গত
২৪ সেপ্টেম্বর জার্মানির সাধারণ নির্বাচনে একটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে
নব্য নাজি পার্টি হিসেবে পরিচিত অলন্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টি
প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাওয়ায় তা শুধু একটি বড় ধরনের ঘটনারই জন্ম দেয়নি, বরং ইউরোপের সনাতনপন্থি রাজনীতিবিদদের একটি চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
চিন্তাটা হচ্ছে উগ্র ডানপন্থিদের উত্থান। এই ডানপন্থি উত্থান ইতোমধ্যে ইউরোপের
অনেক দেশে বিস্তৃত হয়েছে। জার্মানি বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। বলা যেতে পারে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পর জার্মানিই হচ্ছে
ইউরোপের নেতা। এখন সেই জার্মানিতেই যদি নব্য নাজিবাদের উত্থান ঘটে, তা যে একটা খারাপ সংবাদ বয়ে আনল, তা বলার আর
অপেক্ষা রাখে না। এএফডির জন্ম মাত্র ৪ বছর আগে ২০১৩ সালে। মূলত মুসলমান বিদ্বেষ আর
ব্যাপক হারে জার্মানিতে শরণার্থী আগমনকে কেন্দ্র করে (২০১৫ সালে ১৩ লাখ
সিরীয়-ইরাকি শরণার্থীর জার্মানি প্রবেশ) এই দলটির জন্ম হয়। ইতোমধ্যে তারা
জার্মানির ১৬টি প্রদেশের মধ্যে ১৩টি প্রদেশ পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করছে। আরও
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাবেক পূর্ব জার্মানি যেখানে এক সময়
সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু ছিল, সেখানে এই দলটির
(এএফডির) প্রতিপত্তি বেশি। চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল নিজেও পূর্ব জার্মানি
থেকে এসেছেন। নির্বাচনে এএফডি শতকরা ১২ দশমিক ৬ ভাগ ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে ৯৪টি
আসন (মোট আসন ৭০৯) নিশ্চিত করেছে। সংখ্যার দিক থেকে ৯৪টি আসন খুব বেশি নয়। কিন্তু
ভয়টা হলো ইউরোপের প্রতিটি দেশে উগ্র ডানপন্থিরা একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। যেমন
অস্ট্রিয়াতে ফ্রিডম পার্টি ভোট পেয়েছে ৩৫.১ (২০১৬), বেলজিয়ামে
নিউ ফ্লেমিস অ্যালায়েন্স ২০.৩ ভাগ ভোট (২০১৪), ব্রিটেনে
ইউকে আইপি ১২.৭ ভাগ ভোট (২০১৫), ডেনমার্কে পিপলস পার্টি
২১.১ ভাগ ভোট (২০১৫), ফিনল্যান্ডে ফিনস পার্টি ১৭.৭ ভাগ
(২০১৫), ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট ২৭.৭ ভাগ (২০১৫),
হাঙ্গেরিতে ফিডেস-কেডিএনপি ৪৪.৮ ভাগ (২০১৪), হল্যান্ডে পার্টি অব ফ্রিডম ১৩.১ ভাগ (২০১৭), পোল্যান্ড
ল’ অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ৩৭.৬ ভাগ (২০১৫), সেøাভাকিয়ায় ন্যাশনাল পার্টি ৮.৬ ভাগ (২০১৬), সুইডেনে
ডেমোক্রেটস ১২.৯ ভাগ (২০১৪), কিংবা সুইজারল্যান্ডে পিপলস
পার্টি ২৯.৪ ভাগ (২০১৫)। এখন এসব উগ্র দক্ষিণপন্থি দলের তালিকায় যুক্ত হলো এএফডির
(জার্মানি) নাম। অথচ এই দলটি ২০১৩ সালে পেয়েছিল মাত্র ৪.৭ ভাগ ভোট। ফলে
পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। শতকরা ৫ ভাগ ভোটের দরকার হয় পার্লামেন্টে
যেতে। এই উগ্র ডানপন্থির উত্থান এখন ইউরোপের জন্য একটা হুমকি।
জার্মানিতে মের্কেল ক্ষমতায় থেকে যাচ্ছেন বটে। কিন্তু এই
নির্বাচন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, কট্টর দক্ষিণপন্থি ও নব্য
নাজি পার্টি হিসেবে পরিচিত এএফডির উত্থান প্রমাণ করল, জার্মানিতে
কট্টরপন্থিদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। আগামীতে এরা সিডিইউ-সিএসইউর বিকল্প হিসেবে
আবির্ভূত হতে পারে। জার্মানির ১৬টি স্টেটের মধ্যে ১৩টি স্টেটের পার্লামেন্টে এদের
প্রতিনিধিত্ব আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। এখন কেন্দ্রে এদের অবস্থান তৃতীয়। সবচেয়ে বড়
স্টেট এবং কনজারভেটিভদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত বায়ার্ন প্রদেশে ১৯৪৮ সালের পর
এই প্রথমবারের মতো সিএসইউ (সিডিইউর বিকল্প দল শুধু বায়ান স্টেটে) সবচেয়ে খারাপ ফল
করেছে। এখানে এএফডি ভালো করেছে। ফলে আশঙ্কা থাকলই ধীরে ধীরে এএফডি সিডিইউ-সিএসইউর
বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। আমরা যেন ভুলে না যাই এডলফ হিটলার ও তার নাজি পার্টি
জার্মানিতে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল এবং হিটলার নির্বাচিত চ্যান্সেলর হিসেবেই
রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেছিলেন। এখন এএফডি কী ধীরে ধীরে নাজি পার্টির অবস্থানে
যাচ্ছে, সেটাই দেখার বিষয়। দ্বিতীয়ত, ২০১৫ সালে ইউরোপে ব্যাপক শরণার্থী (সিরীয়, ইরাকি
ও আফগানি) আফগানকে কেন্দ্র করে পুরো ইউরোপের রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যায়।
কট্টরপন্থিদের ব্যাপক উত্থান ঘটে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিজয় এই
দক্ষিণপন্থি উত্থানকে আরও উৎসাহিত করেছে। ওই সময় দশ লাখের অধিক সিরীয় শরণার্থীকে
আশ্রয় দিয়ে মের্কেল সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু তার পার্শ্ববর্তী
তিনটি দেশ তার সমালোচনা করেছিল। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং
চেক রিপাবলিক বরাবরই সিরীয়-ইরাক শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার বিপক্ষে
ছিল। মের্কেল যখন জার্মানিতে এসব শরণার্থী আসার সুযোগ করে দেন, তখন এই তিনটি দেশের সরকারপ্রধানরা এর সমালোচনা করেছিলেন। এখন তারা নতুন
করে যুক্তি তুলবেন যে, তাদের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।
জার্মান নির্বাচন ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় কট্টরপন্থিদের আরও উৎসাহিত করবে।
অক্টোবর মাসে চেক রিপাবলিকের নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আন্দ্রেই বাবিস ও
তার দল ভালো করবে বলে সবার ধারণা। বাবিস অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্প স্টাইলে রাষ্ট্র
পরিচালনা করতে চান। বাবিস একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। চেক রিপাবলিকে তার বাণিজ্যিক
প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন ডলারের মালিক। তিনি নিজে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান
কিংবা পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন দলের নেতা জারুজলাভ কাসিনিস্কির মতো দক্ষিণপন্থি
নেতাদের উত্থান পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতির দৃশ্যপটকে বদলে দিতে পারে। ইউরোপীয়
ইউনিয়নে যেসব মডারেট নেতা আছেন, বিশেষ করে মের্কেল কিংবা
ম্যাক্রোঁর (ফ্রান্স) মতো নেতাদের ভূমিকা সীমিত হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, জার্মানিতে সম্ভাব্য একটি কোয়ালিশন সরকার (সিডিইউ-সিএমইউ, এফডিপি আর গ্রিন) যদি গঠিত হয়, তা হলে এই
সরকারকে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অ্যাঙ্গেলা মের্কেল কতটুকু
এই ঐক্যকে ধরে রাখতে পারবেন, এটাও একটা প্রশ্ন। কেননা
অনেকগুলো জাতীয় প্রশ্নে এফডিপি ও গ্রিন পার্টির মধ্যে নীতিগতভাবে মতপার্থক্য
রয়েছে। একটি প্রশ্নে বড় পার্থক্য রয়েছে, তা হচ্ছেÑ
গ্রিন পার্টি চাচ্ছে আগামীতে ২০টি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র
বন্ধ করে দেওয়ার। কিন্তু ব্যবসাবান্ধব এফডিপি এর পক্ষে। তা হলে সমঝোতা হবে কীভাবে?
এই মতপার্থক্য জার্মানিতে আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে
দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সংখ্যালঘু সরকার হয়তো গঠিত হতে পারে। কিন্তু মের্কেল
তা চাচ্ছেন না। চতুর্থত, এএফডির বিজয় সরকারকে শরণার্থী ও
রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। ২০১৬ সালে প্রায়
৮ লাখ শরণার্থী জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। তবে ২০১৭ সালে এই
সংখ্যা কম। শুধু তাই নয়, জাতিগত বৈষম্যও বেড়ে যেতে পারে।
এএফডির শীর্ষ নেতা আলেকজান্ডার গাউল্যান্ড গ্রিন পার্টির নেতাদের সম্পর্কে যেসব
মন্তব্য করেছেন তা অনাকাক্সিক্ষত। তিনি বলেছেন, এদের
তুরস্কে চলে যাওয়া উচিত। জার্মানির অতীত নিয়ে তিনি প্রশংসামূলক মন্তব্য করেছেন,
যা বিতর্ক বাড়িয়েছে। জ্যামাইকা কোয়ালিশন আগামীতে সরকার পরিচালনা
করবে। কিন্তু সেই সরকার থাকবে নড়েবড়ে। ৭০৯ সিটের পার্লামেন্টে তাদের হাতে থাকবে
মাত্র ৩৯৩ আসন। তাই বোঝাই যায় কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া মের্কেলের জন্য কঠিন হয়ে
দাঁড়াবে। টানা চারবার চ্যান্সেলর হয়ে অ্যাঙ্গেলা মের্কেল ইতিহাসে নাম লেখালেন। এক
সময় পূর্ব জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এই শিক্ষাবিদ (যার রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে)
রাজনীতিতে এসেছিলেন দুই জার্মানি একত্রিত হওয়ার পরই। অতি সাধারণ জীবনযাপন করা
মের্কেল এক সময় পূর্ব জার্মানিতে ছিলেন যখন তিনি বাসা ভাড়া দিতে পারতেন না। সঠিক
নীতি, সাধারণ জীবন, শরণার্থীদের
ব্যাপারে তার সহানুভূতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যকে ধরে
রাখা, ট্রাম্পের কট্টরনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া তাকে
বিশ্ব রাজনীতিতে ‘অসাধারণ’ করেছে। তিনি এক সময়ের জার্মান
চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডের জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। অব্যাহত কট্টরপন্থিদের
উত্থানের বিরুদ্ধে সীমিত কিছু ‘কোয়ালিশন সিট’ নিয়ে তিনি আগামীতে কীভাবে জার্মানির নেতৃত্ব
দেন, সেটাই দেখার বিষয়। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে
কেন মানুষ এএফডির মতো দলকে ভোট দিল, তা খতিয়ে দেখা। মানুষ
কী প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে এএফডিকে ভোট দিল? শুধু জাতিগত বৈষম্য, মুসলমান বিদ্বেষ কিংবা
শরণার্থী বিরোধিতাই কী এএফডিকে জনপ্রিয় করল? এসব এখন
খতিয়ে দেখতে হবে। মের্কেল কথা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ‘বাধ্য’ হয়ে এএফডিকে সন্তুষ্ট করার
জন্য যদি তার নীতিতে পরিবর্তন আনেন, তা হলে তা জার্মানির
জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। এএফডি চাচ্ছে ইউরো জোন থেকে জার্মান বেরিয়ে
আসুক। এটা নিশ্চয়ই মের্কেল করবেন না। কিন্তু তিনি ‘চাপে’ থাকবেন। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয়
ইউনিয়নের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কিছু সংস্কার আসতে পারে। ইইউতে জার্মানি বড় দেশ।
দেশটির যে কোনো সিদ্ধান্ত ইইউর রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণপন্থিদের ব্যাপক
উত্থান পুরো ইউরোপের চেহারা আগামীতে বদলে দিতে পারে। শরণার্থী ইস্যুকে কেন্দ্র করে
ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেছে। নির্বাচনে তেরেসা মে যেখানে সুবিধা করতে পারেননি।
তিনি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন আরেকটি দলের ওপর। এখন অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের
অবস্থা হতে যাচ্ছে তেমনটি। কট্টরপন্থি এএফডিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাকে এখন দুটি
বড় দল ও কোয়ালিশন পার্টনার এফডিপি ও গ্রিন পার্টিকে ছাড় দিতে হবে। এই দল দুটির
মধ্যেও সমন্বয় করতে হবে। তিনি যদি ব্যর্থ হন, তা হলে নয়া
নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই ঝুঁকিটি এ মুহূর্তে কোনো দলই নিতে চাইবে না।
কেননা দ্রুত আরেকটি নির্বাচন মানে এএফডিকে আরও সুযোগ করে দেওয়া। নয়া নির্বাচন
এএফডিকে একটি দরকষাকষি অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি ক্ষমতাসীন সিডিইউ-সিএসইউকে
বাধ্য করতে পারে গ্রিন পার্টিকে বাদ দিয়ে তাদের কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিতে! শুধু
তাই নয়, সিডিইউর নেতৃত্ব থেকে মের্কেল সটকে পড়তে পারেন।
আগামী ২৪ অক্টোবর পার্লামেন্টের অধিবেশন বসছে। মের্কেল চ্যান্সেলরের দায়িত্ব
নেবেন। মোট চার-চারবার তিনি জার্মানিকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। এটা
নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। তিনি কনরাড অ্যাডেনাওয়ার হেলমুট কোল কিংবা উইলি
ব্রান্ডের নামের তালিকায় নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হলেন বটে। কিন্তু
বাস্তবতা হচ্ছে, দ্রুত বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি।
কট্টর দক্ষিণপন্থির উত্থান ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের উত্থান এই শক্তিকে আরও
শক্তিশালী করেছে। এখন দেখার পালা ইউরোপ আগামীতে কোন দিকে যায়। ইউরো জোনের ব্যর্থতা
আর কট্টরপন্থিদের উত্থান যদি ইইউতে ভাঙন সৃষ্টি করে আমি অবাক হব না।
0 comments:
Post a Comment