গত ১১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন যখন ৫৩ দিন পার করে, তখন সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে এই আন্দোলনের শেষ পরিণতি কী? যারা ইন্টারনেটে এ আন্দোলন সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ওয়াল স্ট্রিটের পাশে জুকোট্টি পার্কে শত শত মানুষ দীর্ঘ ৫৩ দিন যাবত দিন-রাত অবস্থান করে এক ধরনের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন- এই বিক্ষোভ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। এই প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যে অসমতা ও বৈষম্য রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে, যেখানে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে। যারা আজ জুকোট্টি পার্কে জমায়েত হয়েছেন, তারা সমাজের সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী, যারা বলছেন, ‘We are the 99 percent’, অর্থাত্ আমরাই ৯৯ ভাগ। এই আন্দোলন আজ শুধু নিউইয়র্কেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ছড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে। ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছে October 2011 Movement, যারা ওই স্থান দখল করে আন্দোলন করে আসছেন গত ৩৬ দিন ধরে। তারা আন্দোলন করে আসছেন যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ যুদ্ধের পেছনে ব্যয় করে (তিন দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলার), তার প্রতিবাদে। তাদের দাবি, যুদ্ধের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়, তা কমিয়ে সামাজিক খাতে (স্বাস্থ্য ও শিক্ষা) ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। সর্বশেষ ঘটনায় বিক্ষোভকারীরা ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড পোর্টও দখল করে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র জুড়েই চলছে এই আন্দোলন। এই আন্দোলন চলছে এমন একটি সময় যখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যাংক সেখানে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার নয় দশমিক এক শতাংশ। দেশটির প্রবৃদ্ধির অবস্থাও উদ্বেগজনক। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে (জানুয়ারি থেকে জুন) গড় প্রবৃদ্ধি এক শতাংশেরও কম। ঋণমানকারী সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরসের ক্রেডিট রেটিংয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঋণমান সূচক ট্রিপল-এ থেকে এক ধাপ নামিয়ে ডবল-এ প্লাসে কমানো হয়েছে। এতে দেশটির সরকার, সেখানকার বিভিন্ন কোম্পানি ও ভোক্তাদের ঋণ গ্রহণের খরচ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব পরিস্থিতির জের ধরে দেশটি নতুন করে মন্দায় পতিত হতে পারে।
এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না। এই পরিস্থিতির রেশ ধরেই জন্ম হয়েছে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। নোয়াম চমস্কি এই ধরনের আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চিহ্নিত করেছেন Plutonomy হিসেবে। অর্থাত্ সম্পদের কারণে একটি ধনিক শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এরা সমাজের মাত্র এক ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, বাকি ৯৯ ভাগ Precariat, অর্থাত্ অনিশ্চিতভাবে জীবনযাপনকারী একটি শ্রেণী। এই দুই শ্রেণীর মাঝে দ্বন্দ্ব এখন অনিবার্য।
পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতির দেশে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের পেছনে (ইরাক ও আফগানিস্তান) তিন দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে (প্রতি মাসে নয় দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার), সেখানে জনগোষ্ঠীর নয় দশমিক এক ভাগের কোনো চাকরি নেই। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র এক ভাগ মানুষ। ক্ষোভটা তাই ওয়াল স্ট্রিটকে ঘিরেই। ওয়াল স্ট্রিটকে ধরা হয় পুঁজিবাদের একটা সিম্বল হিসেবে। প্রধান প্রধান করপোরেট হাউসগুলোর অফিস সেখানে। স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনও এখানে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনিক শ্রেণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আয়ের আট থেকে নয় ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভোগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক পাঁচ ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক এমানুয়েল সাজ (Emanuel Saez) তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন কীভাবে আমেরিকান সমাজে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। তার মতে ১০ ভাগ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের মোট বেতনের ৪৯ দশমিক সাত ভাগ গ্রহণ করে। ডেভিড গ্র (David Graw) তার এক প্রবন্ধে (The Richest 1%, Have Captured America’s Wealth, Alternet) উল্লেখ করেছেন আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ এক দশমিক পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। অর্থাত্ ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর সম্পদের চেয়েও বেশি। তার মতে শীর্ষে থাকা এক ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। যদিও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিস (Joseph Stiglitz) মনে করেন, শীর্ষে থাকা ওই এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করত মাত্র ১২ ভাগ সম্পদ (By the 1%, for the 1%, Vanity fare)। অপর এক গবেষক রবার্ট রাইচ (Robert Reich)-এর মতে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ বেতনভোগী মানুষের মাঝে পাঁচ ভাগ ৩৭ ভাগ ভোগ্যপণ্যের ক্রেতা। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় যুক্তরাষ্ট্রে একটি শ্রেণী ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে, আর অপর শ্রেণী গরিব থেকে আরও গরিব হচ্ছে, যাদের ক্রয়ক্ষমতা কম, সম্পদের পরিমাণও কম। যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে Casino Capitalism। অর্থাত্ ক্যাসিনো নির্ভর একটি অর্থনীতি, যেখানে এক রাতে জুয়া খেলায় লাখ ডলার হেরে যান অনেক আমেরিকান। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ধনীরা ব্যক্তিগত প্লেন নিয়ে আটলান্টায় যান। ক্যাসিনোগুলোর নিজস্ব ফাইভ স্টার হোটেল আছে, সেখানে থাকেন। সারা রাত জুয়া খেলে রোববার যার যার শহরে চলে যান। ওখানে একদিকে ক্যাসিনোগুলোর জৌলুস, অন্যদিকে ক্যাসিনোগুলোর কিছুটা দূরে জরাজীর্ণ পুরনো বাড়ি, সেখানে বাস করে ব্ল্যাক আমেরিকানরা, যাদের অনেকেরই চাকরি নেই। স্বাস্থ্যসেবাও তারা পান না। কী বৈসাদৃশ্য! একই দেশের নাগরিক। একজন যেখানে এক রাতে জুয়া খেলে হেরে যান কয়েক হাজার ডলার, অন্যজন সারা মাসেও যার রোজগার নেই মাত্র এক হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের এই সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থায় ‘সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির’ ধারণা সেখানে গরিবদের, বেকারদের ন্যূনতম অধিকার (স্বাস্থ্য, শিক্ষা) নিশ্চিত করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এই অধিকার নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্র সব নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। আমি যুক্তরাষ্ট্রে গৃহহীন মানুষ দেখেছি। ভিক্ষা করে এমন লোকও আমি সাবওয়েতে দেখেছি। গায়িকা ম্যাডোনার ভাইও গৃহহীনদের একজন-এ খবরও ছাপা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেখানে ১৬ দশমিক চার মিলিয়ন, অর্থাত্ এক কোটি ৬৪ লাখ শিশু রয়েছে অত্যন্ত গরিব। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার দরিদ্র পরিবারের যে সীমা নির্ধারণ করেছে (অর্থাত্ ২২ হাজার ৫০ ডলার বছরে), সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ২১ ভাগ শিশু সন্তান (প্রতি পাঁচ জনে একজন) ওই সব পরিবারে বসবাস করে। জীবনের কোনো এক সময় ৯০ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ শিশু ‘ফুড স্টাম্প’ (বিনে পয়সায় খাদ্য) এর ওপর নির্ভরশীল ছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য পাস করা একজন গ্র্যাজুয়েট কোনো চাকরির সংস্থান করতে পারছে না, সেখানে ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। জুকোট্টি পার্কে যারা অবস্থান নিয়ে দিনের পর দিন অবস্থান করে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন, তাদের অনেকেরই চাকরি নেই। অথচ সরকারি হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যুদ্ধের জন্য ব্যয় করেছে তিন দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে অনেকের চাকরির সংস্থান করা যেত। শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানো যেত, বাড়ানো যেত ‘সামাজিক নেট’-এর পরিধি (ফুড স্ট্যাম্প, হাউজিং ইত্যাদি)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা করেনি। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ সেখানে যখন কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারেনি, তখন লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ‘তৃতীয় যুদ্ধ’-এর সূচনা করেছিল। গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে বটে, কিন্তু লিবিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী একটি অস্থিতিশীলতার জন্ম হল। লিবিয়ায় ‘আরেকটি আফগানিস্তান’ কিংবা ‘আরেকটি সোমালিয়া’ জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে জড়িয়ে গেছে। এখন জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় সেখানে যুদ্ধের খরচ মেটাতে হচ্ছে।
এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্যের কারণেই সেখানে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’-এর মতো আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। যদিও পুঁজিবাদী সমাজে এই বৈষম্য নতুন কিছু নয়। পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিই হল আসল কথা। এই পুঁজি একটি নতুন অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে_Plutonomy| এই সম্পদশালী ধনিক শ্রেণী এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখানে সাধারণ মানুষের কথা বলার কেউ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে যারা নির্বাচিত হন, তারা এই Plutonomy-রই প্রতিনিধি। এদের আর্থিক সহায়তায় এরা নির্বাচিত হন। তাই নির্বাচিত হওয়ার পর তারা এই সম্পদশালী ধনিক শ্রেণীরই স্বার্থ রক্ষা করেন। নোয়াম চমস্কি লিখেছেন, ‘The world is divided into two blocks-the plutonomy and the rest’। যুক্তরাষ্ট্র এই Plutonomy অর্থনীতিরই প্রতিনিধিত্ব করে। কার্ল মার্কস শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন শ্রেণীদ্বন্দ্বের কারণে বিপ্লব অনিবার্য। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে শ্রেণীদ্বন্দ্বের একটি রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। একটি সামাজিক বিপ্লব সেখানে আসন্ন।
দৈনিক সকালের খবর ১৪ নভেম্বর ২০১১,
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment