মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশবিদ্বেষী মমতা ব্যানার্জি আবারো একটি মিথ্যাচার করলেন। বললেন, 'পশ্চিমবঙ্গকে না জানিয়ে ফারাক্কায় জল দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়_ তিস্তায় যে পানি দেবেন না, সে কথাটা জানাতেও ভোলেননি তিনি। বলেছেন নিজের ঘরে জল নেই, প্রতিবেশীকে জল দিই কীভাবে।' মমতার এই কথাবার্তা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী জনসভায় বললেও, তা বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ৭ এপ্রিল শুরু হচ্ছে ভারতের লোকসভার নির্বাচন। এ ধরনের হালকা ও চটুল কথাবার্তা বলে বাহবা পাওয়া যায়। কিন্তু এ ধরনের চটুল কথাবার্তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তিনি অতীতেও মিথ্যাচার করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। এখনো দিচ্ছেন। এতে তিনি একদিকে অবশ্য সফল_ ভোট পেয়েছেন। মানুষ ভোট দিয়ে তাকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা_ তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীর পানিবণ্টন আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে হতে হবে। মমতার 'পাগলামো'র জন্য পানিবণ্টন বন্ধ থাকতে পারে না। পানি দেয়া, না দেয়ার সঙ্গে তার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ পানি পাবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। আর পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধা দেয়, তার দায়ভার গিয়ে বর্তাবে ভারত সরকারের ওপর। এতে আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। ভারত বিশ্বসভায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদ স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর প্রতি তার আচরণ যদি ন্যায়সঙ্গত না হয়, যা জাতিসংঘের আইনে বলা আছে, তাহলে তার 'নেতৃত্ব' প্রশ্নের মুখে থাকবে। এমনিতেই ভারতের আচরণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো এ ধরনের অস্বস্তিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তিস্তায় পানি না দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে, তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ঠেলে দেবে মরুময়তার দিকে। পানির অভাবে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হবে, তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে বাড়বে। মনে রাখতে হবে তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর গাড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্দা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের বাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমোট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরো একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করারও প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ব্যয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই 'যুক্তি ও ব্যয়ের' ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নাম্বার নীতিতে বলা হয়েছে পানি উন্নয়নের ও ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ 'জলপ্রবাহ কনভেনশন' নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬ নাম্বার অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার' কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এমনভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা'র ধারণাও সমর্থন করে না। আমরা আরো আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নাম্বার অনুচ্ছেদ, জলভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নাম্বার অনুচ্ছেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।
তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায়, বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকল। গত এক সপ্তাহে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে নানা সংবাদ ছাপা হয়েছে। এখানে পানি পাওয়ার কথা ৫ হাজার কিউসেক তা এখন এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০০ কিউসেক অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ পানি পেয়েছে। এর ফলে উত্তরবঙ্গের ১২ উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির বোরো ধান পানির অভাবে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। আর তিস্তায় যে বাংলাদেশ পানি পাবে না, তা স্পষ্ট করেছেন ভারতের নেতারা। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ২১ মার্চ নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক। সেখানে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র সচিব সবার সঙ্গেই তার কথা হয়েছে। তারা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন 'লোকসভা নির্বাচনের আগে আর তিস্তা নিয়ে আলোচনা নয়। এটা কূটনৈতিক ভাষা। আদৌ তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ ১. নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপির নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হতে পারে, যারা বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল থাকবে আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর, ২. মমতার তৃণমূল কংগ্রেস তাই ফ্যাক্টর হবে। তাদের পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দেয়া নিশ্চিত নয়, ৩. বিকল্প সম্ভাবনা হচ্ছে তৃতীয় জোটের (ফেডারেলিস্ট ফ্রন্ট) নেতৃত্বে একটি সংখ্যালঘু সরকার, যেমনটি অতীতে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মমতা হবেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও শুধু মমতার আপত্তির কারণে কোনো চুক্তি হয়নি। আগামীতেও তাই হবে। মমতা কোনো চুক্তি করতে দেবেন না। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য পথ একটিই_ আন্তর্জাতিক আসরে বিষয়টি তুলে ধরা। শুধু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ যদি নিশ্চুপ থাকে এবং যদি উত্তরবঙ্গের কৃষকদের পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তা হবে আমাদের সরকারের চরম ব্যর্থতা। সরকার নিশ্চয়ই উত্তরবঙ্গের কৃষকদের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। Daily JAI JAI DIN28.03.14
0 comments:
Post a Comment