শুষ্ক
মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই তিস্তার পানি প্রাপ্তির যে ভয়াবহ চিত্র সংবাদপত্রে
প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের দুশ্চিন্তাকে শুধু বাড়িয়েই দিচ্ছে না, বরং
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার দিকটাই প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। বিগত জোট
সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি হলেও, আমাদের বড়
ব্যর্থতা ছিল আমরা তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তি করতে পারিনি।
শুধু তাই নয়_ একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু অমীমাংসিত
বিষয় রয়েছে, যার কোনো সমাধানও হয়নি। ৭ এপ্রিল ভারতে লোকসভার নির্বাচন শুরু
হচ্ছে। মে মাসের শেষ দিকে ভারত একটি নয়া সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। তাতে
তিস্তাসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
কেননা সম্ভাব্য একটি বিজেপি সরকার বিরাজমান সমস্যাগুলোর ব্যাপারে কখনো
ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। ফলে বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি কোয়ালিশন সরকার যদি
ক্ষমতা পায় (জনমত জরিপ অনুযায়ী), তাহলেও তিস্তার পানিবণ্টনের সম্ভাবনা
ক্ষীণ। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের করণীয় এখন কী হবে? শুধু
তিস্তার পানিবণ্টনই নয়, ফারাক্কা চুক্তি নিয়েও কথা আছে। টিপাইমুখ বাঁধ,
ফুলেরতল ব্যারাজ, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ইত্যাদি নানা প্রশ্ন এখন
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। গত ৫ বছরে ভারতের রাষ্ট্রপতি
থেকে শুরু করে একাধিক মন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে বারেবারে প্রতিশ্রুতি
দিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষিত হয়নি। তাই ভাটির দেশ হিসেবে
বাংলাদেশের পানির যে প্রাপ্যতা, তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক আসরে সমস্যাটি
তুলে ধরা ছাড়া কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। শুধু 'বন্ধুত্বের
নিদর্শনস্বরূপ আমরা ভারতকে ছাড় দেব, আর ভারত আমাদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে
পারবে না, তাতো হতে পারে না!
অনেক ইস্যুর মধ্যে তিস্তা একটি বড় ইস্যু। বিমসটেক সম্মেলনে মনমোহন সিং
জানিয়ে দিয়েছেন তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব নয়। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক শেষ
হয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশ ব্যর্থ। ভারতীয় পক্ষ কোনো ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি।
সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যেখানে তিস্তায় ৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা,
সেখানে আছে মাত্র ৫০০ কিউসেক। কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে
উত্তরবঙ্গ, এই পরিসংখ্যান বোঝার জন্য তা যথেষ্ট। সুতরাং পররাষ্ট্রনীতিকে
ঢেলে সাজাতে হবে। ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ভারতের সংবিধানে রাজ্যের মতামতের
গুরুত্ব থাকায় কেন্দ্র এককভাবে কোনো চুক্তি করতে পারে না। এই সংবিধান
সংশোধন করাও সহজ নয়। অতীতে বিজেপির সমর্থন এতে পাওয়া যায়নি। এমনকি ভারতের
রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সীমান্ত সমস্যার
সমাধান হবে বলে মন্তব্য করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এটি নিয়েও সমস্যা রয়েছে।
সীমান্ত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেও সংবিধান সংশোধন জরুরি। বাংলাদেশ-ভারত
একটি সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল ১৯৭৪ সালে। বাংলাদেশ ওই চুক্তি
বাস্তবায়ন করতে সংবিধানে সংশোধনী এনেছে (তৃতীয় সংশোধনী ১৯৭৪)। কিন্তু দীর্ঘ
৩৯ বছরেও ভারত তাদের সংবিধানে সংশোধনী এনে চুক্তিটি 'রেটিফাই' করেনি। ফলে
ছিটমহলগুলো নিয়ে যে সমস্যা, তা রয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের ভূখ-ে আছে
১৭ হাজার ১৪৯ একর ভারতীয় ভূমি। আর ভারতের ভূখ-ে আছে ৭ হাজার ১১১ একর
বাংলাদেশি ভূমি। এসব অঞ্চলের মানুষ এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জি সীমান্ত সমস্যার
সমাধানের কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। দীর্ঘদিন পর ভারতীয় মন্ত্রিসভায় ১৯৭৪
সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের
প্রশ্নটি এর সঙ্গে জড়িত। সংবিধান সংশোধনে কংগ্রেস সমর্থন পায়নি তৎকলীন
প্রধান বিরোধী দল বিজেপির। মন্ত্রিসভায় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদন ও
কংগ্রেস কর্তৃক অতি সম্প্রতি সংবিধান সংশোধনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও,
বিজেপি বলেছিল তারা এ সংশোধনীর বিরোধিতা করবে। ফলে সমস্যা যা ছিল, তা রয়ে
গেছে। শেষ পর্যন্ত সংবিধান সংশোধনের বিলটি লোকসভায় ওঠেনি আর। কংগ্রেস
নেতাদের আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন নেই। হয়তো তারা সত্যি সত্যিই চান
সমস্যাগুলোর সমাধান হোক! বিজেপির পাশাপাশি সমস্যা ভারতের আমলাতন্ত্র নিয়েও।
সেই সঙ্গে রয়েছে ভারতের নীতিনির্ধারকদের 'মাইন্ড সেটআপ'। তারা বাংলাদেশকে
কখনো সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেছে, এটা আমি মনে করি না। ভারত বড় দেশ। আগামী
৩০ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। ভারতে
প্রচ- দরিদ্রতা থাকলেও, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২
হাজার ডলার। ভারতের এ অর্থনীতি আমাদের অর্থনীতিকেও গ্রাস করবে। আমাদের
উন্নয়নে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে তেমনটি হচ্ছে না। দেখা
গেছে দ্বিপক্ষীয়তার বেড়াজালে ভারত এককভাবে সুবিধা নিচ্ছে। বিভিন্ন ইস্যুতে
যে সমস্যা রয়েছে তা সমাধানে ভারতের আগ্রহ কম। সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়ায়
তা বাংলাদেশি মানুষকে ভারতবিদ্বেষী করে তুলেছে। ভারতীয় ঋণে ১৩টি প্রকল্প
নির্ধারিত হলেও, গত ২ বছরে মাত্র ৫টি প্রকল্পের কাজ শেষপর্যায়ে হয়েছে।
বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশি পণ্যের আমদানি বাড়ায়নি ভারত। নানা ধরনের
শুল্ক ও অশুল্ক বাধায় বাংলাদেশি পণ্য চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় বাজারে
প্রবেশ করতে পারছে না। বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, তাতে
ভারতের স্বার্থ বেশি। কানেকটিভিটির আড়ালে ভারতকে ট্রানজিট বা করিডোর দিলেও,
নেপাল ও ভুটানের জন্য তা সম্প্রসারিত হয়নি। পানি ব্যবস্থাপনার কথা
বাংলাদেশি নেতারা বলেছেন বটে, কিন্তু এখানে ভারতের কোনো উদ্যাগ কখনো
পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ২০১১ সালে মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ
সম্মেলন শেষ হয়। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভুটান, ভারত, নেপাল ও
চীনকে নিয়ে 'গঙ্গা নদী অববাহিকা সংস্থা' ও 'ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা
সংস্থা' গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সদ্যসমাপ্ত বিমসটেক সম্মেলনেও তিনি
বলেছেন সে কথা। কিন্তু ভারত তাতে সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের প্রচ- বিদ্যুৎ
ঘাটতি কমাতে সিকিম থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা বাংলাদেশ বললেও, ভারত তাতে
সম্মতি দেয়নি। (ভারতীয় এলাকার ওপর দিয়ে এই বিদ্যুৎ আনতে হবে)। 'কুনমিং
উদ্যাগ'-এর ব্যাপারেও ভারতের সম্মতি (বিসিআইএম) নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কিংবা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে
শঙ্কা, সে শঙ্কা দূর করতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি ভারত। বরং একটা ধূম্রজাল
সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়েও ভারতের সঙ্গে আমাদের বিপদ আছে, যা এখন
হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন।
তাই ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের পর যে প্রশ্নটি থেকেই গেল, তা হচ্ছে এই
নির্বাচনের পর সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা আছে, তা কি কাটবে? এখানেই
এসে যায় মূল প্রশ্নটি। ভারতীয় 'মাইন্ড সেটআপ'ও যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে
সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্নতি আসবে না। ভারতকে উদার মনোভাব নিয়ে আসতে হবে। আরো
একটা কথা_ তিস্তাসহ বিভিন্ন সমস্যা বাংলাদেশের কোনো দলের সমস্যা নয়। এটা
জাতীয় সমস্যা। এই জাতীয় সমস্যাগুলোর ব্যাপারে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও
বিএনপির এক হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তা হয়নি। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য নবম সংসদে
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যেসব সমস্যা বিদ্যমান, সেসব সমস্যার সমাধানের
ব্যাপারে কিংবা সমস্যাগুলো নিয়ে সংসদে আদৌ আলোচনা হয়নি। একবার একটি সংসদীয়
প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ দেখতে গিয়েছিলেন। এর ফলাফল কী ছিল, আমরা সবাই তা
জানি। নয়াদিলি্লতে ভারতীয় পানিসম্পদমন্ত্রীর সঙ্গে চা-পান করা আর
হেলিকপ্টার ভ্রমণ ছাড়া আমাদের প্রাপ্তির খাতায় 'শূন্য'। সুতরাং ভারতনির্ভর
পররাষ্ট্রনীতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে, সমস্যাগুলো যা ছিল, সেভাবেই রয়ে
যাবে, বরং সমস্যারগুলোর গভীরতা আরো বাড়বে।
তিস্তার বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বাংলাদেশকে
এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের আগে আমাদের
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা
উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের বৈঠক হয়েছে। আমার কাছে যে বিষয়টি অস্পষ্ট, তা
হচ্ছে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এ সময়টা বেছে নিলেন কেন? যদি জনমত সমীক্ষা সত্য
প্রমাণিত হয়, তা হলে তার উচিত ছিল জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করা। অথবা এ সফরে
ভারতের বিজেপির নেতাদের সঙ্গে দেখা করা। শিবশঙ্কর মেননের সঙ্গে আলাপ করে
আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করতে পারব, জানি না। কেননা
বিরাজমান সমস্যাগুলোর 'চরিত্র' রাজনৈতিক। একটি রাজনৈতিক সরকারই এ ব্যাপারে
সমাধান দিতে পারবে। শিবশঙ্করের মতো একজন আমলা, এ সমাধান দেবেন না। এ
আমলাদের কারণেই সমস্যাগুলো ঝুলে আছে।
তিস্তার পানির প্রাপ্যতা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিস্তার
পানি না থাকায় তিস্তা ব্যারাজ এখন অকার্যকর। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর
জেলার ১২ উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর বোরো আবাদ এখন সেচের অভাবে মরতে
বসেছে। কৃষকরা পানি পাচ্ছে না। এ এলাকার কৃষকদের সড়ক ও মহাসড়কে বিক্ষোভ,
কিংবা তিস্তার বুকজুড়ে চরের ছবি আমাদের নেতাদের চিন্তার খোরাক কতটুকু
জোগাবে জানি না, বাস্তবতা হচ্ছে_ আমাদের ন্যায্য অধিকারের ব্যাপারে
'লড়াইটা' আমাদেরই করতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের আন্তর্জাতিক দরবারেই যেতে হবে।
Daily JAI JAI DIN
18.03.14
0 comments:
Post a Comment