বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে। উগ্র ডানপন্থী উত্থান ঘটেছে ইউরোপে, যারা নতুন করে ইউরোপের ইতিহাস লিখতে চায়। ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থী উত্থানের পাশাপাশি এখন জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থী তথা নব্য নাজির উত্থান ইউরোপের রাজনীতি বদলে দিতে পারে
স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়া নিয়ে যে সংকটের শুরু, তার এখনও কোনো সমাধান হয়নি। সংকটের গভীরতা বাড়ছে। গেল ১ অক্টোবর সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়েছিল। শতকরা ৯০ শতাংশ কাতালোনিয়ার নাগরিক স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা পুইজমন্ট বলেছিলেন, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কিন্তু স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার এর সমালোচনা করেছিল। কাতালোনিয়ার গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ায় চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে অনেক দেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। স্পেন সরকার এর সমালোচনা করেছে এবং স্পেনের একটি সাংবিধানিক আদালত বলেছেন, ১৯৭৮ সালের সংবিধানের ডিক্রি অনুসারে দেশকে বিভক্ত করা যাবে না; শুধু জাতীয় সরকারই গণভোটের আয়োজন করতে পারে। কিন্তু কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা স্বাধীনতার প্রশ্নে অনড়। এক্ষেত্রে কাতালোনিয়া যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে স্পেন সরকার সংবিধানের ১৫৫ ধারা প্রয়োগ করতে পারে। স্পেনের পার্লামেন্ট কাতালোনিয়ার জন্য যে স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, তা বাতিল করতে পারে। পার্লামেন্ট একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতাকামীরা তা মানবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। বলা ভালো, কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ৭৫ লাখ ২২ হাজার। স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ মানুষ কাতালোনিয়ায় বসবাস করে। এ প্রদেশটির রাজধানী বার্সেলোনা। বার্সেলোনার ফুটবল টিম জগদ্বিখ্যাত। স্পেনের জাতীয় আয়ের শতকরা ২০ ভাগ আসে (২৫৫.২০৪ বিলিয়ন) ওই প্রদেশে থেকে। ইউরো জোনের চতুর্থ বড় অর্থনৈতিক শক্তি হচ্ছে স্পেন। এখন কাতালোনিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি শক্তিশালী হয়, যদি সত্যি সত্যিই কাতালোনিয়া ইউরোপে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তা ইউরোপের অন্যত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আরও উৎসাহ জোগাবে।
বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে। উগ্র ডানপন্থী উত্থান ঘটেছে ইউরোপে, যারা নতুন করে ইউরোপের ইতিহাস লিখতে চায়। ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থী উত্থানের পাশাপাশি এখন জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থী তথা নব্য নাজির উত্থান ইউরোপের রাজনীতি বদলে দিতে পারে।
এ যখন পরিস্থিতি, তখন যোগ হলো কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। গেল প্রায় দুই সপ্তাহ আমি ইউরোপে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে থেকে আমি দেখেছি, টিভিতে এটা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি সফল হয়, তাহলে ইউরোপের সর্বত্র এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। এতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হবে, যা ইউরোপের ঐক্যকে দুর্বল করবে। এমনিতেই এখন একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির স্রোত ইউরোপের সর্বত্র বইছে। ব্যাপক অভিবাসী আগমনকে কেন্দ্র করে এ উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রভাব বাড়ছে। আমি সপ্তাহখানেক আগে ফ্রান্সে ছিলাম। সেখানে দেখেছি, উগ্র দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রভাব বাড়ছে। প্রভাব বাড়ছে জার্মানিতে। সেখানে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে গেছে উগ্র দক্ষিণপন্থী দল অলটারনেট ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টি। আস্ট্রিয়ার নির্বাচনে গেল সপ্তাহে ভোটাররা উগ্র দক্ষিণপন্থীদের বিজয়ী করেছে। এর বাইরে হল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক, সেøাভাকিয়াসহ প্রায় প্রতিটি দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে। কোথাও কোথাও এরা ক্ষমতায়, কোথাও দ্বিতীয় অবস্থানে। এ যখন পরিস্থিতি, তখন কাতালোনিয়ার গণভোট পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দিল। এ মুহূর্তে এটা স্পষ্ট নয়, কাতালোনিয়ার সংকটের সমাধান হবে কীভাবে? একটা সমাধান না হলে তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। সমাধানটা হতে হবে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার আর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে। ইইউর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইইউ এ ব্যাপারে কোনো মধ্যস্থতা করবে না। তাই সারা ইউরোপের দৃষ্টি এখন কাতালোনিয়ার দিকে। এখানে বলা ভালো, ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের খবর নতুন নয়। অনেক ইউরোপীয় দেশে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীর খবর আমরা জানি। জার্মানির কথা যদি বলি, তাহলে বেভেরিয়া রাজ্যের কথা আমাকে বলতেই হবে। বেভেরিয়া জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা আলাদা। অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ এ রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা আছে। এখানকার মূল দল সিএসইউ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সিডিইউর স্থানীয় সংগঠন। সিডিইউ এখানে আলাদাভাবে কোনো প্রার্থী দেয় না। সিডিইউর হয়ে কাজ করে সিএসইউ। সম্প্রতি দলটি চ্যান্সেলর মরকেলকে বাধ্য করেছে অভিবাসীদের কোটা সীমিত করে দিতে। জার্মান রাজনীতিতে বেভেরিয়ার ভূমিকা অনেকটা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে স্কটল্যান্ডের ভূমিকার মতো। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকা-না থাকা নিয়ে একটি গণভোট হয়েছিল। তাতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকার পক্ষেই রায় পড়েছিল। এখন স্কটিকা ন্যাশনাল পার্টি প্রধান নিকোলা স্টুরজিওন চাচ্ছেন আরেকটি গণভোট, যাতে স্কটল্যান্ডের মানুষ আরেকবার ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা স্বাধীন হবেন, নাকি ব্রিটেনের সঙ্গেই থেকে যাবেন। এটা তো স্পষ্ট, স্কটল্যান্ড ইইউতে ব্রিটেনের জায়গাটি নিতে চায়। আর এজন্যই দরকার স্বাধীনতা। বেলজিয়াম মূলত দুই ভাগে জাতিগতভাবে বিভক্ত হয়ে আছেÑ ওয়ালুনস (ধিষষড়ড়হং) এবং ফ্লেমিশ (ভষবসরংয)। ওয়ালুনসরা ফরাসি ভাষাভাষী। ফ্লেমিশদের নিজস্ব ভাষা আছে। তাদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনাও আছে। কাতালোনা যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে ফ্লেমিশ স্বাধীনতা আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। ডেনমার্ক থেকে ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত ফারোও (ঋধৎড়ব) দ্বীপপুঞ্জেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে। দ্বীপটি ডেনমার্কের অধীনে হলেও অতিসম্প্রতি তারা স্বশাসনের কথা ঘোষণা করেছে। ইতালির দুইটি অঞ্চল লমবারডি এবং ভেনেতোতে চলতি মাসের শেষে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোট হবে। ২০১৪ সালের মার্চের এক গণভোটে ৮৯ শতাংশ ভেনেতোর মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। সেখানে অনেকটা কাতালোনিয়ার মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সেখানে শক্তিশালী। বাস্্ক (ইধংয়ঁব) অঞ্চলের খবর নিশ্চয়ই অনেকে জানেন। স্পেনের অন্তর্ভুক্ত বাস্্ক মূলত স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। এর কিছু অংশ আবার ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতাকামী ইটিএ দীর্ঘদিন ধরে বাস্ক অঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছে। সাম্প্রতিক সময় স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার বাস্ক অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। তারপরও স্বাধীনতাকামীরা সক্রিয়। তারা মাঝেমধ্যেই বোমা হামলা চালিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছে নানা কারণে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ, অনুুন্নয়ন, নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি কারণে এ বিচিছন্নতাবাদী চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উগ্র দক্ষিণপন্থী কিছু দল এ বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারাকে উসকে দিয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে ‘অলটারনেটিভ ফর ডয়েটসল্যান্ড’ (জার্মানি), জবিক (ঔড়ননরশ) বা ‘মুভমেন্ট ফর বেটার হাঙ্গেরি’, ‘ফ্রন্ট ন্যাশনাল’ (ফ্রান্স), ‘গোল্ডেন ডন’ (এষফবহ উধহি) (গ্রিস), ‘ফ্রাইহাইটলিসে পার্টাই ওস্টারিস’ (অস্ট্রিয়া), দ্য ফিনস (ফিনল্যান্ড), ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাটস’ (সুইডেন), ‘ড্যানিশ পিপলস পার্টি’ (ডেনমার্ক), ‘পার্টাই ভর দি ভ্রিজহেইড’ (চধৎঃরু াড়ড়ৎ ফব াৎরলযবরফ) (হল্যান্ড), ‘লিগা নর্ড’ (ইতালি) প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের কথা। এসব রাজনৈতিক দল উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রমোট করছে। কোথাও কোথাও তারা সংসদেও আছে। একটা পরিসংখ্যান দিই। সম্প্রতি জার্মানিতে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে এএফডির তৃতীয় শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটেছে। সাবেক পূর্ব জার্মানিতে এ দলটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। প্রচ- ইসলাম তথা অভিবাসনবিরোধী দলটি যদি ভবিষ্যতে পূর্ব জার্মানিতে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে (?) আমি অবাক হব না। হাঙ্গেরিতেও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ঔড়ননরশ তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ফ্রান্সে উগ্র দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মারিয়ান লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে শতকরা ২৬ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি ম্যাক্রোনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ফ্রান্সের ১৩টি অঞ্চলের স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে (২০১৫) ন্যাশনাল ফ্রন্ট অন্তত ছয়টি অঞ্চলে প্রথম অবস্থানে আছে। গ্রিসে ২০১৫ সালের নির্বাচনে ‘গোন্ডেন ডন’ পার্টি শতকরা ৭ ভাগ ভোট পেয়েছিল। অস্ট্রিয়ার গত সপ্তাহের সংসদ নির্বাচনে দুইটি উগ্রপন্থী দলের অবস্থান যথাক্রমে শতকরা ২৪.০ ভাগ (পিপলস পার্টি) ও শতকরা ২০.৫ ভাগ (ফ্রিডম পার্টি)। ফিনল্যান্ডে ‘দি ফিনস’ পার্টির অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৫ সালে তারা সরকারে যোগ দেয়। ২০১১ সালে তারা সংসদ নির্বাচনে ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সবাইকে অবাক করেছিল। সুইডেনে ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাট’ পার্টি শতকরা ১২ দশমিক ৯ ভাগ ভোট পেয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি পেয়েছিল ২১ দশমিক ৫ ভাগ ভোট। ডেনমার্কে ‘ড্যানিশ পিপলস পার্টি’ শতকরা ২১ ভাগ ভোট পেয়ে (২০১১ সালে ১২ ভাগ ভোট) দেশের দ্বিতীয় বড় দল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হল্যান্ডে ‘পার্টাই ভর দি ভ্রিজহেইড’ এখন ক্ষমতার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটির নেতা গার্ট উইলডার্স বহুবিধ কারণে বিতর্কিত। বলা হয়, তিনিই মূলত ‘ট্রাপইজম’ এর জনক। প্রচ- ইসলামবিরোধী বক্তব্যের জন্য তিনি বারবার সমালোচিত হয়েছেন। ইতালির নব্য নাজি হিসেবে পরিচিত লিগা নর্ড (খরমধ ঘড়ৎফ) পার্টি প্রায় ১৩ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং আগামীতে ক্ষমতার অন্যতম অংশীদার হবে বলে অনেকে মনে করে। এ ধরনের পরিসংখ্যান আরও দেয়া যায়Ñ যাতে দেখা যাবে উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটেছে ইউরোপে। আগামীতে এ উগ্রপন্থীরা কোনো কোনো অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে পারে। বদলে যাচ্ছে ইউরোপ। একসময় যে ইউরোপ স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের প্রতীক ছিল, সেখানে আসতে পারে অনিশ্চয়তা। ভেঙে যেতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ধারণা।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ২২ অক্টোবর ২০১৭
এ যখন পরিস্থিতি, তখন যোগ হলো কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। গেল প্রায় দুই সপ্তাহ আমি ইউরোপে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে থেকে আমি দেখেছি, টিভিতে এটা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি সফল হয়, তাহলে ইউরোপের সর্বত্র এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। এতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হবে, যা ইউরোপের ঐক্যকে দুর্বল করবে। এমনিতেই এখন একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির স্রোত ইউরোপের সর্বত্র বইছে। ব্যাপক অভিবাসী আগমনকে কেন্দ্র করে এ উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রভাব বাড়ছে। আমি সপ্তাহখানেক আগে ফ্রান্সে ছিলাম। সেখানে দেখেছি, উগ্র দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রভাব বাড়ছে। প্রভাব বাড়ছে জার্মানিতে। সেখানে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে গেছে উগ্র দক্ষিণপন্থী দল অলটারনেট ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টি। আস্ট্রিয়ার নির্বাচনে গেল সপ্তাহে ভোটাররা উগ্র দক্ষিণপন্থীদের বিজয়ী করেছে। এর বাইরে হল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক, সেøাভাকিয়াসহ প্রায় প্রতিটি দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে। কোথাও কোথাও এরা ক্ষমতায়, কোথাও দ্বিতীয় অবস্থানে। এ যখন পরিস্থিতি, তখন কাতালোনিয়ার গণভোট পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দিল। এ মুহূর্তে এটা স্পষ্ট নয়, কাতালোনিয়ার সংকটের সমাধান হবে কীভাবে? একটা সমাধান না হলে তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। সমাধানটা হতে হবে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার আর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে। ইইউর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইইউ এ ব্যাপারে কোনো মধ্যস্থতা করবে না। তাই সারা ইউরোপের দৃষ্টি এখন কাতালোনিয়ার দিকে। এখানে বলা ভালো, ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের খবর নতুন নয়। অনেক ইউরোপীয় দেশে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীর খবর আমরা জানি। জার্মানির কথা যদি বলি, তাহলে বেভেরিয়া রাজ্যের কথা আমাকে বলতেই হবে। বেভেরিয়া জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা আলাদা। অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ এ রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা আছে। এখানকার মূল দল সিএসইউ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সিডিইউর স্থানীয় সংগঠন। সিডিইউ এখানে আলাদাভাবে কোনো প্রার্থী দেয় না। সিডিইউর হয়ে কাজ করে সিএসইউ। সম্প্রতি দলটি চ্যান্সেলর মরকেলকে বাধ্য করেছে অভিবাসীদের কোটা সীমিত করে দিতে। জার্মান রাজনীতিতে বেভেরিয়ার ভূমিকা অনেকটা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে স্কটল্যান্ডের ভূমিকার মতো। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকা-না থাকা নিয়ে একটি গণভোট হয়েছিল। তাতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকার পক্ষেই রায় পড়েছিল। এখন স্কটিকা ন্যাশনাল পার্টি প্রধান নিকোলা স্টুরজিওন চাচ্ছেন আরেকটি গণভোট, যাতে স্কটল্যান্ডের মানুষ আরেকবার ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা স্বাধীন হবেন, নাকি ব্রিটেনের সঙ্গেই থেকে যাবেন। এটা তো স্পষ্ট, স্কটল্যান্ড ইইউতে ব্রিটেনের জায়গাটি নিতে চায়। আর এজন্যই দরকার স্বাধীনতা। বেলজিয়াম মূলত দুই ভাগে জাতিগতভাবে বিভক্ত হয়ে আছেÑ ওয়ালুনস (ধিষষড়ড়হং) এবং ফ্লেমিশ (ভষবসরংয)। ওয়ালুনসরা ফরাসি ভাষাভাষী। ফ্লেমিশদের নিজস্ব ভাষা আছে। তাদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনাও আছে। কাতালোনা যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে ফ্লেমিশ স্বাধীনতা আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। ডেনমার্ক থেকে ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত ফারোও (ঋধৎড়ব) দ্বীপপুঞ্জেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে। দ্বীপটি ডেনমার্কের অধীনে হলেও অতিসম্প্রতি তারা স্বশাসনের কথা ঘোষণা করেছে। ইতালির দুইটি অঞ্চল লমবারডি এবং ভেনেতোতে চলতি মাসের শেষে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোট হবে। ২০১৪ সালের মার্চের এক গণভোটে ৮৯ শতাংশ ভেনেতোর মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। সেখানে অনেকটা কাতালোনিয়ার মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সেখানে শক্তিশালী। বাস্্ক (ইধংয়ঁব) অঞ্চলের খবর নিশ্চয়ই অনেকে জানেন। স্পেনের অন্তর্ভুক্ত বাস্্ক মূলত স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। এর কিছু অংশ আবার ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতাকামী ইটিএ দীর্ঘদিন ধরে বাস্ক অঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছে। সাম্প্রতিক সময় স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার বাস্ক অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। তারপরও স্বাধীনতাকামীরা সক্রিয়। তারা মাঝেমধ্যেই বোমা হামলা চালিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছে নানা কারণে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ, অনুুন্নয়ন, নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি কারণে এ বিচিছন্নতাবাদী চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উগ্র দক্ষিণপন্থী কিছু দল এ বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারাকে উসকে দিয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে ‘অলটারনেটিভ ফর ডয়েটসল্যান্ড’ (জার্মানি), জবিক (ঔড়ননরশ) বা ‘মুভমেন্ট ফর বেটার হাঙ্গেরি’, ‘ফ্রন্ট ন্যাশনাল’ (ফ্রান্স), ‘গোল্ডেন ডন’ (এষফবহ উধহি) (গ্রিস), ‘ফ্রাইহাইটলিসে পার্টাই ওস্টারিস’ (অস্ট্রিয়া), দ্য ফিনস (ফিনল্যান্ড), ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাটস’ (সুইডেন), ‘ড্যানিশ পিপলস পার্টি’ (ডেনমার্ক), ‘পার্টাই ভর দি ভ্রিজহেইড’ (চধৎঃরু াড়ড়ৎ ফব াৎরলযবরফ) (হল্যান্ড), ‘লিগা নর্ড’ (ইতালি) প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের কথা। এসব রাজনৈতিক দল উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রমোট করছে। কোথাও কোথাও তারা সংসদেও আছে। একটা পরিসংখ্যান দিই। সম্প্রতি জার্মানিতে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে এএফডির তৃতীয় শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটেছে। সাবেক পূর্ব জার্মানিতে এ দলটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। প্রচ- ইসলাম তথা অভিবাসনবিরোধী দলটি যদি ভবিষ্যতে পূর্ব জার্মানিতে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে (?) আমি অবাক হব না। হাঙ্গেরিতেও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ঔড়ননরশ তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ফ্রান্সে উগ্র দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মারিয়ান লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে শতকরা ২৬ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি ম্যাক্রোনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ফ্রান্সের ১৩টি অঞ্চলের স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে (২০১৫) ন্যাশনাল ফ্রন্ট অন্তত ছয়টি অঞ্চলে প্রথম অবস্থানে আছে। গ্রিসে ২০১৫ সালের নির্বাচনে ‘গোন্ডেন ডন’ পার্টি শতকরা ৭ ভাগ ভোট পেয়েছিল। অস্ট্রিয়ার গত সপ্তাহের সংসদ নির্বাচনে দুইটি উগ্রপন্থী দলের অবস্থান যথাক্রমে শতকরা ২৪.০ ভাগ (পিপলস পার্টি) ও শতকরা ২০.৫ ভাগ (ফ্রিডম পার্টি)। ফিনল্যান্ডে ‘দি ফিনস’ পার্টির অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৫ সালে তারা সরকারে যোগ দেয়। ২০১১ সালে তারা সংসদ নির্বাচনে ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সবাইকে অবাক করেছিল। সুইডেনে ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাট’ পার্টি শতকরা ১২ দশমিক ৯ ভাগ ভোট পেয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি পেয়েছিল ২১ দশমিক ৫ ভাগ ভোট। ডেনমার্কে ‘ড্যানিশ পিপলস পার্টি’ শতকরা ২১ ভাগ ভোট পেয়ে (২০১১ সালে ১২ ভাগ ভোট) দেশের দ্বিতীয় বড় দল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হল্যান্ডে ‘পার্টাই ভর দি ভ্রিজহেইড’ এখন ক্ষমতার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটির নেতা গার্ট উইলডার্স বহুবিধ কারণে বিতর্কিত। বলা হয়, তিনিই মূলত ‘ট্রাপইজম’ এর জনক। প্রচ- ইসলামবিরোধী বক্তব্যের জন্য তিনি বারবার সমালোচিত হয়েছেন। ইতালির নব্য নাজি হিসেবে পরিচিত লিগা নর্ড (খরমধ ঘড়ৎফ) পার্টি প্রায় ১৩ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং আগামীতে ক্ষমতার অন্যতম অংশীদার হবে বলে অনেকে মনে করে। এ ধরনের পরিসংখ্যান আরও দেয়া যায়Ñ যাতে দেখা যাবে উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটেছে ইউরোপে। আগামীতে এ উগ্রপন্থীরা কোনো কোনো অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে পারে। বদলে যাচ্ছে ইউরোপ। একসময় যে ইউরোপ স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের প্রতীক ছিল, সেখানে আসতে পারে অনিশ্চয়তা। ভেঙে যেতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ধারণা।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ২২ অক্টোবর ২০১৭
0 comments:
Post a Comment