২৩ অক্টোবর তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত এন্নাহদা পার্টির বিজয়ের মধ্য দিয়ে পুরো আরব বিশ্বে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জš§ হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ২৮ নভেম্বর মিসরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সংসদ নির্বাচন। ধারণা করা হচ্ছে, ওই নির্বাচনে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টিও বিজয়ী হবে। ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও দলটি একসময় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এখন তিউনেসিয়ায় এন্নাহদা পার্টির বিজয় প্রমাণ করল ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির চিন্তাধারা ব্যাপক বিস্তৃতি পাচ্ছে। কেননা এন্নাদাহ একসময় ব্রাদারহুড পার্টির রাজনীতি অনুসরণ করত। এখন অবশ্য এন্নাহদা তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। এই পার্টির নেতা ও তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান হচ্ছেন এন্নাহদা পার্টির নেতা রশিদ ঘান্নুচির আদর্শ। নির্বাচনে বিজয়ের পর ঘান্নুচি এ কথা স্বীকারও করেছেন।
একসময় ধারণা করা হয়েছিল, আরব বিশ্বে একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতনের পর সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ইসলামপন্থীদের উত্থান কি গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে? সমস্যা আছে ইসলামিক উগ্রপন্থীদের নিয়ে। উত্তর আফ্রিকার মাগরেবভুক্ত অঞ্চলে গঠিত হয়েছিল Al-Qaeda in the Islamic Maghreb (AQIM)। ২০০৭ সালে আলজেরিয়াতে এরা গঠন করেছিল Salafist Group for Preaching & Combat (GSPC)। AQIMআলজেরিয়াতে এখনও সক্রিয়। আর লিবিয়াতে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়াতে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়েও প্রশ্ন আছে। আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ফ্রিডম হাউস ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্র নিয়ে যে জরিপ চালিয়েছিল তাতে তিউনিসিয়ার অবস্থান ছিল ১৪৪, মিসরের ১৩৮ আর লিবিয়ার ১৫৮তম। লিবিয়ায় কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ৪১ বছর। এত দীর্ঘসময়ে ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস কারও নেই। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এত দীর্ঘসময়ে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। দেশটিতে গণতন্ত্র চর্চার কোন ইতিহাসও নেই। গাদ্দাফি নিজে সরকারিভাবে প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তার উপাধি ছিল বিপ্লবের নেতা। অথচ বিপ্লব হয়েছিল সেই ১৯৬৯ সালে। কোন সংবিধানও নেই। সংসদের আদলে ছিল ‘জেনারেল পিপলস কংগ্রেস’, যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণীত হতো। কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বও ছিল না সেখানে। রাজনৈতিক দল ব্যতিরেকে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে? আরব বিশ্বে এর বাইরে আলজেরিয়া ও ইয়েমেনের গণতন্ত্র সূচকে অবস্থান ১২৫ ও ১৪৬তম। বাহরাইনের অবস্থান ১২২তম। রাজতন্ত্র শাসিত দেশগুলোতেও গণতন্ত্রের সূচক আশাব্যঞ্জক নয়। এই যখন পরিস্থিতি তখন মরক্কো থেকে এসেছে একটি আশাব্যঞ্জক খবর। বাদশাহ মুহম্মদ-৬ সেখানে সংস্কারের কথা বলেছেন। জনগণের ভোটে তিনি সেখানে পরিবর্তন এনেছেন। তরুণ এই রাজা ক্ষমতায় আছেন ১৯৯৯ সাল থেকে। তুলনামূলক বিচারে অন্য আরব দেশগুলোর চেয়ে মরক্কোর অবস্থা অনেক ভালো। গণতন্ত্র ইনডেক্সে ১৬৭টি দেশের মাঝে মরক্কোর অবস্থান ১১৬তম। আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ১৯৬টি দেশের মাঝে দেশটির অবস্থান ১৪৬তম। এখন গণভোটে সংবিধানে কিছু পরিবর্তনের পক্ষে রায় হয়েছে এবং আগামীতে যদি সেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে আরব বিশ্বের রাজনীতির জন্য তা হবে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সম্ভবত বাদশাহ মুহাম্মদ পরিস্থিত বুঝতে পেরেছেন। তাই আগেভাগেই তিনি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন দেখতে হবে তিনি কতটুকু আন্তরিক। তবে একটা ভালো দিক হচ্ছে, মরক্কোতে বড় ধরনের কোন গণঅভ্যুত্থানের এখনও সৃষ্টি হয়নি। মিসর কিংবা সিরিয়ার মত পরিস্থিতি সেখানে এখনও সৃষ্টি হয়নি। তার আগেই বাদশাহ মুহাম্মদ-৬ সংস্কারের উদ্যোগ নিলেন। তিনি নিজের কিছু ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন এরই মধ্যে।
আরব বসন্তকে সামনে রেখে এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। এক. লিবিয়া ইরাকের মতো পরিস্থিতি বরণ করবে কিনা? অর্থাৎ ইরাকের মতো আÍঘাতী বোমাবাজির সংস্কৃতির জন্ম হবে কিনা? ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী অবতরণ করেছিল এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এখন লিবিয়ার পরিস্থিতি পুরোপুরি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে তা বলা যাবে না। সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বোমাবর্ষণের পর মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাত করা সম্ভব হয়েছে। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ৪১ বছর। এই দীর্ঘ ৪১ বছর তিনি লিবিয়ায় নতুন ধরনের এক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিলেন।
ইসলামিক কট্টরপন্থীদের উত্থান নিয়ে শংকা আছে। দুটো সংগঠনের কথা জানা যায়, যাদের দিকে নজর থাকবে অনেকের। এ দুটো সংগঠন হচ্ছে Al-Jamma al Muqatilah bi Libya এবং Libya Islamic Fighting Group (LIFG)|। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে ক’টি সংগঠনকে আল কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে চিহ্নিত করেছিল, তার মাঝে LIFG-র নামও ছিল। এদিকে দ্রুত অবনতি ঘটছে সিরিয়া পরিস্থিতির। প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ ক্ষমতায় আছেন ২০০০ সাল থেকে। তার ছোট ভাই সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের কমান্ডার। লিবিয়ার পর সেখানেও পরিবর্তন আসন্ন। ইসলামপন্থীরাও সেখানে শক্তিশালী। সিরিয়ায় তুরস্কের একটা প্রভাব থাকবে। তিউনিসিয়ার প্রভাব সিরিয়ায় পড়তে পারে। ‘আরব বসন্তে’র পর তিউনেসিয়া ও মিসরে ইসলামিক (মডারেট) শক্তিগুলো নতুন উদ্যোমে আত্মপ্রকাশ করেছে। মিসরে দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ছিল ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি। তারা এখন ইসলামিক ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, তারা পুরনো দল ডধভফ পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করেছে। ২৮ তারিখ সেখানে সংসদ নির্বাচন। ধারণা করা হচ্ছে এই ঐক্যজোট নির্বাচনে ভালো করবে। এরই মধ্যে সংবিধান প্রণয়নেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নতুন সংবিধানে সেনাবাহিনী তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চায়। বর্তমান যে সামরিক জান্তা ক্ষমতা পরিচালনা করছে, তারা চাচ্ছে নয়া সংবিধানে সেনাবাহিনীর একটা প্রতিনিধিত্ব থাকুক। শেষ পর্যন্ত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি এই চাপ উপেক্ষা করতে পারবে কিনা, এটা দেখার বিষয়।
আরব বিশ্বের তরুণ সমাজ এই বিপ্লবকে সম্মান করেছে। কিন্তু নতুন যে সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, তাতে তাদের কোন স্বীকৃতি বা ভূমিকা নেই। ফলে এদের আশা ভঙ্গ হয়েছে এবং এটা তাদের যদি আবার রাজপথে আন্দোলনে নিয়ে আসে, আমি অবাক হব না। এই তরুণ সমাজ আরব বিশ্বে একটি শক্তি। আলজেরিয়ায় মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪৬ ভাগ হচ্ছে তরুণ, তিউনেসিয়ায় ২৭ ভাগ, লিবিয়ায় ৪০ ভাগ, মিসরে ২৬ ভাগ, সিরিয়ায় ২০ ভাগ, জর্ডানে ৩৯ ভাগ, বাহরাইনে ২৫ ভাগ আর মরক্কোতে ১৬ ভাগ। এই শক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। আরব বিশ্বে গোষ্ঠীতন্ত্র একটি ফ্যাক্টর। দেখা গেছে, নিজস্ব গোষ্ঠী তথা গোত্রের লোকদের নিয়েই ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। গাদ্দাফির পেছনে ছিল তার গোত্রের লোকেরা। সিরিয়ায় আলাবি গোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট বাসারের ক্ষমতার অন্যতম উৎস। তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত বেনআলি তার পরিবার ও গোত্রের লোকদের নিয়ে একটা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করেছিলেন। বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সুন্নি সম্প্রদায় সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। বাহরাইনের শাসক হামাদ বিন ইশা আল খলিফার (১৯৯৯ সাল থেকে ক্ষমতায়) বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা দমন করতে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের উদ্যোগে সৌদি সেনাবাহিনী বাহরাইনে প্রবেশ করেছিল এবং আন্দোলন নস্যাৎ করে দিয়েছিল। এটা একটা নতুন উপাদান। ইয়েমেনেও এই কাউন্সিল উদ্যোগ নিচ্ছে। এখানেও উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল সেনাবাহিনী পাঠাতে পারে। স্পষ্টতই আরব বিশ্ব একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করে সেখানে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ১৯ মে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিলেও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যে শক্তিশালী হয়েছে তা বলা যাবে না। লিবিয়ায় দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থন, ইয়েমেনে আল কায়দা গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর জিনজিবার দখল প্রমাণ করে এ অঞ্চলে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে পরিবর্তন আসছে। খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে আরব বিশ্বের সমাজ। ক্ষমতাসীনরাও কিছু ছাড় দিচ্ছেন। নতুন সংবিধান, নয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নতুন নতুন শক্তির উদ্ভব ঘটছে। এরাই আগামী দিনের আরব বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে।
এই নতুন শক্তি ট্রেডিশনাল শক্তি নয়। ‘আরব বসন্তে’র জন্ম দিয়েছিল তরুণ নেতৃত্ব। এদের অনেককেই ‘প্রমোট’ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যেমন বলা যেতে পারে মিসরের এপ্রিল ৬ মুভমেন্টের কথা। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসছে। এদের মাঝে হতাশাও এসে গেছে। মিসরে অতি সাম্প্রতিককালে আবারও তাহরির স্কোয়ারে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করেছিল মানুষ। কিন্তু তারা সফল হয়নি। এদের কোন রাজনৈতিক সংগঠন নেই। এরা ‘বিপ্লব’কে সংগঠিত করেছে সত্য কিন্তু ক্ষমতায় যেতে পারেনি। পারেনি তিউনিসিয়াতেও। এমনকি ইয়েমেনে তরুণ সমাজ আন্দোলনকে সংগঠিত করলেও সরকারের পতন ঘটেনি। তিউনেসিয়ার ঘটনাবলী দিয়ে প্রমাণিত হল সমগ্র আরব বিশ্বে একটি ইসলামিক শক্তির উত্থান ঘটছে। এটা ৬০ বছরের আরব বিশ্বের রাজনীতির চতুর্থ ধারা। ১৯৫২ সালে মিসরে জামাল আবদুল নাসের ক্ষমতা গ্রহণ করে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূচনা করে প্রথম ধারার সূচনা করেছিলেন। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৭ সালে আরব বিশ্বে যুদ্ধ (ইসরাইলের সঙ্গে) ও ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লব দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারার সূচনা করেছিল। আর ২০১০ সালে তিউনেসিয়ায় জেসমিন বিপ্লব চতুর্থ ধারার সূচনা করল। এই চতুর্থ ধারা আরব বিশ্বে কী ধরনের পরিবর্তন আনে, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
দৈনিক যুগান্তর, ১০ নভেম্বর ২০১১
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com
একসময় ধারণা করা হয়েছিল, আরব বিশ্বে একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতনের পর সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ইসলামপন্থীদের উত্থান কি গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে? সমস্যা আছে ইসলামিক উগ্রপন্থীদের নিয়ে। উত্তর আফ্রিকার মাগরেবভুক্ত অঞ্চলে গঠিত হয়েছিল Al-Qaeda in the Islamic Maghreb (AQIM)। ২০০৭ সালে আলজেরিয়াতে এরা গঠন করেছিল Salafist Group for Preaching & Combat (GSPC)। AQIMআলজেরিয়াতে এখনও সক্রিয়। আর লিবিয়াতে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়াতে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়েও প্রশ্ন আছে। আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ফ্রিডম হাউস ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্র নিয়ে যে জরিপ চালিয়েছিল তাতে তিউনিসিয়ার অবস্থান ছিল ১৪৪, মিসরের ১৩৮ আর লিবিয়ার ১৫৮তম। লিবিয়ায় কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ৪১ বছর। এত দীর্ঘসময়ে ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস কারও নেই। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এত দীর্ঘসময়ে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। দেশটিতে গণতন্ত্র চর্চার কোন ইতিহাসও নেই। গাদ্দাফি নিজে সরকারিভাবে প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তার উপাধি ছিল বিপ্লবের নেতা। অথচ বিপ্লব হয়েছিল সেই ১৯৬৯ সালে। কোন সংবিধানও নেই। সংসদের আদলে ছিল ‘জেনারেল পিপলস কংগ্রেস’, যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণীত হতো। কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বও ছিল না সেখানে। রাজনৈতিক দল ব্যতিরেকে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে? আরব বিশ্বে এর বাইরে আলজেরিয়া ও ইয়েমেনের গণতন্ত্র সূচকে অবস্থান ১২৫ ও ১৪৬তম। বাহরাইনের অবস্থান ১২২তম। রাজতন্ত্র শাসিত দেশগুলোতেও গণতন্ত্রের সূচক আশাব্যঞ্জক নয়। এই যখন পরিস্থিতি তখন মরক্কো থেকে এসেছে একটি আশাব্যঞ্জক খবর। বাদশাহ মুহম্মদ-৬ সেখানে সংস্কারের কথা বলেছেন। জনগণের ভোটে তিনি সেখানে পরিবর্তন এনেছেন। তরুণ এই রাজা ক্ষমতায় আছেন ১৯৯৯ সাল থেকে। তুলনামূলক বিচারে অন্য আরব দেশগুলোর চেয়ে মরক্কোর অবস্থা অনেক ভালো। গণতন্ত্র ইনডেক্সে ১৬৭টি দেশের মাঝে মরক্কোর অবস্থান ১১৬তম। আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ১৯৬টি দেশের মাঝে দেশটির অবস্থান ১৪৬তম। এখন গণভোটে সংবিধানে কিছু পরিবর্তনের পক্ষে রায় হয়েছে এবং আগামীতে যদি সেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে আরব বিশ্বের রাজনীতির জন্য তা হবে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সম্ভবত বাদশাহ মুহাম্মদ পরিস্থিত বুঝতে পেরেছেন। তাই আগেভাগেই তিনি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন দেখতে হবে তিনি কতটুকু আন্তরিক। তবে একটা ভালো দিক হচ্ছে, মরক্কোতে বড় ধরনের কোন গণঅভ্যুত্থানের এখনও সৃষ্টি হয়নি। মিসর কিংবা সিরিয়ার মত পরিস্থিতি সেখানে এখনও সৃষ্টি হয়নি। তার আগেই বাদশাহ মুহাম্মদ-৬ সংস্কারের উদ্যোগ নিলেন। তিনি নিজের কিছু ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন এরই মধ্যে।
আরব বসন্তকে সামনে রেখে এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। এক. লিবিয়া ইরাকের মতো পরিস্থিতি বরণ করবে কিনা? অর্থাৎ ইরাকের মতো আÍঘাতী বোমাবাজির সংস্কৃতির জন্ম হবে কিনা? ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী অবতরণ করেছিল এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এখন লিবিয়ার পরিস্থিতি পুরোপুরি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে তা বলা যাবে না। সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বোমাবর্ষণের পর মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাত করা সম্ভব হয়েছে। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ৪১ বছর। এই দীর্ঘ ৪১ বছর তিনি লিবিয়ায় নতুন ধরনের এক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিলেন।
ইসলামিক কট্টরপন্থীদের উত্থান নিয়ে শংকা আছে। দুটো সংগঠনের কথা জানা যায়, যাদের দিকে নজর থাকবে অনেকের। এ দুটো সংগঠন হচ্ছে Al-Jamma al Muqatilah bi Libya এবং Libya Islamic Fighting Group (LIFG)|। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে ক’টি সংগঠনকে আল কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে চিহ্নিত করেছিল, তার মাঝে LIFG-র নামও ছিল। এদিকে দ্রুত অবনতি ঘটছে সিরিয়া পরিস্থিতির। প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ ক্ষমতায় আছেন ২০০০ সাল থেকে। তার ছোট ভাই সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের কমান্ডার। লিবিয়ার পর সেখানেও পরিবর্তন আসন্ন। ইসলামপন্থীরাও সেখানে শক্তিশালী। সিরিয়ায় তুরস্কের একটা প্রভাব থাকবে। তিউনিসিয়ার প্রভাব সিরিয়ায় পড়তে পারে। ‘আরব বসন্তে’র পর তিউনেসিয়া ও মিসরে ইসলামিক (মডারেট) শক্তিগুলো নতুন উদ্যোমে আত্মপ্রকাশ করেছে। মিসরে দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ছিল ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি। তারা এখন ইসলামিক ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, তারা পুরনো দল ডধভফ পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করেছে। ২৮ তারিখ সেখানে সংসদ নির্বাচন। ধারণা করা হচ্ছে এই ঐক্যজোট নির্বাচনে ভালো করবে। এরই মধ্যে সংবিধান প্রণয়নেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নতুন সংবিধানে সেনাবাহিনী তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চায়। বর্তমান যে সামরিক জান্তা ক্ষমতা পরিচালনা করছে, তারা চাচ্ছে নয়া সংবিধানে সেনাবাহিনীর একটা প্রতিনিধিত্ব থাকুক। শেষ পর্যন্ত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি এই চাপ উপেক্ষা করতে পারবে কিনা, এটা দেখার বিষয়।
আরব বিশ্বের তরুণ সমাজ এই বিপ্লবকে সম্মান করেছে। কিন্তু নতুন যে সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, তাতে তাদের কোন স্বীকৃতি বা ভূমিকা নেই। ফলে এদের আশা ভঙ্গ হয়েছে এবং এটা তাদের যদি আবার রাজপথে আন্দোলনে নিয়ে আসে, আমি অবাক হব না। এই তরুণ সমাজ আরব বিশ্বে একটি শক্তি। আলজেরিয়ায় মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪৬ ভাগ হচ্ছে তরুণ, তিউনেসিয়ায় ২৭ ভাগ, লিবিয়ায় ৪০ ভাগ, মিসরে ২৬ ভাগ, সিরিয়ায় ২০ ভাগ, জর্ডানে ৩৯ ভাগ, বাহরাইনে ২৫ ভাগ আর মরক্কোতে ১৬ ভাগ। এই শক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। আরব বিশ্বে গোষ্ঠীতন্ত্র একটি ফ্যাক্টর। দেখা গেছে, নিজস্ব গোষ্ঠী তথা গোত্রের লোকদের নিয়েই ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। গাদ্দাফির পেছনে ছিল তার গোত্রের লোকেরা। সিরিয়ায় আলাবি গোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট বাসারের ক্ষমতার অন্যতম উৎস। তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত বেনআলি তার পরিবার ও গোত্রের লোকদের নিয়ে একটা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করেছিলেন। বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সুন্নি সম্প্রদায় সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। বাহরাইনের শাসক হামাদ বিন ইশা আল খলিফার (১৯৯৯ সাল থেকে ক্ষমতায়) বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা দমন করতে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের উদ্যোগে সৌদি সেনাবাহিনী বাহরাইনে প্রবেশ করেছিল এবং আন্দোলন নস্যাৎ করে দিয়েছিল। এটা একটা নতুন উপাদান। ইয়েমেনেও এই কাউন্সিল উদ্যোগ নিচ্ছে। এখানেও উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল সেনাবাহিনী পাঠাতে পারে। স্পষ্টতই আরব বিশ্ব একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করে সেখানে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ১৯ মে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিলেও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যে শক্তিশালী হয়েছে তা বলা যাবে না। লিবিয়ায় দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থন, ইয়েমেনে আল কায়দা গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর জিনজিবার দখল প্রমাণ করে এ অঞ্চলে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে পরিবর্তন আসছে। খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে আরব বিশ্বের সমাজ। ক্ষমতাসীনরাও কিছু ছাড় দিচ্ছেন। নতুন সংবিধান, নয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নতুন নতুন শক্তির উদ্ভব ঘটছে। এরাই আগামী দিনের আরব বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে।
এই নতুন শক্তি ট্রেডিশনাল শক্তি নয়। ‘আরব বসন্তে’র জন্ম দিয়েছিল তরুণ নেতৃত্ব। এদের অনেককেই ‘প্রমোট’ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যেমন বলা যেতে পারে মিসরের এপ্রিল ৬ মুভমেন্টের কথা। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসছে। এদের মাঝে হতাশাও এসে গেছে। মিসরে অতি সাম্প্রতিককালে আবারও তাহরির স্কোয়ারে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করেছিল মানুষ। কিন্তু তারা সফল হয়নি। এদের কোন রাজনৈতিক সংগঠন নেই। এরা ‘বিপ্লব’কে সংগঠিত করেছে সত্য কিন্তু ক্ষমতায় যেতে পারেনি। পারেনি তিউনিসিয়াতেও। এমনকি ইয়েমেনে তরুণ সমাজ আন্দোলনকে সংগঠিত করলেও সরকারের পতন ঘটেনি। তিউনেসিয়ার ঘটনাবলী দিয়ে প্রমাণিত হল সমগ্র আরব বিশ্বে একটি ইসলামিক শক্তির উত্থান ঘটছে। এটা ৬০ বছরের আরব বিশ্বের রাজনীতির চতুর্থ ধারা। ১৯৫২ সালে মিসরে জামাল আবদুল নাসের ক্ষমতা গ্রহণ করে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূচনা করে প্রথম ধারার সূচনা করেছিলেন। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৭ সালে আরব বিশ্বে যুদ্ধ (ইসরাইলের সঙ্গে) ও ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লব দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারার সূচনা করেছিল। আর ২০১০ সালে তিউনেসিয়ায় জেসমিন বিপ্লব চতুর্থ ধারার সূচনা করল। এই চতুর্থ ধারা আরব বিশ্বে কী ধরনের পরিবর্তন আনে, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
দৈনিক যুগান্তর, ১০ নভেম্বর ২০১১
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment