অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি
টাকার বাজেট পেশ করেছেন গত ১৩ জুন। এটি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম
বাজেট আর আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেট
চলতি বাজেটের আকার থেকে ১৩ শতাংশ বড়। খাতওয়ারি ব্যয়ের হিসাবে বাজেটের
সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে। আগামী
অর্থবছরে বাজেটের ১৫.২ শতাংশই এ খাতে ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে শুধু
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা এই দুই মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দের পরিমাণ
বাজেটের ১০.২৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই
বিভাগের জন্য ২৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এটি নতুন বাজেটের
৫.৬৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ২৫ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা,
যা মোট বাজেটের ৫.৮৫ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন ও গুণগত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। দক্ষ শিক্ষকের কথাও বলেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি জাপানের একসময়কার সম্রাট মেইজির মতো প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসার কথাও উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাবনার দুটি দিক আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এক. তিনি গুণগত শিক্ষার মান বাড়াতে চান। দুই. প্রয়োজনে তিনি বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে চান। শিক্ষার ব্যয় বরাদ্দ বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। সব কিছুতে ব্যয় বেড়েছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে চলতে গেলে শিক্ষায় ব্যয় বরাদ্দ বাড়বে, আমি এতে অবাক হই না। কিন্তু গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করব কিভাবে? বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিত হবে কিভাবে? প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার শিক্ষার, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। কিন্তু শিক্ষার মানের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা আছে, এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। আমরা যোগ্য শিক্ষক তৈরি করতে পারছি না। গুণগত মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব যার ওপর, সেই যোগ্য নেতৃত্ব আমরা তৈরি করতে পারিনি। কেন পারিনি, এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় গলদ কোথায়, এটা নিয়ে আমি আলোচনা করব না। কেননা এ ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা কম। আমি মনে করি উচ্চশিক্ষাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, মাধ্যমিক পর্যায়ে একটা ছাত্রকে আমরা যদি দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে তাকে আমরা উচ্চপর্যায়েও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে পারব না। আর এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু এদিকে কেউ হাত দিচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যাঁরা চালান, তাঁদের অভিজ্ঞতা কম। আমলানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার আমরা জন্ম দিচ্ছি। আমলারা যা করেন, তা অনেকটাই রুটিন ওয়ার্ক। এখানে পরিবর্তন বা সংস্কার আনার কোনো উদ্যোগ নেই। মন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে আমলারা সহযোগিতা করবেন না। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই বিসিএস বেইসড হয়ে পড়েছে। কী তিনি পড়লেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা সেই শিক্ষা দিয়ে তিনি জাতিকে কতটুকু সমৃদ্ধ করতে পারবেন, এটা তাঁর কাছে কখনোই মুখ্য নয়। তাঁর কাছে মুখ্য বিসিএস পাস করা, একটা সরকারি চাকরি, চাকরির প্রবেশপথেই গাড়ি-বাড়ির সুযোগ ইত্যাদি। সুতরাং অর্থমন্ত্রী গুণগত শিক্ষার মানের কথা যখন বলেন তখন বিসিএসনির্ভর এই শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হবে কিভাবে? আমরা অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই সঙ্গে এক শর ওপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা সার্টিফিকেটসর্বস্ব জাতিতে পরিণত হয়েছি! একখানা সার্টিফিকেট আমাদের দরকার। তারপর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আমলা! একজন চিকিৎসক কিংবা একজন প্রকৌশলীকে যখন আমি পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে পাই তখন শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থাটা নষ্ট হয়ে যায়। একজন চিকিৎসক কিংবা একজন ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে রাষ্ট্র মাথাপিছু একজনের পেছনে কত খরচ করেছে? তিনি চিকিৎসক হয়ে জনগণকে সেবা করবেন। তিনি কেন পুলিশ কর্মকর্তা হবেন? একজন মহিলা জেলা জজের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম। তিনি জজিয়তি ছেড়ে বিসিএস দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন। কেন? আমার এক ভালো ছাত্র। তাকে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সুযোগ দিয়েছিলাম আমার বিভাগে। ইচ্ছা ছিল ও শিক্ষকতায় আসবে। না, সে চলে গেল পুলিশে, বিসিএস দিয়ে। ১০ বছরের চাকরিজীবনে তার একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ি-জমি হয়েছে। অথচ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো ঢাকা শহরে বাসে ঘুরে বেড়ান, ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য তাঁর হয়নি। আমার সিনিয়র সহকর্মী ছিলেন অধ্যাপক আউয়াল। শেষ জীবন তাঁর কাটছে বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁর কথা তো টিভি চ্যানেলে প্রচারিতও হয়েছে। অর্থমন্ত্রী শিক্ষার গুণগত মানের কথা বলেন। কিন্তু যে শিক্ষাব্যবস্থা বিসিএস পরীক্ষানির্ভর হয়ে যায়, সেখানে দক্ষ জনশক্তি আমরা গড়ব কিভাবে? উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যদি নজরদারি বাড়ানো না হয়, তাহলে অচিরেই উচ্চশিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে।
শিক্ষায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারে। ১. তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের নামে শিক্ষকরা এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন বেশি। নিজ প্রতিষ্ঠানে তিনি যে বেতন পান, অন্য প্রতিষ্ঠানে ‘সময় দিয়ে’ তিনি তার চেয়ে বেশি আয় করেন। সুতরাং আইন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে ‘চাকরি’ করা কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা (যেকোনোভাবে, পার্টটাইম বা কনসালট্যান্ট) নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে কেউ শিক্ষকতা বা চাকরি করতে পারবেন না। আইনটি সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ২. শিক্ষক নিয়োগে নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। উপাচার্যের ইচ্ছায় বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে—এই প্রবণতা বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধীনে পিএসসির মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর শুধু লিখিত পরীক্ষাই নয়, বরং মৌখিক ও ‘ডেমো’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এবং তিনি এক বছর শিক্ষানবিশ থাকবেন। এরপর একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করে স্থায়ী পদে যোগ দেবেন। সরাসরি কাউকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ। এর সত্যতা আছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ৩. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে তৈরি করতে হবে, যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে। ৪. উপাচার্য নিয়োগে সিনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করতে হবে। ৫. তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে পিএইচডি করার জন্য পাঠাতে হবে। এর জন্য ফান্ড তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নামে এই ফান্ড হতে পারে, সেখানে শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অনুদান দেবেন। ৬. পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরির বয়স পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হতে পারবে না। পদোন্নতির জন্য মৌলিক গ্রন্থ এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। এটা বর্তমানে নেই। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। ৭. সিনিয়র অধ্যাপকদের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। এতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপকৃত হবে। ৮. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত ১০ বছরে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ রয়েছে। নিজের মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাইয়ে দেওয়া (যে বোর্ডে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছেন), বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া সন্তানকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া—এ ধরনের ‘অভিযোগ’ রয়েছে। ইউজিসি শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ করা টাকা বিতরণ করবে—শুধু এ কাজ করাই তাদের মুখ্য কাজ হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দেখা, পর্যালোচনা করা, সুপারিশ করা ইত্যাদি তাদের কাজের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এসব ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান নয়। ফলে ইউজিসিকে নিয়ে ভাবতে হবে। ৯. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে (সচিব, অ্যাডিশনাল সচিব) সিনিয়র শিক্ষকদের প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একুশ শতকে এসে কতগুলো বিশেষ মন্ত্রণালয় (শিক্ষা, অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র) পরিচালনার ভার বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভারতে মোদি সরকার এ কাজ শুরু করেছে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে। একটি কমিশন গঠন করে সরকার এদের কাছে মতামত চাইতে পারে। ১০. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘বিদেশি শিক্ষক’ নিয়োগের সিদ্ধান্তটি অবিলম্বে কার্যকর করা উচিত। এতে আমাদের লাভ হবে দুটি—এক. গুণগত মান নিশ্চিত করা, দুই. আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হওয়া। ১১. তরুণ শিক্ষকদের (প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক) জন্য প্রশিক্ষণ জরুরি। এ জন্য একটি প্রশিক্ষণ একাডেমি তৈরি করা যেতে পারে। ১২. উচ্চশিক্ষার স্বার্থে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে প্রতিটি বিভাগে পুরনো কলেজগুলোকে এক কাঠামোর আওতায় এনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। বর্তমান কাঠামোয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি ‘সার্টিফিকেট বিতরণ’ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ক্লাস না করেও ডিগ্রি নেওয়া যায়—এর বড় উদাহরণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিবছরের মতো এবারও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। এ নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু শিক্ষার মান যদি নিশ্চিত না হয়, যদি একুশ শতক উপযোগী একটি তরুণ প্রজন্ম আমরা তৈরি করতে না পারি, তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যে কোনো দিনই পৌঁছতে পারব না। শিক্ষা খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ শিক্ষার গুণগত মানের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না
Daily Kalerkontho
17.06.2019
0 comments:
Post a Comment