ভারত মহাসাগরের চীন ও ভারতের প্রভাববলয় বিস্তারের দ্বন্দ্ব মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। মূলত সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সময় সীমায় মালদ্বীপ বেশি মাত্রায় চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গেল বছর ইয়ামিন নির্বাচনে হেরে যান বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর কাছে। ইয়ামিনকে বিবেচনা করা হয় ‘প্রো-চীন’ হিসেবে, অর্থাৎ চীনাপন্থি। অন্যদিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সলিহ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ, যিনি এখন পার্লামেন্টের স্পিকার, তাদের গণ্য করা হয় ‘প্রো-ইন্ডিয়ান’। অর্থাৎ ভারতপন্থি হিসেবে। ভারত যে মালদ্বীপকে কত বেশি গুরুত্ব দেয়, তার প্রমাণ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট সলিহর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে (নভেম্বর ২০১৮) মোদির উপস্থিতি। আর দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরপরই প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি মালদ্বীপকে বেছে নিলেন। তারপর মোদি যান শ্রীলঙ্কায়। মোদির এই সফরে তিনি মালদ্বীপকে বড় ধরনের ঋণ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার অনেক আগেই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের জেলে পুরেছিলেন, যাদের অধিকাংশই এখন ক্ষমতায় (সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদসহ) এবং এরা সবাই ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এর ‘প্রতিবাদে’ মোদি ২০১৫ সালে তার মালদ্বীপ সফর বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। এরপর দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবদুল্লাহ ইয়ামিন হেরে যান। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন মালদ্বীপে যে ভারতীয় হেলিকপ্টার মোতায়েন ছিল, তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। খুব সংগত কারণেই ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এটা ভালো চোখে দেখেননি। ইয়ামিনের চীনাপ্রীতি ভারতের নীতিনির্ধারকরা দেখেছিলেন ভারত বিরোধিতা হিসেবে। ইয়ামিন যখন নতুন একটি বিমানবন্দর নির্মাণ ভারতীয় কোম্পানির কন্ট্রাক্ট বাতিল করে দিয়ে চীনা কোম্পানিকে দিয়েছিলেন, তখন ভারত এই সিদ্ধান্তকে দেখেছিল ভারতীয় জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে। তখন থেকেই মূলত দ্বন্দ্বটা হয়েছিল।
মোদির শাসনামলে ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারত দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। মোদির জমানায় ভারত ‘মনরো ডকট্রিনের’ ভারতীয় সংস্করণের জন্ম দিয়েছেন। পাঠকদের একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মোদির জমানায় ওড়িশার ভুবনেশ^রে ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রীম’ (আইওআর)-এর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) কথা। ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। সুষমা স্বরাজ তার বক্তব্যে স্পষ্ট করেই তখন বলেছিলেন, ভারত মহাসাগরে অন্য কোনো দেশ ‘কর্র্তৃত্ব’ করবে, ভারতের এটা পছন্দ নয়। ভারত এটা বরদাশত করবে না। অজিত দোভাল তার বক্তব্যে সুষমা স্বরাজের বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন। অর্থাৎ মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে ভারতের জন্য যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে ভারত মহাসাগর পালন করছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চীনের জন্যও এই ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব অনেক। চীনের যে ‘জ¦ালানি ক্ষুধা’ অর্থাৎ জ¦ালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে চীন ভারত মহাসাগরের ‘সি লাইনস অব কমিউনিকেশন’-এর ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল। বিশ^ জ¦ালানি বাণিজ্যের অর্থাৎ জ¦ালানি তেল রপ্তানির ৮০ ভাগ এই সমুদ্রপথ ব্যবহার করে। এর মাঝে ৪০ ভাগ পরিবহন করা হয় ভারত মহাসাগর অবস্থিত ‘স্ট্রেট অব হরমুজ’, আর ৩৫ ভাগ ‘স্ট্রেট অব মালাক্কা’ এবং ৮ ভাগ ‘বাব এল মানদেব’ প্রণালি দিয়ে।
চীনের জ¦ালানি আমদানি এ পথ ব্যবহার করেই সম্পন্ন হয়। চীন তাই তার ওই জ¦ালানি সম্পদ আমদানি নিশ্চিত করতে চায়। আর এটা করতে গিয়ে চীন দুটো পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘মুক্তার মালা’ (String of Pearls ) এবং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনা হচ্ছে চীনের স্ট্র্যাটেজির অংশ। চীনের এই স্ট্র্যাটেজি ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। জিবুতিতে চীন তার সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের সিত্তে, পাকিস্তানের গাওদার আর মালদ্বীপের মারাও ঘাঁটিতে পোর্ট সুবিধা পায় চীনা নৌবাহিনী। হামবানতোতীয় (শ্রীলঙ্কা) চীনা জাহাজের আনাগোনা আছে। কেননা শ্রীলঙ্কা চীনা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটি চীনকে ‘লিজ’ দিয়েছে। একই সঙ্গে তাজিকিস্তানে অলিখিত চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। পাকিস্তানে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর রক্ষায় (বেলুচিস্তান) সেখানে চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। আফগানিস্তানের ওয়াকান করিডরে (Wakhan Corridor ), যা তাজিকিস্তান ও পাকিস্তানকে আলাদা করেছে এবং যে করিডরটি চীন সীমান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত, এখানেও চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। চীনের এই উপস্থিতিতেই চ্যালেঞ্জ করে ভারতও ভারত মহাসাগরের কয়েকটি দেশে তার নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে। সিসিলি ও মরিশাসে ভারতীয় নৌঘাঁটি রয়েছে। তাজিকিস্তানের ফারখর বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে। আরও একটা বিষয় চীন যখন তার মহাপরিকল্পনা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে (যাতে বাংলাদেশ যোগ দিলেও ভারত যোগ দেয়নি), তখন ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডরের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে এক ধরনের ‘দ্বন্দ্ব’ তৈরি হয়েছে ভারত ও চীনের মধ্যে। এই দ্বন্দ্ব দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও প্রভাবিত হবে। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। এই বড় অর্থনীতি পাশের দেশগুলোর ওপর এক ধরনের প্রভাব ফেলছে। চীন ও ভারত উভয় দেশই চাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে প্রভাববলয় বিস্তার করতে।
নরেন্দ্র মোদির আগামী পাঁচ বছর তাই দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ‘সার্ক’কে বাদ দিয়ে ‘বিমসটেক’কে গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেপাল ও শ্রীলঙ্কা মানবে না। অতীতে ভারতের সিদ্ধান্তের পেছনে ভুটান, বাংলাদেশ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেপাল ও আফগানিস্তানের সমর্থন ছিল। ২০১৬ সালে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের যোগদানের অসম্মতির পাশে ভারত বাংলাদেশ, ভুটান, আফগানিস্তান এমনকি নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সার্কের অবলুপ্তি কিংবা সার্ককে অকার্যকর করা, অনেক দেশই হয়তো মানতে চাইবে না। এ ব্যাপারে ভারতের উদ্যোগটাই হলো আসল। এখন যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার স্বার্থ কোথায় রক্ষিত? সার্কের মাধ্যমে না বিমসটেকের মাধ্যমে তা রক্ষিত হবে? ভারতে নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূত নিলাম্বর আচারিয়া সম্প্রতি বলেছেন, ভারত যে বিমসটেককে চাঙা করতে চাচ্ছে, তা কখনোই সার্কের বিকল্প হতে পারে না। তার মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ছাড়া এ অঞ্চলের অগ্রগতি হবে না। তিনি বলেছেন, সার্ক একান্তভাবেই দক্ষিণ এশিয়া সংস্কৃতি, পরিচয় এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে অভিজ্ঞতাকে বহন করে। এটা এক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। নেপালের প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে সার্কের চেয়ারম্যান কে পি আলি বারবার বলে আসছেন তিনি দক্ষিণ এশীয় সংস্থাটিকে চাঙা করতে চান। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি, মোদির শপথ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ না জানানো, ইমরান খানের লিখিত চিঠি উপেক্ষা করাÑ সব মিলিয়ে এই দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা কম। ফলে ভবিষ্যতে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
এ পরিস্থিতিতে বলার অপেক্ষা রাখে না মোদির মালদ্বীপ সফরের একটা প্রতিক্রিয়া থেকে যাবেই। মোদির মালদ্বীপ সফরে ভারত মালদ্বীপের সঙ্গে ছয়টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মাঝে একটি চুক্তি বেশ গুরুত্বপূর্ণÑ আর তা হচ্ছে ‘কোস্টাল সার্ভিসেস রাডার সিস্টেম’। এর মধ্য দিয়ে ভারত মহাসাগরে চীনা জাহাজের ওপর নজরদারি করার সুযোগ পাবে ভারত। এই রাডারগুলো গেল বছরই (২০১৮) বসানো হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন আবদুল্লাহ ইয়েমিন সরকার তা চালু করতে দেয়নি। ভারতপন্থি সলিহ ক্ষমতায় আসার পরই এখন এসব রাডার চালু করা হলো। সেখানে ১০টি রাডার বসানো হয়েছে। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘ভারত মহাসাগরে এই দ্বীপরাষ্ট্রের একটি নিজস্ব অর্থনৈতিক ক্ষেত্র রয়েছে। সেটির নিরাপত্তার জন্য ওই রাডার সিস্টেম বসানো হয়েছে। তবে চীন এতে খুশি হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরÑ গেল বছর ডোকলাম সংকট নিয়ে ভারত ও চীন যখন এক ধরনের সংঘর্ষের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল, তখন সাতটি সাবমেরিন ও সমরসজ্জা সজ্জিত ১৪টি যুদ্ধজাহাজ ভারত মহাসাগরের এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল (আনন্দবাজার, ৯ জুন)। উল্লেখ্য, চীনের ‘জ¦ালানি ক্ষুধার’ কারণে চীন পরিপূর্ণভাবে ভারত মহাসাগরের এই সমুদ্রপথের ওপর নির্ভরশীল। চীনের বাণিজ্যের ৩ ভাগের ১ ভাগ এই সমুদ্রপথ ব্যবহার করে হয়। ২০০০-২০১৪ সময় চীনের জ¦ালানি আমদানি বেড়েছে ৭০ ভাগ। আর এই পথ দিয়েই তা চীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে চীন স্বাভাবিকভাবেই তার জ¦ালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইবে। মালদ্বীপের পর মোদি শ্রীলঙ্কাও গিয়েছিলেন। এই রাষ্ট্রটির অবস্থানও চীনাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমগুরুত্ব ভারতের কাছেও। ফলে মোদির এই সফর এক বার্তা দিয়ে গেলÑ আর সেই বার্তাটি হচ্ছে ভারত মহাসাগরের এই অঞ্চলে ভারত অন্য কারও ‘কর্র্তৃত্ব’ সহ্য করবে না। এটাই হচ্ছে ‘মোদি ডকট্রিন’, যাকে ‘মনরো ডকট্রিনের’ ভারতীয় সংস্করণ বলা যেতে পারে।
Daily Desh Rupantor
12.06.2019
0 comments:
Post a Comment