আমাদের শিক্ষার মানের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। এটা মাধ্যমিক স্তরের ক্ষেত্রে যেমনি প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি প্রযোজ্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও। মাধ্যমিক স্তরে একটা সংকট রয়েছে। দেশে জিপিএ ৫ এর একটি বড় ‘বিস্ফোরণ’ ঘটেছিল, যাতে এখন পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এই স্তরে ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি ও অংক ভীতি এখনো রয়ে গেছে। আমরা মাধ্যমিক স্তরে ভালো শিক্ষক তৈরি করতে পারিনি। সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠদানের চাইতে প্রাইভেট পড়াতে বেশি উৎসাহী। আর ছাত্রছাত্রীদের তারা বাধ্য করেছেন প্রাইভেট পড়তে। এই প্রবণতা আমরা বন্ধ করতে পারিনি। যদিও একাধিকবার প্রাইভেট পড়ানো বন্ধের কথা বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তা বাদ হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারতাম। শিক্ষকদের অতিরিক্ত বেতন দিয়ে প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করা যায়। ইংরেজি ভীতি আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না ভারতের কোন কোন অঞ্চল থেকে স্কুলপর্যায়ের শিক্ষকরা নিয়মিত ঢাকায় এসে অভিজাত এলাকায় কোচিং ক্লাস পরিচালনা করে থাকেন। ছাত্রছাত্রীরা এ থেকে তো উপকৃত হচ্ছে। এখন যদি আইনগতভাবে আমরা বিদেশ থেকে শিক্ষক আনি গোটা ভারতের বাইরে থেকেও হতে পারে, তাতে আমি ক্ষতির কিছু দেখি না। আমার দরকার দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। দরকার ভালো শিক্ষক। কিন্তু সেই শিক্ষক তো আমরা তৈরি করতে পারছি না।
আমাদের দেশে ভালো শিক্ষক আছেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু তাদের মানসিকতায় বড় পরিবর্তন এসেছে। শুধুমাত্র আর্থিক স্বার্থ বিবেচনায় ক্লাসে পাঠদানের পরিবর্তে তারা ঝুঁকছেন প্রাইভেট কোচিংয়ের দিকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। শুনলে অবাক হতে হয় কলেজে ভর্তি হলেও ছাত্রছাত্রীদের এখন কোচিং করতে হয়। কলেজ শিক্ষকরা কলেজের চাইতে বাসায় ব্যাচ করে পড়াতে আগ্রহী হন বেশি। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা, এমনকি বিজ্ঞানের বিষয়ে কলেজ পর্যায়ে প্রাইভেট পড়া এখন একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমরা এই প্রাইভেট পড়ানোও বন্ধ করতে পারিনি। এতে করে কোন প্রজন্ম আমরা তৈরি করছি, তা ভেবেও দেখিনি। বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এখানে শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ান না বটে, কিন্তু অনেক শিক্ষকেরই ‘কমিটমেন্ট’-এর অভাব রয়েছে। কয়েকটি বিভাগের শিক্ষকদের আবার প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় এবং টিভি চ্যানেলে চাহিদা বেশি। অনেকে আবার সেখানে ফুলটাইম চাকরিও করেন। ভিসি সাহেবরা জানেন। কিন্তু ‘রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা’ ওইসব শিক্ষকের এতবেশি যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তাও করা যায় না। তাই শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন অনেক।
শিক্ষায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারে। তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের নামে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানেও সময় দিচ্ছেন বেশি। নিজ প্রতিষ্ঠানে তিনি যে বেতন পান, অন্য প্রতিষ্ঠানে ‘সময় দিয়ে’ তিনি তার চেয়ে বেশি আয় করেন। সুতরাং আইন করে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে ‘চাকরি’ করা কিংবা বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা (যে কোনোভাবে, পার্টটাইম বা কনসালটেন্ট) নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে কেউ শিক্ষকতা/চাকরি করতে পারবেন না। আইনটা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগে নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। উপাচার্যের ইচ্ছায় বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবেÑ এই প্রবণতা বন্ধ করতে ইউজিসির অধীনে পিএসসির মডেলে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর শুধুমাত্র লিখিত পরীক্ষা না বরং মৌখিক ও ‘ডেমো’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং তিনি এক বছর শিক্ষানবিস থাকবেন। এরপর একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করে স্থায়ী পদে যোগ দেবেন। সরাসরি কাউকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ। এর সত্যতা আছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এদের নতুন করে বিশ^বিদ্যালয় আইন সংসদে তৈরি করতে হবে, যা ১৯৭৩ সালের বিশ^বিদ্যালয় আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে। একইসঙ্গে উপাচার্য নিয়োগে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করতে হবে। তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে পিএইচডি করার জন্য পাঠাতে হবে। এর জন্য ফান্ড তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এই ফান্ড হতে পারে, যেখানে শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অনুদান দেবেন। বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরির বয়স পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হতে পারবে না। পদোন্নতির জন্য মৌলিক গ্রন্থ এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। এটা বর্তমানে নেই। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি পাওয়া যাবে না। ভিজিটিং স্কলার হিসেবে সিনিয়র প্রফেসরদের অন্য পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। এতে করে নতুন বিশ^বিদ্যালয়গুলো উপকৃত হবে। বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও এক্সিডিটেশন কাউন্সিল অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। নিজের মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাইয়ে দেওয়া (যে বোর্ডে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছেন), বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া সন্তানের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় নিয়োগ দেওয়া, এ ধরনের ‘অভিযোগ’ রয়েছে। ইউজিসি শুধু পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণ করবেÑ শুধু এই কাজটি করাই তাদের মুখ্য কাজ হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দেখা, পর্যালোচনা করা, সুপারিশ করাÑ ইত্যাদি তাদের ‘কাজের’ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এসব ক্ষেত্রে তাদের কর্মকা- দৃশ্যমান নয়। ফলে ইউজিসিকে নিয়ে ভাবতে হবে।
একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে (সচিব, এডিশনাল সচিব) সিনিয়র শিক্ষকদের প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একুশ শতকে এসে কতগুলো বিশেষ মন্ত্রণালয় (শিক্ষা, অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র) পরিচালনার ভার শিক্ষকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভারতে মোদি সরকার এই কাজটি শুরু করেছে। পশ্চিমা ইউরোপের অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে। একটি কমিশন গঠন করে সরকার এদের কাছে মতামত চাইতে পারে। উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘ভিজিটিং স্কলার’-এর ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাধ্যমে বিশ^বিদ্যালয়গুলো সীমিত সময়ের জন্য অন্য দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকদের নিয়ে আসেন। তারা এক বছর বা তারও অধিক সময় ওই ক্যাম্পাসে থেকে ক্লাস নেন। গবেষণা করেন। এতে করে ছাত্ররা যেমনি উপকৃত হয়, ঠিক তেমনি তরুণ শিক্ষকরাও ওই শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসে তাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারেন। আমাদের দেশের তরুণ সমাজ একটি শক্তি। ওই তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষিত করে তাদের আমরা বিদেশে পাঠাতে পারি। আমরা সাধারণত অদক্ষ শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাই। এরা খুব একটা প্রশিক্ষিত নন। অদক্ষ। অথচ সুযোগ আছে এদের বিভিন্ন শাখায় প্রশক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। আইটি সেক্টরের একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশে নার্সিং (পুরুষ ও মহিলা) ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ইউরোপের প্রতিটি দেশে জনসখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে সেখানে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু দক্ষ ও কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে। সে ক্ষেত্রে সেখানে আইটি ও নার্সিং সেক্টরের একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা এটা পূরণ করতে পারি। ইতিমধ্যে জাপান এই সংকটে পড়েছে। তাদের শিল্প সেক্টর চালানোর মতো তরুণ প্রজন্ম জাপান পাচ্ছে না। ফলে জাপান জনশক্তি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য জনশক্তি আমদানির জন্য যে দেশগুলোর তালিকা জাপান করেছে, সেখানে বাংলাদেশের নাম নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি নেই। আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারিনি। আমরা প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ^বিদ্যালয় তৈরি করতে চাই। এটাও ভুল সিদ্ধান্ত। বিশ^বিদ্যালয় নয়, প্রয়োজন টেকনিক্যাল কলেজ। যেখানে আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারব। তাই প্রধানমন্ত্রী যে বিদেশি শিক্ষক নিয়ে আসার কথা বলেছেন, আমি তাকে স্বাগত জানাই। আগে চিহ্নিত করা হোক কোন কোন সেক্টরে আমরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক তথা শিক্ষক নিয়ে আসব। আইটি, নার্সিং-এর পাশাপাশি বিদেশি ভাষার শিক্ষকও আমাদের দরকার। জাপানি ভাষায় আমরা যদি তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তুলতে পারি, তাহলে জাপানে তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ঠিক তেমনি জাপানসহ অন্যান্য ভাষার শিক্ষকও দরকার।
সরকার শিক্ষায় বাজেট বাড়িয়েছে। কিন্তু এই বাজেটের একটা বড় অংশই চলে যাবে বেতন-ভাতায়। সুতরাং আলাদা একটি খাত সৃষ্টি করে সেখানে অর্থ বরাদ্দ করে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশি প্রশিক্ষক তথা শিক্ষক আনা যেতে পারে। মোদ্দা কথা সনাতন শিক্ষার যুগ শেষ হয়ে গেছে। এসএসসি ও এইচএসসি লেভেলের পর তরুণ প্রজন্মকে বিশ^বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে তাদের ৩-৪ বছরের জন্য টেকনিক্যাল কলেজগুলোতে পাঠিয়ে বিভিন্ন শাখায় দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ওইসব কলেজে প্রয়োজনে বিদেশি বহু রাষ্ট্রগুলো স্বউদ্যোগে তারা তাদের প্রশিক্ষকও পাঠাতে পারেন এবং গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নেওয়ার পর তাদের জন্য কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে পারেন তারা। শুধু বাজেটে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ ও শিক্ষিত করে তোলা যাবে না। এ জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।
Daily Desh Rupantor
17.06.2019
0 comments:
Post a Comment