অতিসাম্প্রতিককালে
বাংলাদেশে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতাকে সামনের
সারিতে নিয়ে এসেছে। প্রথম ঘটনাটি আল-কায়েদাপ্রধান আইমান আল জাওয়াহিরির একটি
অডিও বার্তা, যেখানে বাংলাদেশে 'জিহাদের' আহ্বান জানিয়েছেন তিনি! দ্বিতীয়
ঘটনাটি রাসেল নামে এক ব্যক্তির গ্রেপ্তার, যে স্বীকার করেছে, সে নিজে ওই
বার্তাটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই রাসেল
শিবিরকর্মী। তৃতীয় ঘটনাটি জাতিসংঘের একটি সূত্র। সেই সূত্র (সিকিউরিটি
কাউন্সিল আল-কায়েদা সেংশন কমিটি) থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্মরত দুটি
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন (গ্লোবাল রিলিফ ফাউন্ডেশন ও আল হারমাইন) আল-কায়েদা
নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত। এর অর্থ পরিষ্কার, আল-কায়েদার নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে
রয়েছে। চতুর্থ ঘটনাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত জামা'আতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি)
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির প্রিজনভ্যান থেকে পলায়ন। পলায়ন বললে ভুল বলা
হবে। জঙ্গিরা ওই প্রিজনভ্যানে আক্রমণ করে ওই তিন আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
এতে গোলাগুলিতে এক পুলিশ সদস্য মারাও যান। পরে অবশ্য পলায়নকৃত তিন আসামির
একজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়।
ওই সংবাদগুলো সাধারণ একজন
পাঠক হিসেবে আমাকে বিচলিত করে। ওই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, বাংলাদেশে জঙ্গিরা
আছে এবং তারা তৎপর। জাওয়াহিরির অডিও টেপ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও পুলিশপ্রধান
যখন স্বয়ং বলেন, 'এই অডিও বার্তাটি জাওয়াহিরির', তখন আমাদের বিশ্বাস করতেই
হবে তাঁকে। কেননা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তিনি মিথ্যা কিংবা অসংলগ্ন
কথা বলতে পারেন না। তবে যেহেতু বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং একটি প্রধান
রাজনৈতিক দল এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সে ক্ষেত্রে সরকার বিদেশে,
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে ওই কণ্ঠটি পরীক্ষা করাতে পারত। কেননা
এটা তো ঠিক, আমরা কেউই ওই কণ্ঠটি সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না।
আমাদের সে রকম বিশেষজ্ঞও নেই। বিভিন্ন মহল থেকে এর সত্যতা নিশ্চিত করা
হলেও উচিত ছিল এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। কেননা টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে পড়া
একজন রাসেলকে 'উপস্থাপন' করা হয়েছে। তার কর্মকাণ্ড, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
থাকবেই। একজন অজপাড়াগাঁয়ের রাসেল কিনা ওই বার্তাটি 'আপলোড' করল! বিষয়টি কি
বিশ্বাসযোগ্য? অতীতে 'জজ মিয়ার' কাহিনী আমরা জানি। তবে জাতিসংঘের সূত্রের
বরাতে যে খবরটি পরিবেশিত হয়েছে, তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ কোনো
বাছবিচার না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে না। গ্লোবাল রিলিফ ফাউন্ডেশনের
ব্যাপারে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তা
আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে আরো খোঁজখবর
নেওয়া এবং যে দুটি সংগঠনের সঙ্গে আল-কায়েদার সম্পর্ক রয়েছে বলে বলা হচ্ছে,
তাদের ব্যাপারে আরো খোঁজখবর নেওয়া ও প্রয়োজন হলে জাতিকে তা জানানো। কেননা
এর সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটি সরাসরি জড়িত।
বাংলাদেশে
ইসলামী জঙ্গিরা রয়েছে। এরা বিভিন্ন সংগঠনের নামে এবং সংগঠনের ভেতরে কাজ
করে। জেএমবি যে কত তৎপর, তার প্রমাণ আমরা পেলাম ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্যে
পুলিশের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করে জেএমবির ক্যাডারদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায়!
এই ঘটনাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আসামিদের এক জেল থেকে অন্য জেলে
ট্রান্সফারের ঘটনা স্বাভাবিক। কিন্তু জেএমবির ক্যাডার বলে কথা। তারা
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তাদের যখন পরিবহন করা হয়, তখন কি যথোপযুক্ত নিরাপত্তা
দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? এই তথ্যটি সীমিত কিছু ব্যক্তির জানার কথা। তাহলে
এই তথ্যটি ফাঁস হলো কিভাবে? এটা তো ঠিক, বাংলাদেশের বেশ কিছু ব্যক্তি আশির
দশকে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন তালেবানদের পক্ষে দখলদার সোভিয়েত সৈন্যদের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। তাদের উদ্যোগেই তো জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের মতো
সংগঠনের জন্ম হয়েছে। তাদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে সত্য, কিন্তু
আরো অনেকে আছেন, যাঁরা জনসাধারণের মধ্যে মিশে আছেন। আমি জানি না, আমাদের
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তাঁদের পূর্ণ তালিকা আছে কি না? না থাকলে এ
কাজটি এখন করা উচিত। ওপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো আমাদের নীতিনির্ধারকদের বেশ
কিছু মেসেজ দিয়ে গেল। নিশ্চয়ই তাঁরা এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাববেন।
প্রসঙ্গক্রমেই
আল-কায়েদা নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এটা সত্য, ওসামা বিন লাদেনের
মৃত্যুর (হত্যা?) পর আমি কালের কণ্ঠে একাধিক নিবন্ধ লিখেছি আল-কায়েদার
ভবিষ্যৎ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। আমি বলার চেষ্টা করেছি, আল-কায়েদা তার
স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন এনেছে। যাঁরা এই স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে ধারণা না
রাখেন, তাঁদের পক্ষে আল-কায়েদা সম্পর্কে বলা ঠিক নয়।
বাংলাদেশে
আল-কায়েদার নেটওয়ার্ক কাজ করছে- এমন একটা কথা আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই শুনে
আসছি। কিন্তু আমি গবেষণা করে দেখেছি, আল-কায়েদার যে স্ট্র্যাটেজি, যেভাবে
তারা অপারেশন পরিচালনা করে, বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায় না। আল-কায়েদার
তাত্ত্বিক হচ্ছে আবু মুসাব আল সুরি। তাঁর একটি গ্রন্থ রয়েছে, 'গ্লোবাল
রেজিসট্যান্স মুভমেন্ট। তাঁর 'স্পাইডার ওয়েব' (spider web) তত্ত্বটি এখন
ইসলামিক জঙ্গিদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। মাকড়সারা যেভাবে জাল বিস্তার করে এবং
জাল নষ্ট হয়ে গেলে অন্য জায়গায় গিয়ে জাল বোনে, আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত
জঙ্গিরা এভাবেই তাদের অপারেশন পরিচালনা করে। তবে ইয়েমেন থেকে শুরু করে
সিরিয়া পর্যন্ত তারা বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনকে তাদের সহযোগী সংগঠন বলে মনে
করে এবং তাদের সাহায্য করে। ২০০০ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলে গঠিত হয়েছে।
Al-Qaeda in Arabian peninsula, Al-Qaeda in Islamic Maghreb, Al-Qaeda in
Iraq. এগুলো হচ্ছে আল-কায়েদার স্থানীয় সংগঠন। এর বাইরে বেশ কিছু সংগঠন
রয়েছে, যাদের সঙ্গে আল-কায়েদার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, আল-গামা
আল-ইসলামিয়া (মিসর), আল-নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া) ইত্যাদি। গাদ্দাফি-পরবর্তী
লিবিয়া কিংবা তিউনিসিয়ায় তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। সোমালিয়ার
আল-সাহাব কিংবা কেনিয়ার বোকো হারাম গ্রুপের সঙ্গেও রয়েছে তাদের যোগাযোগ।
লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ মালিতে ইতিমধ্যে এরা শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে। ইয়েমেনের
বিস্তীর্ণ অঞ্চল আল-কায়েদার নিয়ন্ত্রণে, যে কারণে আলী আবদুল্লাহ
সালেহ-পরবর্তী ইয়েমেনে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি এবং সেখানে এখনো ড্রোন বিমান
হামলা অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং আল-কায়েদার বাংলাদেশে কোনো সম্পর্ক আছে কি
না, এটা বুঝতে হলে আমাদের আল-কায়েদার ইতিহাস ও স্ট্র্যাটেজি বুঝতে হবে।
আল-কায়েদা শরিয়াহ ভিত্তিতে দেশ চালানোর পক্ষে। নুসরা ফ্রন্ট সিরিয়ায় একটি
'ইসলামিক আমিরাত' প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এমনকি আফগানিস্তানের তালেবানের একটি
গ্রুপও আফগানিস্তানকে 'ইসলামিক আমিরাত'-এ পরিণত করতে চায়। ইয়েমেনেও
আল-কায়েদা তেমনটি চায়। এখন বাংলাদেশে যাদের আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন হিসেবে
চিহ্নিত করা হচ্ছে, তারা কী আদৌ এই 'রাজনীতিতে' বিশ্বাস করে?
যে
পাঁচটি সংগঠনকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের রাজনীতি নিয়ে
গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের নথিতে যে দুটি সংগঠনের
অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, তাদের কর্মকাণ্ড, কাদের তারা 'ফান্ড' দিয়েছে, ওই
ফান্ড বা অর্থ দিয়ে কী ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে, তা দ্রুত অনুসন্ধান
করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে একটা সেমিনার হয়ে
গেল গত ২২ ফেব্রুয়ারি। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একটি সংলাপের আয়োজন করে
এবং মিডিয়া তা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। এ ধরনের সেমিনার বা সংলাপের
গুরুত্ব রয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি কোনো
শিক্ষাবিদকে, যাঁরা নিরাপত্তা তথা সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের
আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সেনা কর্মকর্তারা, যাঁরা আমন্ত্রিত ছিলেন, তাঁরা
সন্ত্রাসবাদের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, এর ধরন, এর স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কতটুকু
কাজ করেন, আমার তাতে সন্দেহ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের (সরকারি, বিরোধী)
অনুপস্থিতির কী যুক্তি থাকতে পারে, আমি জানি না। তিনজন ইসলামী ব্যক্তিত্বের
উপস্থিতি আমি দেখেছি। তাঁরা বিতর্কিত নানা কারণে। তাঁদের উপস্থিতি
বাংলাদেশে পুরো ইসলামী সমাজের প্রতিনিধিত্ব ধরা হলে ভুল হবে। বাংলাদেশে
জঙ্গিবাদ উত্থানে (১) সরকারি বক্তব্য, (২) প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কিভাবে
তা দেখছে, ৩) জামায়াতকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত বলে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে
জামায়াতের বক্তব্য, (৪) আফগান-ফেরত কোনো মুজাহিদের বক্তব্য ইত্যাদি জানা
প্রয়োজন ছিল। শুধু সেমিনার করে জঙ্গিবাদ বন্ধ করা যাবে না। চাই গণসচেতনতা।
ইসলাম যে জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না, এর ব্যাপক প্রচারণা দরকার। আমাদের
দেশের ইসলামিক রাজনীতিতে যাঁরা সক্রিয়, তাঁদের দিয়ে এই কাজটি হবে না। এ
কাজে ইসলামিক স্কলার তথা শিক্ষাবিদদের নিয়োজিত করতে হবে। মাদ্রাসাগুলো
মনিটরিং করাও প্রয়োজন। বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রচুর
গবেষণা করা দরকার। এ দেশে বেশ কিছু গবেষক রয়েছেন। তাঁদের দিয়ে এই কাজটি
করানো যায়। ওপরে উল্লিখিত সংলাপে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রকৃত চিত্র ফুটে
উঠেছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে জঙ্গি রয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত
বা সীমিত হলেও তারা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইয়ের
উত্থান ও সর্বশেষ জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা এর বড় প্রমাণ। এ ব্যাপারে জাতীয়
ঐকমত্য গড়ে তোলাও প্রয়োজন।
Daily Kalerkontho
06.03.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment