমাণ করল স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীরও একটা অবস্থান রয়েছে। জামায়াতের প্রার্থীরা বিএনপির সমর্থন নিয়ে একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে অন্য দলের সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছে। সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়কে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। একই সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ভরাডুবি প্রমাণ করল, জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ভূমিকায় স্থানীয় পর্যায়ের ভোটাররা অসন্তুষ্ট। এটা জাতীয় পার্টির জন্য একটি মেসেজও বটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি বিকশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে এ সত্যটাই বেরিয়ে আসে, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় পার্টি। যদিও এর প্রায় পুরো কৃতিত্বই ব্যক্তি এরশাদের। বাহ্যত বৃহত্তর উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক এ দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যক্তি এরশাদের কারণে। এর বাইরে অন্যত্র জাতীয় পার্টি কিছুটা হলেও তার প্রভাব বাড়িয়েছিল, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা পার্টির জন্য কোনো ‘শুভ’ সংবাদ বয়ে আনেনি। একদিকে সরকারে থাকা, আবার বিরোধী দলেও থাকা- এই যে ‘রাজনীতি’, এ রাজনীতি মানুষ গ্রহণ করেনি। উপজেলা নির্বাচন এর বড় প্রমাণ।উপজেলা নির্বাচনেও সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এত ব্যাপকতা ছিল না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনারের ব্যর্থতা ছিল চোখে পড়ার মতো। নির্বাচন কমিশন সহিংসতা রোধের ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যেসব জায়গায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গাতেই উপজেলা নির্বাচনের সময় সহিংসতা বেশি হয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচনের আগে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা তারা করেনি। বাংলাদশের রাজনীতিতে ‘ব্লেম গেম’ অর্থাৎ পরস্পরকে দোষারোপ করার যে সংস্কৃতি, তা উপজেলা নির্বাচনেও প্রতিফলিত হয়েছে। তৃতীয় দফা নির্বাচনের পরপরই বিএনপির মুখপাত্র বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়া, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি ঘটনার জন্য সরকারি দল তথা প্রশাসনযন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ঠিক তেমনি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাও অভিযোগ করেছেন, ‘বিএনপি মিথ্যা কথার জাল বুনছে।’ বিএনপির অভিযোগের পেছনে সত্যতা যে নেই, তা বলা যাবে না। ২০ ফেব্র“য়ারি এক শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত একজন কর্মকর্তা ব্যালট পেপারে সিল মারছেন। এর কোনো ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন থেকে দেয়া হয়নি। একই ধরনের ছবি ছাপা হয়েছে ১৬ মার্চের পত্রিকায়। সংবাদপত্রের ভাষায় ‘উনি পোলিং ভোটার’ (আমাদের সময়)। যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠার ছবি- ছিনতাইয়ের পর পরিত্যক্ত ব্যালট পেপার কুড়াচ্ছে আনসার সদস্যরা। শেরে বাংলা নগরের নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে এসব ছবির গুরুত্ব কত, আমি জানি না। কিন্তু আমাকে যা শংকায় ফেলেছে তা হচ্ছে, আমরা কি সামনের দিকে এগোচ্ছি, নাকি পেছনের দিকে হাঁটছি? ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন, সবাই মিলে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া, পরবর্তীকালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন- সবই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে পেরেছিলাম। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী আমাদের সব অর্জনকে পেছনে ফেলে দিল।ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমরা সহিংসতা লক্ষ্য করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় তিন পর্বের উপজেলা নির্বাচনেও আমরা সহিংসতা দেখলাম। ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তায় পুরো ভোটদান প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে পড়ল। ভোটাধিকার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদানের যে চিত্র আমরা দেখলাম, যে কোনো বিবেচনায় তা অগ্রহণযোগ্য। এ সহিংসতা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। আগামীতে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিতে আসার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তারা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করেও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেল না। তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনেও যখন সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ, তখন এ কমিশনের কাছ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করি কীভাবে? এই নির্বাচন কমিশন তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। বিগত নবম জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারত নির্বাচন কমিশন। সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি না জানিয়ে ইসি বিতর্কিত হয়েছিল। কমিশন ২৮ জুলাই (২০১৩) নিজের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত আরপিওর ৯১(ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও পরে প্রতিবাদের মুখে ইসি সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। মিথ্যা হলফনামা দিয়ে কেউ নির্বাচিত হলে তার নির্বাচন বাতিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে ফলাফল স্থগিত ও বাতিল করার ক্ষমতা ইসির নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা যদি ইসির কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলেও সে নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা ইসির নেই। আর্থিক বিষয়গুলোয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ অবমুক্তির দাবিরও কোনো সমাধান হয়নি। এর ফলে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযোগ থেকে যায়। ইসির বর্তমান কাঠামোয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যে সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হল।উপজেলা নির্বাচনের বিশেষ গুরুত্ব থাকলেও নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনকে আদৌ গুরুত্ব দেয়নি। এর বড় প্রমাণ তৃতীয় দফা নির্বাচন শুরুর আগের দিন বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাউকে নির্বাচন কমিশনে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংবিধানিক কর্মকাণ্ড উপেক্ষা করে ‘ছুটি’ কাটাতে যান, সেখানে ইসিতে কাউকে খুঁজে না পাওয়া যাওয়াই বুঝি স্বাভাবিক! তাই ধরে নিতেই হবে, নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনের ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নয়! জানি, নির্বাচন কমিশনের কাছে এর ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু যখন সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করেন এবং ‘ব্যর্থ’ বলে মন্তব্য করেন, তখন বুঝতেই হবে নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা পাঁচে উন্নীত করেও ইসির গ্রহণযোগ্যতা আমরা বাড়াতে পারিনি।আরও দু’দফায় এ নির্বাচন সম্পন্ন হবে। কে জিতল, কে হারল- এর হিসাব হতেই পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার, তার দলের লোকজন যে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত হতে দেয় না, এটাই প্রমাণিত হল। আর নির্বাচন কমিশন পরিণত হল ‘কাগুজে বাঘে’। উপজেলা নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চাকে আরও শক্তিশালী করতে পারল না।বি.দ্র. গত ১৫ মার্চ প্রকাশিত আমার কলামের একা জায়গায় উল্লেখ করেছিলাম, জওহরলাল নেহেরু তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেসের সভাপতি বানিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। প্রকৃতপক্ষে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৫৯ সালে। Daily JUGANTOR 23.03.14
0 comments:
Post a Comment