শেষ
পর্যন্ত যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা-ই হয়েছে। ১৬ মার্চ ইউক্রেনের
স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ক্রিমিয়ায় স্বাধীনতা প্রশ্নে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
ওই গণভোটে শতকরা ৯৭ ভাগ ভোট পড়ে স্বাধীনতার পক্ষে। গণভোটের ফলের মাত্র ২৪
ঘণ্টার মধ্যে ক্রিমিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া। এর
পরপরই ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করার ব্যাপারে মস্কোর কাছে আবেদন
জানায়। আর ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিন
ক্রিমিয়াকে রুশ ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত করার একটি খসড়া বিলে স্বাক্ষর
করেছেন। রাশিয়ার পার্লামেন্ট 'ডুমা'য় এখন বিলটি অনুমোদিত হবে। প্রায়
দু'সপ্তাহ ধরে ক্রিমিয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হয়ে
আসছে। এমন কথাও বেশ জোর দিয়ে বলা হচ্ছে যে, ক্রিমিয়ার ব্যাপারে রাশিয়ার
সিদ্ধান্ত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়ার মধ্য
দিয়ে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়েছে। এটা বাহ্যত পরিণত হয়েছে রাশিয়ার
সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব হিসেবে। এখন এ দ্বন্দ্ব ক্রিমিয়া ছাড়িয়ে
বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়বে, যেমনটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল
স্নায়ুযুদ্ধের। সেটা ছিল মূলত আদর্শিক দ্বন্দ্ব_ একদিকে ছিল পুঁজিবাদ,
অন্যদিকে সাম্যবাদ।
এক সময় এ সাম্যবাদের প্রভাব ঠেকাতেই পশ্চিম
ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জন্ম হয়েছিল সামরিক জোট ন্যাটোর। অপরদিকে
পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো নিয়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করেছিল
সামরিক জোট ওয়ারশ। একপর্যায়ে সেখানে 'যুদ্ধের' সম্ভাবনাও জন্ম নিয়েছিল_
যদিও যুদ্ধ হয়নি। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এ 'যুদ্ধে' জড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৯১
সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসান ঘটে
স্নায়ুযুদ্ধের। আজ প্রায় ২৩ বছর পর নতুন আঙ্গিকে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হচ্ছে!
এখানে আদর্শিক দ্বন্দ্ব নেই বটে, কিন্তু প্রভাব বলয় বিস্তারের এক ধরনের
নগ্ন প্রতিযোগিতা আছে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব
করার যে প্রবণতা এবং রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার ন্যাটোর যে স্ট্র্যাটেজি, তা
রাশিয়ার সমরনায়কদের অজানা নয়। ভুলে গেলে চলবে না, ক্রিমিয়ার ব্যাপারে
রাশিয়ার স্বার্থ রয়েছে অনেক। ক্রিমিয়ার পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণসাগর বা 'ব্ল্যাক
সি'র পশ্চিম পাশে রুমানিয়ার মিহাইল কোগালনাইসেআনুতে রয়েছে ন্যাটোর
বিমানঘাঁটি। এ বিমানঘাঁটির গুরুত্ব অনেক। আফগানিস্তানে সেনা ও রসদ সরবরাহের
জন্য ট্রানজিট রুট হিসেবে এ বিমান ঘাঁটিটি ব্যবহৃত হয়। শুধু তা-ই নয়,
কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্ব আরও একটি কারণে। এখানে অবস্থান রয়েছে ন্যাটোর জয়েন্ট
টাস্কফোর্স ইস্টের
কৃষ্ণ সাগরভুক্ত তিনটি দেশ রুমানিয়া,
বুলগেরিয়া আর তুরস্ককে নিয়ে ন্যাটো গেল বছর তাদের তিন মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ
পরিচালনা করেছে। এটা রাশিয়ার ওপর এক ধরনের স্নায়বিক চাপ। ভূরাজনৈতিক
বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন থেকেই কৃষ্ণ সাগরভুক্ত এলাকা; সেই সঙ্গে কাস্পিয়ান
সাগরভুক্ত অঞ্চলকে 'হট এরিয়া', অর্থাৎ উত্তেজনাপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত
করে আসছেন। সুতরাং ক্রিমিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রাশিয়ানদের (জনসংখ্যার ৫৯ ভাগ,
প্রায় ২০ লাখ) নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই যে রাশিয়া 'হস্তক্ষেপ' করেছিল,
তা বিবেচনায় নিলে ঠিক হবে না। রাশিয়ায় 'নয়া জার' নেতৃত্ব রাশিয়ার
নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ক্রিমিয়ায় বসবাসকারী রাশানদের নিরাপত্তার
পাশাপাশি তাদের নিজেদের ভূখ-গত নিরাপত্তার বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরো
কৃষ্ণ সাগরভুক্ত অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব করার জন্যই ন্যাটোর দরকার
জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেয়া। তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে উপস্থিত
থাকবে ন্যাটোর সেনাবাহিনী। এটা রাশিয়ার ওপর এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক চাপ।
রাশিয়ার সমরনায়করা তা যে মেনে নেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, গেল বছর
কৃষ্ণ সাগরে ন্যাটো ও জর্জিয়ার নৌবাহিনী যৌথভাবে একটি সামরিক কার্যক্রমে
অংশ নিয়েছিল, যা রাশিয়া খুব সহজভাবে নেয়নি। এখানে ক্রিমিয়ার বিষয়টিও
আলোচনা করা প্রয়োজন। ক্রিমিয়া সরাসরিভাবে ইউক্রেনের মূল ভূখ-ের অংশ নয়। এ
অংশটি ইউক্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ ১৯৫৪
সালে এ অংশটুকু ইউক্রেনকে দেন। এর আগে এটা রাশিয়ার অংশ ছিল। এখানে মূল
জনগোষ্ঠী রাশান। ২৪ ভাগ জনগোষ্ঠী ইউক্রেনিয়ান, আর ১২ ভাগ তাতার। ইউক্রেনের
মোট জনগোষ্ঠীর (৪৫ মিলিয়ন) ১৭ ভাগ হচ্ছে রাশান বংশোদ্ভূত। ইউক্রেন ১৯২২
সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল এবং ১৯৯১ সালের
ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ক্রিমিয়া থেকে যায় রাশিয়ার সঙ্গে। ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সেনাবাহিনীর 'অভিযান',
সেখানে ইউক্রেনের নৌঘাঁটি দখল পরিস্থিতিকে তখন আরও জটিল করে দেয়।
ক্রিমিয়ার
পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট
অবনতি হয়েছে। ক্রিমিয়ার পার্লামেন্ট রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির একটি
সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৬ মার্চ এ লক্ষ্যে সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। অথচ
প্রেসিডেন্ট ওবামা এ সিদ্ধান্তকে 'অবৈধ ও আন্তর্জাতিক আইনের' পরিপন্থী
হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ৩০০ নৌবাহিনী সজ্জিত ডেসট্রয়ার
ইউএসএস টুস্ক্রটানকে কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে পাঠিয়েছে। পাঁচটি যুদ্ধবিমান
মোতায়েন করেছে বাল্টিক অঞ্চলে। ওবামা পুতিনের সঙ্গে দীর্ঘ কথা বলেছেন।
কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তিনি রাশিয়াকে ইউক্রেনের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা
বলা, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের ক্রিমিয়ায় যাওয়া ও ক্রিমিয়া থেকে সব রুশ
সৈন্য (১৬ হাজার) প্রত্যাহারের দাবি করেছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার মনোভাবের
পরিবর্তন তাতে হয়নি। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তিকে তিনি অনুমোদন
দিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কিছু রাশান নাগরিকের (যারা
ক্রিমিয়ায় আগ্রাসনের সঙ্গে জড়িত) বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ভিসা বাতিল ও
রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে। প্রায় একই পথ অবলম্বন করেছে ইউরোপীয়
ইউনিয়ন। রাশিয়া-ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংলাপ এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ১৯৯৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে 'Budapest
Memorandum on Security Assurances' চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ওই চুক্তির
বিনিময়ে ইউক্রেনের কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, তা রাশিয়াকে ফেরত দেয়া
হয়। ওই সময় ইউক্রেন ক্রিমিয়ায় কর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছিল বটে, কিন্তু রাশিয়াকে
তার 'ব্ল্যাক সি ফ্লিট' এ অঞ্চলে (সেবাস্তোপোল) মোতায়েন এবং রাশিয়ার
সেনাবাহিনী মোতায়েনের অধিকার দেয়া হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী এ সেনা মোতায়েন
থাকার কথা ২০৪২ সাল পর্যন্ত। ইউক্রেন অবশ্য এ থেকে একটি 'ফি' পাবে। জুন
মাসে সোচিতে জি-৮ সম্মেলনও এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে।
এখন ১৬ মার্চের
গণভোটে ক্রিমিয়া যে রাশিয়ার অঙ্গ হলো এবং গণভোটে তাদের যে মতামত প্রতিফলিত
হলো, তাতে দ্বিমত করার আর কোনো সুযোগ নেই। ফলে নতুন করে শুরু হবে
'স্নায়ুযুদ্ধ'। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থেই রাশিয়ার ব্যাপারে এখন আরও
কঠোর হয় (সীমিত অর্থনৈতিক অবরোধের সিদ্ধান্ত), তাহলে রাশিয়াকে বাধ্য করবে
একাধিক সিদ্ধান্ত নিতে। যেমন বলা যেতে পারে, রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ
বন্ধ করে দিতে পারে। কিংবা আফগানিস্তানে সব ধরনের সরবরাহ লাইনে
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ধক্ষংসের
ব্যাপারে রাশিয়া বিরোধিতা করতে পারে এখন। ইরানকে অস্ত্র তথা বিমানবিধক্ষংসী
অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে রাশিয়া। চীনের সঙ্গে সামরিক তথা অর্থনৈতিক
সম্পর্ক বৃদ্ধি করবেন পুতিন। এতে করে বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে মাত্র। বলা
ভালো, ক্রিমিয়া সঙ্কটে চীন ও ভারত রাশিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চীনের সঙ্গে
সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন নামক একটি সামরিক তথা অর্থনৈতিক ব্লক গড়ে
তুলেছে রাশিয়া (জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এর সদস্য)। একই
সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো নিয়ে রাশিয়া গড়ে তুলছে
একটি সামরিক জোট 'কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন' (সিএসটিও)।
ওয়ারশ'র পরিবর্তিত করে করা হচ্ছে এই সিএসটিও।স্পষ্টই ক্রিমিয়ার
সঙ্কট বিশ্বে অস্থিরতা বাড়াবে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থেই যদি কোনো
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে পশ্চিম ইউরোপ
(বিশেষ করে জার্মানি), যারা রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। একটা
পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাসের রিজার্ভ
হচ্ছে রাশিয়াতে। মূলত তিনটি পথে এ গ্যাস যায় ইউরোপে। সাবেক পূর্ব ইউরোপের
দেশগুলো, যারা এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্লকে ছিল, তারাও এখন রাশিয়ার
গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তিনটি পাইপলাইন, নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের মাধ্যমে
সরবরাহ করা হয় বছরে ৫৫ মিলিয়ন কিউসেক মিটার (বিসিএম), বেলারুশ লাইনে সরবরাহ
করা হয় ৩৬ বিসিএম, আর ইউক্রেন লাইনে সরবরাহ করা হয় ১০৭ বিসিএম। এখন ইইউর
নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া যদি এ সরবরাহ বন্ধ করে
দেয়, তাহলে বড় ধরনের জ্বালানি সঙ্কটে পড়বে ইউরোপ। যদিও রাশিয়ার বৈদেশিক
আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গ্যাস বিক্রি। এটা সত্য, রাশিয়া অত্যন্ত সস্তায়
বেলারুশ ও ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দেশ দুটো
আবার রাশিয়ার গ্যাসের রিজার্ভ গড়ে তুলে সরাসরি পশ্চিম ইউরোপে তা বিক্রি করে
কিছু 'আলাদা অর্থ' আয় করে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০০৯ সালে ইউক্রেন ও
বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার এক ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, যাকে বলা হয়েছিল
'গ্যাস ওয়ার' অর্থাৎ গ্যাস যুদ্ধ। ইউক্রেনে অত্যন্ত সহজ মূল্যে গ্যাস
সরবরাহ করত রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যা
ইউরোপে একটি সঙ্কট তৈরি করে। শুধু গ্যাস নয়, রাশিয়া বেলারুশকে সস্তা দামে
তেলও দেয়। ওই তেল আবার বেলারুশ অধিক মূল্যে ইউরোপে বিক্রি করে। Druzhba
অথবা Friendship পাইপলাইনের মাধ্যমে এ গ্যাস ও তেল সরবরাহ করা হতো।
বেলারুশের ক্ষেত্রেও একটি সমস্যা হয়েছিল। তারা অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ
হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল। রাশিয়া পাইপলাইনে গ্যাস ও তেল সরবরাহ
বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন আবার নতুন আঙ্গিকে এ 'গ্যাস ওয়ার' শুরু হবে।ক্রিমিয়া
এখন রাশিয়ার অংশ হওয়ায় ইউক্রেন এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান
পতাকা উঠেছে। সেখানে যে ইউক্রেনের নৌ ঘাঁটি রয়েছে তা দখল করে নিয়েছে
রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল একটি গ্রুপ। সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে
রাশিয়া তার ইউক্রেন পাইপলাইন বন্ধ করে দিতে পারে। আর এটা হলে বুলগেরিয়া,
রুমানিয়া আর সার্বিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এই তিন দেশের শিল্প
প্রতিষ্ঠান গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়ার গ্যাস
সরবরাহ সংস্থা গ্যাসপ্রম (Gasprom) এর ইউক্রেনের কাছে পাওনা রয়েছে দুই
মিলিয়ন ডলার। এ টাকা তখন ইউক্রেন কীভাবে শোধ করবে? এই সঙ্কট এখানে যুদ্ধের
সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনকে বাইপাস করে কৃষ্ণ
সাগরের নিচ দিয়ে একটি পাইপলাইন তৈরি করছে। সমগ্র ইইউর গ্যাসের চাহিদার ৩০
ভাগ একা জোগান দেয় রাশিয়া। আর জার্মানির ৪০ ভাগ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এই
গ্যাস আগামী দিনে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হবে ইউরোপের রাজনীতিতে। অনেকেই
স্মরণ করতে পারেন, মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, বিশেষ করে ইরাক ও
লিবিয়ায়, তার পেছনের মূল কারণ ছিল তেল। ইরাক ও লিবিয়ার তেলের সহজলভ্যতার
কারণে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর মদতে সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যুদ্ধে
ইরাককে ধক্ষংস করে দিয়ে তখন মার্কিন কোম্পানিগুলোই ওই তেল বিক্রির টাকায়
ইরাক পুনর্গঠনের কাজ করছে। আর লিবিয়ার তেল ও গ্যাস যায় ইতালিতে। গাদ্দাফিকে
প্রাণ দিতে হয়েছিল এ তেল-গ্যাসের কারণেই। সুতরাং রাশিয়ার গ্যাসের ওপর পুরো
ইউরোপের নির্ভরতা সেখানে নতুন করে 'গ্যাস যুদ্ধ'-এর সূচনা করবে। তবে
পার্থক্য একটাই, রাশিয়া ইরাক কিংবা লিবিয়া নয়; পুতিনের পেছনে রয়েছে রাশিয়ার
সেনাবাহিনী।
এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
ক্রিমিয়ার ঘটনার পর যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে এ অঞ্চলের অন্যত্র যেখানে
রাশান জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে? রাশিয়া কী
এসব অঞ্চলকেও উৎসাহিত করবে ক্রিমিয়ার পথ অবলম্বন করতে? ইউক্রেনের
ক্রিমিয়াতেই যে রাশান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তা নয়। বরং ইউক্রেনের
পূর্বাঞ্চলে, যেখানে রুশ ভাষাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে কী হবে?
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ, দনেৎস্ক ও লুগা রুশ জনসংখ্যা অধ্যুষিত
অঞ্চল। আবার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ওদেসা, খেরসন ও মিকোলায়েভ শহরেও রয়েছে রুশ
জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য। পুতিন এক্ষেত্রে কী করবেন? ইউক্রেনে আগামী দিনে
বসনিয়ার মতো পরিস্থিতির জন্ম হয় কিনা, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের।
অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, পুতিন রাশিয়ার সীমান্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের
সীমানায় নিয়ে যেতে চান। আর এ লক্ষ্যেই রাশিয়া কাজাখস্তান ও বেলারুশের
সমন্বয়ে একটি 'ইউনিয়ন স্টেট' গঠন করেছে। এর মাধ্যমে এক ধরনের 'কাস্টম
ইউনিয়ন' গঠন করে এ দুটো দেশের অর্থনীতি তথা বাণিজ্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল
করে তোলা হয়েছে। এ ইউনিয়ন স্টেটেও এ অঞ্চলের আরও অনেক রাষ্ট্র আগামীতে যোগ
দিতে পারে। সুতরাং রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযুক্তিকে হালকাভাবে দেখার
সুযোগ নেই।
ক্রিমিয়ার ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে
পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। চলতি সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট
বারাক ওবামা ইউরোপ সফরে আসছেন। ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে তার আলোচনায়
ক্রিমিয়ার বিষয়টি যে প্রাধান্য পাবে, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। এরই
মধ্যে জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ন্যাটো রাশিয়ার সীমান্তবর্তী
পোল্যান্ডে যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করেছে। সব মিলিয়ে ক্রিমিয়ার ঘটনাবলি
স্নায়ুযুদ্ধ-২ এর সূচনাই করল।
Daily ALOKITO BANGLADESH
23.03.14
0 comments:
Post a Comment