একটি টিভি চ্যানেলে একটি অডিও রিপোর্টও প্রকাশ করে, যাতে অভিযুক্ত মিজান দুদক কর্মকর্তা বাছিরকে যে ঘুষ দিতে চেয়েছেন তার কথোপকথন প্রকাশ পেয়েছে। ইতিমধ্যে ওই দুদক কর্মকর্তা ‘তথ্য ফাঁস’ করার অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, ফাঁস হওয়া অডিওতে যে কণ্ঠ রয়েছে তা তার নয়।
মিজান-বাছির ‘কাহিনী’ ছিল গেল সপ্তাহে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এ নিয়ে ‘টকশো’ পর্যন্ত হয়েছে। আমরা জানি না মিজান-বাছির কাহিনী শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে- এ ঘুষ দেয়া ও ঘুষ নেয়ার ঘটনা পুলিশ ও দুদকের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। যদিও দুদকের অনেক ভালো কাজ আমাদের আশাবাদী করেছিল।
মিজানের পাশাপাশি আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমের ‘কাহিনী’ও গত সপ্তাহে ব্যাপক আলোচিত ছিল। তিনি ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে গত ৬ এপ্রিল পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১০ এপ্রিল তিনি মারা যান। ওই সময় সোনাগাজী থানায় নুসরাতের পরিবার মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে ওই সময় থানায় দায়িত্বরত ওসি মোয়াজ্জেম তাকে আপত্তিকর প্রশ্ন করেন এবং তা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওসির বিরুদ্ধে মামলা হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ১৬ জুন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দুই.
মিজান-মোয়াজ্জেমের কাহিনী পুলিশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। মিজান কেন ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন কিংবা কেন তিনি অডিওটি ফাঁস করেছেন, তা তিনি নিজে স্বীকারও করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি নিজেকে বাঁচাতেই ওই কাজটি করেছেন! এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমরা জানি না। কিন্তু পুলিশের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হল, তা কি তিনি একবারও চিন্তা করেছেন? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অবৈধ সম্পদ আহরণের। পুলিশের চাকরিকালীন তিনি কি এই সম্পদ অর্জন করতে পারেন? যে ৪০ লাখ টাকা তিনি ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন তার উৎস কী? নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সারা জাতি কেঁদেছিল। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত এ ঘটনা স্পর্শ করেছিল।
পুলিশের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। আমার একটা দুর্বল জায়গা হচ্ছে এই পুলিশ বাহিনী। আমার অনেক ছাত্র এখন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। জাতিসংঘের পুলিশ বাহিনীতে যখন আমার ছাত্রী কমান্ডে থাকে, তখন একটা প্রচণ্ড ভালোলাগা আমাকে স্পর্শ করে। আবার যখন ছোটখাটো দু-একটি ঘটনায় পুলিশের উদাসীনতা ধরা পড়ে, তখন খারাপ লাগে। যখন পরিচিত কোনো পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়, তখন কষ্ট লাগে বৈকি! পুলিশের ওপর থেকে কি আস্থাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? তাহলে কার কাছে যাব আমরা? কোথায় যাব? কয়েক মাস আগে একটি জাতীয় দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদকের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছিল একজন পুলিশ সার্জেন্ট। তার পরিচয়, জাতীয় পর্যায়ে অবস্থান ও স্বীকৃতির পরও কি একজন সার্জেন্ট এ ধরনের আচরণ করতে পারেন? শেষ অবধি বিষয়টি কোথায় গড়িয়েছিল আমি বলতে পারব না। কেননা আমি ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকাগুলোতে সংবাদটি ছাপা হয়েছিল। আমার নিজের তিনটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। রাতে নাগরিক টিভির টকশো করে ফিরছি। আমি যেখানে বর্তমানে বসবাস করি (উত্তরা ১৮ সেক্টর), সেখানে রাতের বেলা নিরাপত্তার অভাব দেখিয়ে গাড়ি প্রকল্প এলাকায় ঢুকতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। যথারীতি আমাকে ঢুকতে দেয়া হল না। একজন এসআই আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলেন। উত্তরার ডিসিকে বললাম। তিনি বললেন লিখিত দিতে। দিলাম। ডিসি সাহেব আবার বড় অফিসার! আমার বই পড়ে বিসিএস দেয়া ডিসি সাহেবও তার ‘ক্ষমতা’ দেখালেন! আমরা আমজনতা। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কী মূল্য আছে তার কাছে দেখলাম। ওই ঘটনায় কী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত জানি না। কিন্তু ডিসি সাহেব প্রয়োজন বোধ করলেন না একজন ‘সিলেকশন গ্রেডে’র প্রফেসরকে ওই ঘটনার ‘ফলোআপ’ জানানোর। একজন প্রফেসরের মূল্য তার কাছে কী? একজন এসআই তার কাছে বড়। আমাদের দুঃখ এখানেই, আমরাই এসব অফিসারকে তৈরি করি।
দ্বিতীয় ঘটনা ওই উত্তরাতেই। আমি প্রতারণার শিকার হলাম। অভিযোগ করলাম। দায়িত্ব দেয়া হল এক পুলিশ কর্মকর্তাকে। তিনি উত্তরা পশ্চিমের জোনাল কর্মকর্তা। তিনি আমাকে জানালেন তার কিছুই করার নেই! অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। মানুষ তো পুলিশের কাছেই ‘সাহায্যের’ জন্য যায়। আমার মতো একজন ব্যক্তিও যদি পুলিশের সাহায্য না পায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কী পুলিশের কাছ থেকে সহযোগিতা আশা করতে পারে?
তৃতীয় ঘটনায়ও পুলিশের মুখোমুখি আমি। এবার আমি অভিযুক্ত! আমার গাড়ি ‘আইন অমান্য’ করেছে! ট্রাফিক ভায়োলেশন! চিঠি পাঠিয়েছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। পুলিশের গোপন ক্যামেরা টিম আছে। সেই ক্যামেরায় ধরা পড়েছে আমার গাড়ি ট্রাফিক আইন লংঘন করেছে! সুতরাং ফাইন। গেলাম ট্রাফিক (পশ্চিম) জোন অফিসে। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। ডিসি সাহেব এলেন না। ফাইন দিলাম। দেখলাম পুলিশের নাকের ডগাতেই একটি অসাধু চক্র ব্যাংকের হয়ে এই ‘ফাইন’ সংগ্রহ করছে! পুলিশ কি তাহলে এর অনুমতি দিয়েছে? আমি আইন মেনে চলা নাগরিক। ফাইন দিলাম। যার কাছে জানতে গিয়েছিলাম তিনি উর্দি পরা অফিসার। প্রয়োজনবোধ করলেন না আমার ড্রাইভার কোথায় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেছেন তা দেখানোর! তার কাছে ভিডিও আছে। বললেন ট্রাফিক আইন ভঙ্গ হয়েছে! তার বক্তব্যই ঠিক। তাকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না- তার ভাষায় আইন ভঙ্গ হয়েছে। তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া অর্থহীন। আমার ইচ্ছে ছিল ট্রাফিকের ডিসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করার সন্ধ্যার পর যখন টেকনিক্যাল মোড় থেকে শ্যামলী পর্যন্ত প্রতিদিন দূরপাল্লার গাড়িগুলো রাস্তার দু’পাশে ‘অবৈধ পার্কিং’ করে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করে রাখে, তখন কোথায় থাকে পুলিশের ওই ক্যামেরা? কোথায় থাকে তখন ট্রাফিক আইন? কথাটা বলতে পারলাম না। কেননা পুলিশের সঙ্গে ‘বিতর্কে’ জড়ানো মানেই বিপদ ডেকে আনা! ওই নির্বাহী সম্পাদক সার্জেন্টের সঙ্গে অযথা ‘বিতর্কে’ জড়িয়ে বিপদ সৃষ্টি করেছিলেন। আমি নিরীহ মানুষ। আমি ডজন ডজন পুলিশ কর্মকর্তা সৃষ্টি করেছি বটে। কিন্তু আস্থার জায়গাটা যেন কেন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তিন.
যখন মিজান-মোয়াজ্জেম প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছি তখন চোখ আটকে গেল একটি সংবাদে। সংবাদটি ছাপা হয়েছে মানবজমিনে, গত ৭ মার্চ। সংবাদটিতে আছে আইজিপির একটি বক্তব্য। তিনি লক্ষ্মীপুর গিয়েছিলেন চন্দ্রগঞ্জ থানা ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘থানায় কেউ বেড়াতে আসে না, বিপদে পড়ে আসে। হয়রানির শিকার হলে কঠোর ব্যবস্থা।’ এ ধরনের কথাবার্তা আইজি সাহেবরা বলেন। যখন পুলিশের শীর্ষ সম্মেলন হয়, এ ধরনের কথাবার্তা আমরা শুনি। সংবাদপত্রে তা ছাপাও হয়। আইজি সাহেব সত্যি কথাই বলেছেন- মানুষ বিপদে পড়েই পুলিশের কাছে যায়। আমিও গিয়েছিলাম আইজি সাহেব। কিন্তু সাহায্য পাইনি! পুলিশ কর্মকর্তা তো আমাকে জানিয়ে দিলেন তার এই মুহূর্তে করার কিছুই নেই। তাহলে আমি এখন কী করব আইজি সাহেব? আপনি তো আমাদের ছাত্র ছিলেন। একজন এসআই যখন আঙুল উঁচিয়ে আমাকে আমার বাসস্থান এলাকায় ঢুকতে বাধা দেয়, ঘটনাটার বিচার চাইতে কি এখন আপনার কাছে আমাকে যেতে হবে? আপনি কি এবার বিচারের নির্দেশ দেবেন?
চার.
পুলিশের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। পুলিশে সংস্কার প্রয়োজন। একজন মিজান কিংবা একজন মোয়াজ্জেমকে দিয়ে আমরা অবশ্যই সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে বিচার করব না। পুলিশের সদস্যদের অনেক ভালো কাজ আছে। পুলিশের অনেক সদস্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছেন এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও সত্য কোনো কোনো পুলিশ সদস্য নিজের জীবনকে বাজি রেখে মানুষকে বাঁচিয়েছেন। দুর্ঘটনায় যাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের পা হারিয়েছেন। একটা শিশুকে উদ্ধার করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।
একজন বেকার বাবা সন্তানের জন্য দুধ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লেও একজন পুলিশ অফিসার তাকে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। সব প্রফেশনেই খারাপ লোক থাকে। ভালো লোক থাকে। শিক্ষকতায় সবাই যে ভালো তা তো নয়। আমাদের মাঝেও তো অনেক খারাপ লোক আছে। প্রধানমন্ত্রী গত ১২ জুন সংসদে বলেছেন, পুলিশের কেউ অনিয়ম করলে ছাড় পাবে না (যুগান্তর)। তিনি আরও বলেছেন, ‘ঘুষ যে দেবে আর যে নেবে, উভয়ই অপরাধী।’ এটাই হচ্ছে আসল কথা। একজন মিজান ঘুষ দিতে চেয়েছেন। এটা তার নিজের স্বীকারোক্তি। এটা অপরাধ। আইনে এ ধরনের অপরাধের বিচার হয়। আর যিনি ঘুষ নিয়েছেন, রমনা পার্কে বাজারের ব্যাগে নেয়া ওই টাকার যদি সত্যতা থাকে, সেটাও অপরাধ। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আমরা দেখতে চাই তদন্ত কমিটি কী সুপারিশ করে।
ওসি মোয়াজ্জেম অন্যায় করেছেন। এক কিশোরীর সঙ্গে তিনি যে আচরণ করেছেন, আইনের লোক হয়ে তিনি সেই আচরণ করতে পারেন না। এজন্যই বলি পুলিশে আরও সংস্কার প্রয়োজন। তাদের আরও প্রশিক্ষণ দরকার। তাদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। অন্যায়কে অন্যায় হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে।
অন্যায়কে যদি আমরা ‘চেপে’ রাখি তাহলে আরেকটা অন্যায়ের জন্ম হবে। পুলিশ সদস্যদের মনে রাখতে হবে তারা জনগণের সেবক, তারা শাসক নন। একজন কৃষকও তাদের অর্থের জোগান দেয়।
সাধারণ মানুষের প্রতি সম্মান জানালেই নিজে আরও বেশি সম্মানিত হবেন। একজন বোয়ালখালীর ওসি যখন ঢাকার বসুন্ধরায় ৮ তলা ভবনের মালিক হন (একুশে পত্রিকা), কিংবা যখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, পয়সা দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে কেনা যায় (বাংলা ট্রিবিউন, ১৫ মে), তখন তো আমাকে আশাবাদী করে না। আশাবাদী করে একজন জাহিদুল ইসলামের (এএসপি, খিলগাঁও) ভূমিকায়, যিনি দুধ চুরি করা একজন ‘বাবা’কে দোষী সাব্যস্ত করেননি। আমি আশাবাদী হতে চাই। আমার গর্বের জায়গাটা যেন নষ্ট হয়ে না যায়।
Daily Jugantor
17.06.2019
0 comments:
Post a Comment