রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কর্ণাটকের নির্বাচন কি ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের সূচনা?



সম্প্রতি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে একটি বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সেখানে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েও সরকার গঠন করেছেন কম আসন পাওয়া জনতা দলের (সেক্যুলার) প্রধান এইচ ডি কুমারাস্বামী। কর্ণাটক ভারতের রাজনীতিতে কখনোই কোনো বড় ভূমিকা পালন করেনি। কিন্তু এবারের নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠন ভারতীয় রাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভার নির্বাচন। এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে কর্ণাটকের এ নির্বাচন কি ভারতীয় রাজনীতিতে একটি পরিবর্তনের সূচনা করল? প্রথমত, কুমারাস্বামীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বিজেপিবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এটা একটা মেসেজ দিল যে আগামী লোকসভা নির্বাচনে (২০১৯) এই দলগুলো একটি বিজেপিবিরোধী মোর্চা গঠন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় রাজনীতিতে এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে কংগ্রেস এখনো একটি ফ্যাক্টর। কিন্তু কংগ্রেস নিজের বড় দলের অহমিকা পরিত্যাগ করে একটি ছোট দলকে সেখানে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এ মানসিকতা জাতীয় পর্যায়ে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনে সহায়ক হবে। তৃতীয়ত, কর্ণাটকে মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সব বিরোধী দলের নেতারা প্রমাণ করলেন কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে হটাতে হলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এসব কারণেই কর্ণাটকে নির্বাচন-পরবর্তী রাজধানী অনেকের কাছেই সেখানে আলোচনার বিষয়। কুমারাস্বামীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সোনিয়া গান্ধী, রাজীব গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসপ্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তর প্রদেশের মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নাইডু ও তেলেঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও। ছিলেন সিপিএমসহ সব বাম দল ও ভারতের আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা। অনেক দিন ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেষ্টা করে যাচ্ছেন ভারতে বিজেপিবিরোধী একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করার। তিনি সোনিয়া গান্ধীকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন কর্ণাটকে ছাড় দিতে। সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী শেষ পর্যন্ত তা-ই করলেন। কর্ণাটকের বিধানসভার নির্বাচনে ১১৬টি আসন পেয়েও কংগ্রেস সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়নি এবং ৩৮ আসন পাওয়া জনতা দলের (এস) প্রধান কুমারাস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রীর পদটি ছেড়ে দেয়। এটা সত্য, বিজেপি সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল। ৪৮ ঘণ্টার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন বিজেপি নেতা ইয়েদুরাপ্পা। কিন্তু বিধানসভায় সরকার গঠনের জন্য তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এখানে হেরে গেল বিজেপি রাহুল গান্ধীর ‘মাস্টার স্ট্রোক’-এর কাছে। ইয়েদুরাপ্পার কাহিনি ১৯৯৬ সালে বিজেপির আরেকটি করুণ কাহিনির কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৯৬ সালে মাত্র ১৩ দিনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য সমর্থন নিশ্চিত করতে না পারায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া সত্ত্বেও ১৩ দিনের মাথায় বাজপেয়ি পদত্যাগ করেছিলেন। এটা এখন একটা সম্ভাবনা তৈরি করল ২০১৯ সালের লোকসভা-পরবর্তী রাজনীতির জন্য। এটা ঠিক কংগ্রেস এখন আর সেই অবস্থানে নেই। কেন্দ্রে এককভাবে সরকার গঠন করার সামর্থ্য কংগ্রেসের এখন আর নেই। আঞ্চলিক দলগুলো ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থন ছাড়া কোনো বড় দলের একার পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব না। এখন বিজেপিবিরোধী আঞ্চলিক দলগুলো যদি একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করে, তাহলে কেন্দ্রের রাজনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো একটি আঞ্চলিক দলের প্রধান যদি ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হন, আমি তাতে অবাক হব না! তবে অনেক কিছু নির্ভর করছে কংগ্রেস নেতাদের ওপর। কর্ণাটকে তাঁরা ছাড় দিয়েছেন! কিন্তু ২০১৯ সালেও কি ছাড় দেবেন? অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ির (বিজেপি) পদত্যাগের পর জনতা দলের দেব গৌড়া (কুমারাস্বামীর বাবা) ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কংগ্রেস সমর্থন করেছিল দেব গৌড়াকে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ৯ মাস ২১ দিনের মাথায় দেব গৌড়া প্রধানমন্ত্রীর পদটি হারান। আই কে গুজরাল এবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। কংগ্রেস তাঁকে সমর্থন জানায়। ১১ মাস শাসনের পর মন্ত্রিসভায় ডিএমকেকে রাখা নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলে কংগ্রেস গুজরালের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে পতন ঘটে গুজরাল সরকারের। কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল ডিএমকে দলটি রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। আরো একটু পেছনে ফিরে যাই। ১৯৭৯ সাল। মুরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে তদানীন্তন উপপ্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিং কংগ্রেসের ‘সমর্থন’ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন; যার আয়ু ছিল মাত্র পাঁচ মাস ১৪ দিন। ওই সময় লোকসভার অধিবেশন না থাকায় চরণ সিংকে আস্থা ভোটের সম্মুখীন হতে হয়নি। এরপর কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করায় আস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়ার আগেই চরণ সিং পদত্যাগ করেন। ১৯৯০ সালে ভিপি সিংয়ের মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে চন্দ্রশেখর মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। কিন্তু রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে সাত মাস পর তিনি পদত্যাগ করেন। সুতরাং কংগ্রেসকে নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। এখন দেখার পালা কংগ্রেস তার স্ট্র্যাটেজিতে কতটুকু পরিবর্তন আনে।
এটা সত্য ‘গেরুয়া বিপ্লব’ এখন ভারতের সর্বত্র ছেয়ে গেছে। একসময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত বোন রাজ্যগুলোতে বিজেপির কোনো অবস্থান ছিল না। এখন সেখানে প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই বিজেপি তথা বিজেপি সমর্থকরা সরকার গঠন করেছে। ২৯টি রাজ্য ও সাতটি রয়েছে ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’। ১৬টি রাজ্যে বিজেপি এখন ক্ষমতায়। এই রাজ্যগুলো হচ্ছে অরুণাচল, আসাম, ছত্তিশগড়, গোয়া, গুজরাট, হারিয়ানা, হিমাচল, ঝাড়খণ্ড, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, রাজস্থান, সিকিম, ত্রিপুরা, উত্তর প্রদেশ, উত্তরখণ্ড, তৃণমূল কংগ্রেস আছে পশ্চিমবঙ্গে, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি আছে তেলেঙ্গানায়, এআইএডিএমকে আছে তামিলনাড়ুতে, পাঞ্জাবে আছে কংগ্রেস, পণ্ডিচেরিতে কংগ্রেস, ওড়িশায় বিজু জনতা দল। নাগাল্যান্ডে এনডিপি, মিজোরামে কংগ্রেস, মেঘালয়ে এনপিপি, কেরালায় সিপিআই (এম), কর্ণাটকে জনতা দল (এম), দিল্লিতে আম আদমি পার্টি, বিহারে জনতা দল (ইউনাইটেড), অন্ধ্র প্রদেশে তেলেগু দেশাম পার্টি। সুতরাং আঞ্চলিক পর্যায়ে বিজেপির অবস্থান এখন ভালো। কংগ্রেসের আর আগের অবস্থান নেই। আঞ্চলিক দলগুলো স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও যথেষ্ট শক্তিশালী। সুতরাং বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে কংগ্রেসের এ আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে ‘ঐক্য’ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এখন কংগ্রেস একটি ‘কর্ণাটক মডেল’ নিয়ে এগিয়ে যাবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ করা অত সহজ হবে না। ১৬তম লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। ওই নির্বাচনে ৫৪৫ আসনবিশিষ্ট লোকসভার আসনসংখ্যা নিম্নরূপ : বিজেপি ২৭১ আসন, কংগ্রেস ৪৮, এআইএডিএমকে ৩৭, তৃণমূল কংগ্রেস ৩৪, বিজু জনতা দল ২০, শিবসেনা ১৮, তেলেগু দেশাম ১৬, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি ১১, সিপিআই (এম) ৯, ওয়াইএসআর কংগ্রেস ৯, সমাজবাদী দল সাত, লোক জনশক্তি দল পাঁচ, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পাঁচ, আম আদমি চার, আকালি দল চার, ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট তিন, নির্দলীয় তিন, রাষ্ট্রীয় জনতা দল তিন, লোক সমতা পার্টি তিন, আপনা দল দুই, ন্যাশনাল লোকদল দুই, মুসলিম লীগ দুই, জনতা দল (ইউনাইটেড) দুই, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা দুই এবং একটি আসন করে কয়েকটি দল। লোকসভায় বিজেপির নেতৃত্বে রয়েছে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে রয়েছে ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ)। একসময় এনডিএ জোটে ২৭ দল ছিল আর ইউপিএ জোটে ছিল ১১ দল। অনেকেই জোট বদল করেছে। যেমন—তৃণমূল কংগ্রেস কিংবা এআইএডিএমকে, যারা বিজেপি জোটে ছিল (এনডিএ)। এখন তারা কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সুতরাং এটা বলা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়, ২০১৯ সালে কোন দলের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তৃতীয় কোনো জোটও গড়ে ওঠেনি। বলতে দ্বিধা নেই, নরেন্দ্র মোদির একটা ব্যক্তি ইমেজ আছে। জনপ্রিয়তাও কম নেই। তাঁর ব্যক্তি ইমেজ ২০১৯ সালের নির্বাচনে কাজে দেবে। বিজেপিকে হারানো সত্যিকার অর্থেই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অনেক কিছুই নির্ভর করবে তিনি কী স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন তার ওপর। সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি জরিপ চালিয়েছে। গত ২৩ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত প্রভাবশালী মিডিয়া গোষ্ঠী টাইমস গ্রুপের ৯টি গণমাধ্যমে একযোগে অনলাইন জরিপ চালানো হয়। ৯ ভাষায় চালানো এ জরিপে অংশ নেয় চার লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৬ জন। জরিপে মোদির কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন রাখা হয়। এতে ৪৭.৪৭ শতাংশ মানুষ বলছে, তাঁর কর্মকাণ্ড খুবই ভালো। ২০.৫৫ শতাংশ বলেছে খারাপ। ৭৩.৩ শতাংশ মানুষ বলছে, আগামী নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার আবারও ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৬.১ শতাংশ বলছে, তারা মোদি বা রাহুল গান্ধীকে ভোট না দিয়ে বিকল্প কাউকে বেছে নেবে। ১১.৯৩ শতাংশ রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়। জরিপে ৩৩.৪২ শতাংশ মানুষ বলছে, পণ্য পরিষেবা কর, যা জিএসটি নামে পরিচিত, বাস্তবায়নেই হচ্ছে সরকারের বড় সাফল্য। সাফল্যের তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে নোট বাতিল এবং পাকিস্তানে ঢুকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত। ৫৯.৪১ শতাংশ মানুষ মনে করে, এনডিএ সরকারের আমলে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় নেই। আবার ৩০.১০ শতাংশ মানুষ মনে করে, সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় আছে। ১০.৫৮ শতাংশ মানুষ বলছে, তারা এ প্রশ্নের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Kalerkontho
03.06.2018

0 comments:

Post a Comment