ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদি দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে প্রথম বিদেশ
সফর হিসেবে বেছে নিয়েছেন মালদ্বীপকে। তিনি ৭-৮ জুন মালদ্বীপ সফর করেন। তার
এই মালদ্বীপ সফর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রথম শাসনামলে (২০১৪-১৯)
নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি ছিল তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম একটি দিক।
দায়িত্বগ্রহণ করার পরপরই ২০১৪-১৫ সালে তিনি প্রতিটি সার্কভুক্ত দেশ সফর
করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি জানান দিয়েছিলেন তিনি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর
সঙ্গে সম্পর্কে অগ্রাধিকার তালিকায় প্রথমেই রাখছেন। এ ধারাবাহিকতায় কী তিনি
তার দ্বিতীয় টার্মে প্রথমেই মালদ্বীপকে বেছে নিলেন? এটা তিনি নিঃসন্দেহ
বিবেচনায় নিয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে যে বিষয়টি তা হচ্ছে
মালদ্বীপের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান ও মালদ্বীপে চীনা অভাব বৃদ্ধি।
শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছিল। চীন হামবানতোতায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর
নির্মাণ করেছে এবং সেখানে চীনা সাব-মেরিনের উপস্থিতির কারণে ভারত এটাকে
তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছিল ফলে সেখানে রাজাপাকসে সরকারের
পতন ঘটে। ভারত এখন জাপানকে সঙ্গে নিয়ে কলম্বোতে আরেকটি ডিপ সি-বোর্ট করছে।
শুধু তাই নয়। হামবানতোতায় চীন যে বিমানবন্দরটি তৈরি করেছিল (মাত্তালা
রাজাপাকসে বিমানবন্দর) যা ফ্লাইট না পাওয়ার কারণে একরকম পরিত্যাক্ত ছিল, তা
এখন ভারত ও শ্রীলঙ্কার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় ভারতের
প্রভাব এখন বাড়ছে। শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি মালদ্বীপ ছিল ভারতের চিন্তার অন্যতম
কারণ। সম্প্রতি মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট (আবদুল্লা ইয়ামিনের)
শাসনামলে দেশের উন্নয়নের নামে চীন থেকে প্রচুর ঋণ গ্রহণ করে (মাথাপিছু এ
ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ডলার), যা কি না অনেকটা ৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
চীনা অর্থে মালদ্বীপ চীন মৈত্রী সেতু চালু হয়েছে যা হুলহুলে দ্বীপে অবস্থিত
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে রাজধানী মালের সঙ্গে সুমদ্রপথে সংযুক্ত করেছে।
মালদ্বীপ সফরে এসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ২০১৪ সালে। এর পরপরই
দৃশ্যপট পাল্টে যায়। চীনকে ৮৫৯০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এলাকায় বিশেষ
অর্থনেতিক জোন প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হয়। ওলহুভেলি দ্বীপে চীন রিসোর্ট তৈরি
করছে, যেখানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ৫০৯টি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি প্রায় শেষ
করছে চীন। মালদ্বীপে চীনা প্রভাব কমাতে মোদি সরকার এখন মালদ্বীপকে ১ মিলিয়ন
ডলারের লাইন অব ক্রেডিট দিচ্ছে। তবে মোদির দ্বিতীয় টার্মে ভারত-পাকিস্তান
সম্পর্ক নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।
ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকাÐে মদদ দেওয়ার অভিযোগ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি, চীনের জিন জিয়াং থেকে বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দরের সংযুক্তি) ও নানা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাÐ ইত্যাদি নানা কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা আস্থাহীনতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মোদির শপথ অনুষ্ঠানে ইমরান খানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এতে করে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। মোদির শপথ অনুষ্ঠানে কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিরিকিস্তান মধ্য এশিয়ার একটি দেশ। এবং বর্তমানে কিরগিজস্তান এসসিও বা সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য। মধ্য এশিয়া এবং আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। বলা ভালো মধ্য এশিয়ার তাজিকিস্তানের ফকহোর বিমান ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান মোতায়েন করা হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এখানে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে এবং এক স্ক্রোয়ার্ড মিগ-২৯ বিমান মোতায়েন করে। এসআই-১৭ হেলিকপ্টারও সেখানে রয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে আফগানিস্তানে রিলিফ কার্যক্রম চালানোর জন্য এখানে বিমান মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ আছে ক্রমাবর্ধমান চীন-পাকিস্তান সম্পর্কে বিশেষ করে চীনের যেকোনো সাময়িক তৎপরতা মনিটর করার জন্যই এ বিমানবাহিনী মোতায়েন। উল্লেখ করা প্রয়োজন গাওদার (বেলুচিস্তান) এ চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইরানের বেলুচিস্তান প্রদেশের ওপর চাপাহারে ভারত একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। শুধু তাই নয় চাপাহার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করছে ভারত। এই চাপাহার বন্দর ভারতের ইউরো এশিয়া স্ট্র্যাটেজিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। ক্রমবর্ধমান চীন-ভারত (ভারত মহাসাগরে) চাপাহার বন্দরটি আগামী দিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ট্রাম্পের জামানায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। মোদির বিজয়ে ট্রাম্প উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেছেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজি তাতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পার্টনার। এই অ্যালায়েন্স আগামী দিনে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। ট্রাম্প প্রশাসন চাচ্ছে ভারত আগামী দিনে আফগানিস্তানের ব্যাপারে একটি বড় ভ‚মিকা পালন করুক। ভারতে কিরগিজ প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে তার এ স্ট্র্যাটেজি কাজ করছে। আগামী ১৩-১৪ জুন কিরগিজস্তানে পরবর্তী এসসিও শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। মোদি ওই সম্মেলনে যোগ দেবেন। পাকিস্তান এসসিওর সদস্য বিধায় ইমরান খানও ওই সম্মেলনে যোগ দেবেন। কিন্তু মোদি ইমরান বৈঠকের সম্ভাবনাও সেখানে ক্ষীণ। মোদি আগামী ৫ বছরে মধ্য এশিয়াকে তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে নেবেন। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কও বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়, সেদিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। মরিশাসের প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে ভারত যে তার প্রভাব বাড়াতে চায় এটা অনেকটা প্রমাণ। মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলে ভারত আগামী দিনে তার প্রভাব বাড়াবে। মোদির পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার তালিকায় এসব অঞ্চল থাকবে এখন। তবে এটা বলতেই হয় মোদির দ্বিতীয় টার্মে, অর্থাৎ আগামী ৫ বছরে সার্ক অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। পাকিস্তান যদি সার্ক থেকে বেড়িয়ে যায় এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্পর্ক গড়ে তোলে, আমি তাতে অবাক হব না। মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ মনোনয়ন দিয়েছেন। এক সাবেক পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্করকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়েছে। দুই নিরাপত্তা উপদেষ্টা দোভালকে আবার নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ ও তাকে পদোন্নতি দিয়ে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা দান। পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োজনে এরা দুজন গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবেন। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মির প্রশ্নে তার নীতি ঠিক করেছেন। কলকাতার আনন্দবাজার এ খবরটি দিয়েছিল বটে। কিন্তু নীতিগুলো কী হবে, তা জানায়নি। কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে যায় অমিত শাহ কাশ্মিরের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে একটি হার্ডলাইনে যাচ্ছেন। আর নিরাপত্তা উপদেষ্টা দোভাল যে এ ক্ষেত্রে একটি বড় ভ‚মিকা পালন করছেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচনের আগে ১৪ ফেব্রæয়ারি (২০১৯) ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের পুলওয়ামা জেলার লেথপুরা গ্রামে পেতে রাখা বোমায় ভারতের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশের ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু ও এর প্রতিক্রিয়া ২৬ ফেব্রæয়ারি (২০১৯) ভারতীয় বিমানের পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বালাকোটে (পাখতুনখোয়া) বিমান হামালা (যাতে পাকিস্তান একটি ভারতীয় বিমান ধ্বংস করে ও পাইলটকে আটক করে) এ ঘটনা নির্বাচন প্রভাব ফেলেছিল। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল তার এই ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিল। এখন অমিত শাহ যদি আরও কঠোর হন, তাহলে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বেই। এমনিতেই অমিত শাহর সম্ভাব্য ভ‚মিকা নিয়ে খোত মন্ত্রিসভায়ও নানা বিতর্ক আছে। নরেন্দ্র মোদি তাকে মন্ত্রিসভার ৮টি কমিটিতে রেখেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনাথের ক্ষমতাও কমানো হয়েছে। অমিত শাহ মোদি মন্ত্রিসভায় দুই নম্বর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার ভ‚মিকা আগামী দিনে লক্ষ রাখার মতো। এদিকে নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি প্রশ্ন স্বীকার করলেন, প্রতিবেশী নীতির প্রশ্নে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ সার্কের কিছু সমস্যা রয়েছে। এই বক্তব্য স্পষ্ট করে ছিল ভারতের আগামী পররাষ্ট্রনীতি কী হবে? ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার তালিকায় নেইবারহুড ফার্স্ট থাকলেও উপেক্ষিত হচ্ছে সার্ক। সার্ক এখন সাইড লাইনে চলে যাবে। তাতে করে ভারতের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ প্রশ্ন অনেকেই করবেন। মোদির আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশও যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে। তার জামানায় তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা বেশি। কেননা লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভালো না করা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থান শক্তিশালী হওয়ার বাংলাদেশের প্রশ্নে মোদির অবস্থান শক্তিশালী হবে এখন। তবে অমিত শাহ কিংবা জয়শঙ্কর দোভাল জুটি পররাষ্ট্রনীতিতে বড় প্রভাব ফেলায় বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কোন পর্যায়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয়। Daily Somoyer Alo 10.06.2019 |
মোদির মালদ্বীপ সফর ও ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি
05:10
No comments
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment