শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১৩
জুন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নানা জরিপে দেখা যাচ্ছে ইংরেজি দূরে থাক
নিজভাষা বাংলাটাই আমাদের শিক্ষার্থীরা আয়ত্ত করতে পারছে না। তিনি আরও বলেন,
মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের কথা বলছি, তা আইনের চেষ্টা করছি। তবে এর আগে
শিক্ষার মানটা কী, তা কেমন, এসব আমাদের চিন্তা করে নিতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী
যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, ঠিক একই দিন বিকালে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর
পক্ষে উপস্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন প্রয়োজনে শিক্ষার
উন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা হবে। সংসদে তিনি প্রখাত জাপানি সম্রাট
সুইসুহিটোর (যার পরিচিত ছিল সম্রাট মেইজি বা মেইজি টেননো) উদাহরণ দেন।
সেইজি টেননো ১৮৬৭ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত জাপান শাসন করেন। তার শাসনামলে
তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে জাপানে ছাত্রের অভাব নেই। আছে উপযুক্ত
শিক্ষকের অভাব। তাই তিনি প্রযুক্তিনির্ভর অশিক্ষিত কয়েক হাজার শিক্ষককে
জাপানে নিয়ে আসেন। এভাবে জাপান জ্ঞানবিজ্ঞানে অগ্রসর হয়। প্রধানমন্ত্রী
কিংবা শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে দুটি দিক আছে। এক. আমাদের শিক্ষার্থীদের
জ্ঞানের অভাব রয়েছে। দক্ষ শিক্ষকের অভাবে তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা
যাচ্ছে না। দুই. বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটা জাপানের মেইজি সাম্রাজ্যের
শাসনামলের মতো। প্রচুর জনশক্তি আছে। কিন্তু তারা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নন। তাই
বিদেশি শিক্ষক অথবা প্রশিক্ষক দরকার।
প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বাস্তব সত্যটাই তুলে ধরেছেন। গত দশ বছর বর্তমান সরকারই ক্ষমতায়। এর আগে আমরা আরও একজন শিক্ষামন্ত্রীকে পেয়েছিলাম। কিন্তু গুণগত শিক্ষার মান আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। বরং জিপিএ-৫ নির্ভর একটা শিক্ষাব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি। এর মধ্য দিয়ে একটা তরুণ প্রজন্মকে আমরা ধ্বংস করেছি। এর ঢেউ গিয়ে লেগেছে উচ্চশিক্ষায়। উচ্চশিক্ষা এখন বেশি মাত্রায় বিসিএস-নির্ভর হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যিনি যে বিষয় নিয়েই পড়াশোনা করেন না কেন, তার টার্গেট হচ্ছে বিসিএস দেওয়া। তিনি যা শিখলেন, যা জানলেন, তা কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারছেন না। তিনি ‘দৌড়াচ্ছেন’ বিসিএসের জন্য। বাজারে বিসিএস গাইডে ভরা। তার পড়ার টেবিলে পাঠ্য বইয়ের পরিবর্তে স্থান পায় বিসিএস গাইড, যার অধিকাংশই আবার ভুলে ভরা। এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষার হাল আরও খারাপ। রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, যেখানে প্রধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক আনুগত্য। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ। টিআইবির রিপোর্টে তো উল্লেখ করা হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতি আমাদের কোন প্রকার কথা হলো না। শিক্ষায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারে। তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন বেশি। নিজ প্রতিষ্ঠানে তিনি যে বেতন পান, অন্য প্রতিষ্ঠানে সময় দিয়ে তিনি তার চেয়ে বেশি আয় করেন। সুতরাং আইন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে ‘চাকরি’ করা কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা যেকোনোভাবে (পার্টটাইম বা কনসালট্যান্ট) নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে কেউ শিক্ষকতা/ চাকরি করতে পারবেন না। আইনটা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগে নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। উপাচার্যের ইচ্ছায় বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। এই প্রবণতা বন্ধ করে ইউজিসির অধীনে পিএসসির মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর শুধু লিখিত পরীক্ষা না, বরং মৌখিক ও ডেমোর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এবং তিনি এক নম্বর শিক্ষানবিশ থাকবেন। এরপর একটি গবেষণা কর্ম সম্পাদন করে স্থায়ী পদে যোগ দেবেন। সরাসরি কাউকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ। এর সত্যতা আছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে তৈরি করতে হবে, যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে। একই সঙ্গে উপাচার্য নিয়োগে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করতে হবে। তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে পিএইচডি করার জন্য পাঠাতে হবে। এর জন্য ফান্ড তৈরি করতে হবে। প্রধনামন্ত্রীর নামে এই ফান্ড হতে পারে। যেখানে শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অনুদান দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরির বয়স পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হতে পারবে না। পদোন্নতির জন্য মৌলিক গ্রন্থ এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। এটা বর্তমানে নেই। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি পাওয়া যাবে না। ভিজিটিং স্বাক্ষর হিসেবে সিনিয়র প্রফেসরদের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। এতে করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপকৃত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও এক্সডিটেশন কাউন্সিল অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে যারা নিয়োগ পেয়েছে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। নিজের মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাইয়ে দেওয়া (যে বোর্ডে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছেন), বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া সন্তানের যোগ্যতা না থাকা সত্তে¡ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া, এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ইউজিসি শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণ করবে শুধু এই কাজটি করাই তাদের মুখ্য কাজ হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দেখা পর্যালোচনা করা, সুপারিশ করা ইত্যাদি তাদের ‘কাজের’ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, এসব ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাÐ দৃশ্যমান নয়। ফলে ইউজিসিকে নিয়ে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে (সচিব, এডিশনাল সচিব) সিনিয়র শিক্ষকদের পেষণে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একুশ শতকে এসে কতগুলো বিশেষ মন্ত্রণালয় (শিক্ষা, অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র) পরিচালনার ভার বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভারতে মোদি সরকার এই কাজটি শুরু করেছে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে। একটি কমিশন গঠন করে সরকার এদের কাছে মতামত চাইতে পারে। সরকার শিক্ষায় বাজেট বাড়িয়েছে। কিন্তু এই বাজেটের একটা বড় অংশই চলে যাবে বেতন ভাতায়। সুতরাং আলাদা একটি খাত সৃষ্টি করে সেখানে অর্থ বরাদ্দ করে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশি প্রশিক্ষক তথা শিক্ষক আনা যেতে পারে। মোদ্দা কথা, সনাতন শিক্ষার যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এসএসসি ও এইচএসসি লেভেলের পর তরুণ প্রজন্মকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে তাদের ৩-৪ বছরের জন্য টেকনিক্যাল কলেজগুলোতে পাঠিয়ে বিভিন্ন শাখায় দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ওইসব কলেজে প্রয়োজনে বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর উদ্যোগে তারা তাদের প্রশিক্ষকও পাঠাতে পারেন। এবং গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেওয়ার পর তাদের জন্য কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে পারেন তারা। শুধু বাজেটে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ ও শিক্ষিত করে তোলা যাবে না। এজন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সিদ্ধান্ত দ্রæত নেওয়া সম্ভব। এক. দ্রæত মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা। দুই. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি করা। তিন. প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যলয় নয়, বরং একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখান থেকে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট বের হবে। চার. সাধারণ শিক্ষার প্রসার না খাটিয়ে প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার খাটানো। নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, কৃষি তথা কৃষি প্রযুক্তির মতো বিষয় চালু করা। পাঁচ. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে প্রতি বিভাগে একটি করে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং ওই বিভাগের সব কলেজকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত করা। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা। ছয়. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য আলাদা একটি কমিশন করা, যার মর্যাদা হবে ইউজিসির মতো। একুশ শতকে এসে আমরা এখনও মানসম্মত শিক্ষার কথা বলছি। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার জন্য যা যা করা দরকার, তা আমরা করছি না। শিক্ষামন্ত্রীরা শুধু আশ্বাস দিয়ে যান। কিন্তু শুধু আশ্বাস দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না Daily Somoyer Alo 25.06.2019 |
শিক্ষামন্ত্রীর দুঃখবোধ, শিক্ষা বাজেট ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
17:58
No comments
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment