দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের কারণেই ‘আরব বসন্ত’র জন্ম হয়েছিল। ইয়েমেনে আলী আব্দুল্লাহ সালেহ (১৯৭৮-২০১১), তিউনিসিয়ায় জাইন আল আবেদিন বেন আলি (১৯৮৭-২০১১), লিবিয়ায় মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি (১৯৬৯-২০১১), দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে সেখানে সবাই এক ধরনের গোষ্ঠীতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। বেকার সমস্যা সেখানে ছিল প্রবল। তরুণদের জন্য কোনো চাকরির ব্যবস্থা ছিল না। দুর্নীতিতে দেশগুলো ছিল শীর্ষে। গণতন্ত্র সূচকে দেশগুলোর অবস্থান ছিল অনেক নিচে। ফলে দীর্ঘদিনের অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটেছিল ২০১১ সালে। জন্ম হয়েছিল ‘আরব বসন্ত’। কিন্তু গত ৮ বছরের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে সেখানে নতুন ধরনের স্বৈরশাসনের জন্ম হয়েছে। মিসরের পাশাপাশি লিবিয়ায় গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রটি এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম, সেখানে আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল হাফতার এখন লিবিয়া দখলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। ইয়েমেনে কোনো কেন্দ্রীয় শাসন নেই। সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। তিউনিসিয়ায় এক ধরনের গণতন্ত্র বিকশিত হলেও মুসলিম জঙ্গিবাদ সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মিসরে হোসনি মুবারকের স্বৈরতান্ত্রিকতা যখন জনগণের কাঁধে জোয়ালের মতো চেপে বসেছিল, তখনই উদ্ভব ঘটেছিল মোহাম্মদ মুরসির। প্রকৃত ধর্মীয় নেতা বলতে যা বোঝায় কিংবা পশ্চিমের দৃষ্টিতে যেটাকে ইসলামি মৌলবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার একটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়, মুরসি ঠিক তেমনটি ছিলেন না। মুরসি প্রথমবারের মতো নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে মিসরের পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০০ সালে। তিনি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এ যোগদান করেন ২০০৫ সালে। তবে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর আত্মপ্রকাশ করে ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’। বিপ্লব পরবর্তী মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রথম পছন্দ ছিলেন খায়রত আল শাতের। কিন্তু অতীতে অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকার প্রমাণ থাকায় তিনি মুরসির থেকে পিছিয়ে পড়েন। বলতে গেলে অনেকটা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় পদটি পেয়ে যান মুরসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ৩০ জুন মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন মুরসি। কিন্তু তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। তাতে তিনি প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। এমনকি বিচার বিভাগের কাছেও জবাবদিহি করতে প্রেসিডেন্ট বাধ্য থাকবেন না, এ ধরনের কথাও ছিল ওই ডিক্রিতে। আদালতের ক্ষমতা খর্ব করার পাশাপাশি ক্ষমতায় আসার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে নানাদিক থেকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন মুরসি। এর পেছনে কারণ হিসেবে দেখা হয়েছিল যে তিনি মিসরের রাজনীতিতে প্রবেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মুরসি গণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও, কিছু কিছু ‘ভুল’ তিনি করেছিলেন। তিনি অতি দ্রুত ইসলামিকরণের দিকে গিয়েছিলেন। মিসরে নারীরা তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করলেও নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে মুরসি এতটা ‘উদার’ ছিলেন না। মিসরে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন এবং পশ্চিমের দৃষ্টিতে তারা আধুনিকমনস্ক। পূর্ণ পর্দাপ্রথা তারা অনুসরণ না করলেও শালীনতা তারা বজায় রেখে চলেন। মুরসি এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি মিসরে হিজাবকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এতে করে নারীদের মাঝে ভিন্ন একটা মেসেজ পৌঁছে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে তিনি ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করেছিলেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনী যে একটি ‘শক্তি’ তা তিনি বিবেচনায় নেননি। মিসরের ২১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ১০ থেকে ১৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সেনাবাহিনী তেল, দুধ, বেকারি, সুপেয় পানি, সিমেন্ট, গ্যাসোলিন, রিসোর্ট ও যানবাহন উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত। কোনো সরকারের পক্ষেই সেনাবাহিনীর এই ‘ক্ষমতাকে’ অস্বীকার করা সম্ভব না। মুরসি এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মিসরে সেনাবাহিনী বরাবরই একটি ‘রাজনৈতিক ভূমিকা’ পালন করে গেছে। ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মুবারকের পতন পর্যন্ত সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দল গঠন করে (লিবারেশন, র্যালি, ন্যাশনাল ইউনিয়ন, আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি) ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এ কারণে দেখা যায় মিসরে জনগণের অন্য কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়নি। ফলে সেনাবাহিনীই মূল শক্তি হিসেবে থেকে গেছে। হোসনি মুবারক ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর সীমিত সময়ের জন্য সেনাবাহিনী ‘ব্যাক সাইডে’ চলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী কিছুটা সময় নিয়েছিল নিজেদের সংগঠিত করতে। শেষ অবধি জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসির নেতৃত্বেই তারা সংগঠিত হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে। ইতিহাস বলে মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরের সেনাবাহিনী সেই ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
মুরসির আরেকটা সমস্যা ছিল তিনি বেশিরভাগ ইসলামপন্থিদের এক কাতারে নিয়ে আসতে পারেননি। ‘আল নুর’ নামে একটি ইসলামপন্থি সংগঠন হয়েছে, মিসরে যারা যথেষ্ট শক্তিশালী। পশ্চিমা বিশ্বে তাদের সালাফিস্ট হিসেবে নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ এরা আদি ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। এদের সঙ্গে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর রাজনৈতিক পার্থক্য রয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুড যেভাবে মিসরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আল নুর সেভাবে চায় না। আল নুর বেশ কনজারভেটিভ হলেও সে তুলনায় ব্রাদারহুড অনেকটা লিবারেল। আরব বসন্ত পরবর্তী মিসরে মাত্র দু’ বছর আগে আল নুর সংগঠনটির জন্ম। মজার ব্যাপার হচ্ছে সামরিক বাহিনী যখন মিসরে ক্ষমতা দখল করল, তখন আল নুর পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন না করে সমর্থন করেছিল জেনারেল সিসিকে। এতে করে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আল নুর রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিল।
ইয়েমেন ও লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশ দুটি কার্যত একাধিক অংশে বিভক্ত হয়ে আছে। অস্ত্র সেখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই দেশ দুটিতে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই। অস্ত্রবাজরা এক এক অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে স্বশাসিত প্রশাসন চালু করেছে। লিবিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন জেনারেল হাফতার, যিনি এক সময় গাদ্দাফির একজন ঘনিষ্ঠ জেনারেল ছিলেন। ইয়েমেনে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ হুথি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছেন। সৌদি বিমানবাহিনী সেখানে নিয়মিত বোমা বর্ষণ করে চলেছে। সেখানে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’ চলছে। ইরান সমর্থন করছে হুতি বিদ্রোহীদের, যারা এখন রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করছে। গণঅভ্যুত্থানে আলী আব্দুল্লাহ সালেহকে উৎখাতের পর আবদ রাব্ব মনসুর হাদি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে নিরাপত্তার অভাবে তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। সেই থেকে তিনি সৌদি আরবে আছেন। আর সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তার সমর্থনে হুতিদের (ইরান সমর্থিত) ওপর বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছেন। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’ বা ‘ছায়াযুদ্ধে’র জন্ম হয়েছে।
‘আরব বসন্ত’ পুরো আরব বিশ্বে পরিবর্তন আনলেও ব্যতিক্রম হচ্ছে সিরিয়া। সিরিয়ায় ২০১৪ সালে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আইএস’-এর উত্থান; সমস্ত মুসলিম বিশ্ব নিয়ে একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা কিংবা মাত্র দু বছরের মাথায় (২০১৬-২০১৭) সময়সীমায় ‘আইএস’-এর পতনের পরও আসাদ সরকার সেখানে এখনো টিকে আছে। তিনি সেখানে ক্ষমতায় আছেন ২০০০ সাল থেকে। মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ ও অব্যাহত বোমা বর্ষণের পরও আসাদ সরকার টিকে আছে শুধুমাত্র রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কারণে। রাশিয়া আসাদ সরকারকে সমর্থন করছে। আর যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করছে আসাদ বিরোধীদের। এখানে পরিবর্তনটা আসেনি। তবে ‘আরব বসন্ত’র ঢেউ অন্যত্রও আঘাত করেছিল। ওমান ও বাহরাইনের রাজপরিবার দেশের সংবিধান সংস্কার করে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রাজা হবেন আনুষ্ঠানিক প্রধান। সম্মিলিত আরব আমিরাতেও এক ধরনের গণতন্ত্র চালু হয়েছে। ‘আরব বসন্ত’ সৌদি রাজপরিবারের ভিতকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে। কিছু সংস্কারের কথা তারা বলছেন। তবে এই মুহূর্তে ইরানের দিকে দৃষ্টি অনেকের। ইরান আরব বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত না হলেও আরব বিশে^র উত্থান-পতনে ইরানের একটি ভূমিকা রয়েছে।
‘আরব বসন্ত’ সময়কালে মিসরে মোবারকবিরোধী গণআন্দোলনের মূল স্পিরিট ছিল ‘Bread, Freedom, Social Justice’’- অর্থাৎ খাদ্য, স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা। ‘আরব বসন্ত’র মধ্য দিয়ে সেখানে প্রায় সব দেশেই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য দূর হয়নি। কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি। আর সাম্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধুমাত্র একটি ‘কসমেটিক’ পরিবর্তন হয়েছে অর্থাৎ ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। সাধারণ মানুষ এর মধ্য দিয়ে উপকৃত হয়নি
Daily Desh Rupantor
25.06.2019
0 comments:
Post a Comment