জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন তার বাংলাদেশ সফরের সময় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সংলাপই হচ্ছে গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর পথ। সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথাও জানিয়েছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে কি থাকবে না, বিষয়টি নির্ভর করছে বাংলাদেশের জনগণের ওপর। তবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বান কি মুন এই মন্তব্যটি করলেন এমন একটি সময় যখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দুটো রোডমার্চের পর তৃতীয় আরেকটি রোডমার্চ করতে যাচ্ছে আগামী ২৬ ও ২৭ নভেম্বর। সরকারের পতন, মধ্যবর্তী নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতেই বিএনপির এই রোডমার্চ। যদিও এককভাবে বিএনপি এই রোডমার্চে অংশ নিচ্ছে না। চারদলীয় জোটের বাইরে আরো কিছু ছোট ছোট দল এই রোডমার্চে অংশ নিচ্ছে।
সরকার ও বিরোধী দল যখন পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে একটি 'অবস্থান' নিয়েছে, তখন একটি রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে বান কি মুনের মতো ব্যক্তিত্ব এই আহ্বান জানালেন। এর গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। এই আহ্বান গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি কারণে। আর তা হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ইতোমধ্যেই আক্রান্ত। গ্রিস ও ইতালিতে সরকারের পতন হয়েছে। আর অকুপাই ম্যুভমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের এক শহর থেকে অন্য শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের অবস্থাও ভালো নয়। গত ৩ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই ঘাটতির পরিমাণ ১৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে। ১ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ১৬ হাজার ৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮৪ শতাংশ। আর দৈনিক হিসেবে সরকারের ব্যাংক ঋণের গড় ১৩৩ কোটি টাকা। নতুন নোট ছেপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না।
সরকার ইতোমধ্যে তাদের ৩৪ মাসের শাসনকাল পার করেছে। এ ক্ষেত্রে খুব সঙ্গত কারণেই সরকারের 'পারফরমেন্স' বিচার করা যায়। গত ৩৪ মাসে একাধিক সেক্টরে সরকারের ব্যর্থতা প্রকট। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম আরো এক দফা বাড়িয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে সিএনজি এবং বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে। সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। কারণ দাতারা তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার কারণে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। খোদ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দুর্নীতির প্রশ্ন তুলেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগ করেছে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক। অথচ যোগাযোগমন্ত্রী এখনো তার পদে বহাল আছেন। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হলে মন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। শেয়ারবাজার নিয়ে 'জুয়াখেলা' এখনো বন্ধ হয়নি। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অনশন পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু তাতে সরকারের এতটুকু টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। মূল্যস্ফীতি এখন সর্বকালের শীর্ষে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে গেছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতায় সাধারণ মানুষের এখন নাভিশ্বাস। তারা চায় একটি পরিবর্তন। তাই সাধারণ মানুষ যে বেগম জিয়ার প্রতি সমর্থন ছুড়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই আস্থা ও বিশ্বাস নেই। সরকারি দল বিরোধী দলকে 'শত্রু' মনে করে। প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাটের পাটগ্রামের সমাবেশে বলেছেন, 'জোট সরকারের মন্ত্রীর দুর্নীতিতে পদ্মা সেতুর ঋণ স্থগিত হয়েছে' (সকালের খবর, ২০ অক্টোবর)। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা রীতিমত এক প্রশ্ন। কেননা বর্তমান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির প্রশ্নই তুলেছিল বিশ্বব্যাংক। আর জোট সরকার ক্ষমতা ছেড়েছে ৫ বছর আগে। পাঁচ বছর আগের দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক তোলেনি।
আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সরকারকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার কাজটি করে বিরোধী দল। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলকে আদৌ গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া হয়নি। 'ব্রুট মেজরিটির' জোরে সরকার প্রতিটি সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে সংসদে ও সংসদের বাইরে 'চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স'-এর অভাবেই রাষ্ট্র একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে এই 'চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স'-এর অভাবটি অত্যন্ত প্রবল। সরকার এককভাবে যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্তের চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। সরকার বিরোধী দলের মতামত গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে সংসদকে কার্যকর না করা। পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে সংসদ বয়কটের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, বিশ বছর পরও সেই সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল পঞ্চম সংসদে ১১৮ দিন (৯টি অধিবেশনে), ৭ম সংসদে ১৬৫ দিন (৯টি অধিবেশনে), ৮ম সংসদে ২২৩ দিন (৯টি অধিবেশনে) সংসদ বয়কট করে। ৯ম সংসদের সংসদ বয়কটের হিসাব-নিকাশ আমরা আরো পরে পাব। তবে সংসদ বয়কট তো অব্যাহত রয়েছে। উপরে উল্লেখিত তিনটি সংসদেই মারাত্মক কোরাম সঙ্কট পরিলক্ষিত হয়। ৭ম সংসদের ৯ম অধিবেশনে মোট ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট কোরাম সঙ্কটের কারণে ব্যয় হয়। ৮ম সংসদে ২২৭ ঘণ্টা অপচয় হয় কোরাম সঙ্কটে যা সংসদের মোট কার্যকালের একপঞ্চমাংশ। এর জন্য আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ২০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা (টিআইবি রিপোর্ট)। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কার্যকরী জাতীয় সংসদ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। নির্বাচন হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সংসদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হচ্ছে সংসদকে শক্তিশালী করা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সংসদকে শক্তিশালী করতে পারিনি। সরকারে যারা থাকেন, তাদের দায়িত্বটি বেশি। কিন্তু এ কথাটা আমরা ভুলে যাই। সংসদ হচ্ছে জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা। জাতীয় নীতি এখানে প্রণীত হবে। জাতীয় স্বার্থ জাতীয় সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে সংসদে ডিবেট হবে। সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিরোধী দল বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করবে। কিন্তু এই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যে কারণে সরকারি নীতি হয়ে যাচ্ছে একপক্ষীয়। জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, তা সংসদে উপস্থাপিত হয় না। আলোচনাও হয় না। কিছুদিন আগে সিপিডির এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি স্পিকার। তিনি বলেছিলেন সংসদ সদস্যরা জাতীয় নীতি নির্ধারণী বিষয়ে বক্তব্য দেন না, প্রস্তাবও রাখেন না, এমনকি কোনো প্রশ্নও উত্থাপন করেন না। অতি সম্প্রতি ট্রানজিট ফি ছাড়াই ট্রান্সশিপমেন্টের কয়েকটি চালান ত্রিপুরা গেছে। যেখানে এখনো ট্রানজিট ফি নির্ধারিত হয়নি, সেখানে কী করে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করা হয়? বিষয়টি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অথচ বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হলো না। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ৪২ চাকার যান চলাচলের ফলে বাংলাদেশ যে পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সেই ক্ষতি আমরা কীভাবে পূরণ করব, সে ব্যাপারেও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ইতোমধ্যে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারও কোনো সুস্পষ্ট জবাব আমরা পাইনি। অথচ সংসদে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। ডেপুটি স্পিকার এটা স্বীকার করলেও, সংসদে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার কোনো পরিবেশও তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। সংসদীয় রাজনীতিতে একটি 'ছায়া মন্ত্রিসভা' থাকে। এটা সংসদীয় রাজনীতির একটি সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। বর্তমান বিরোধী দলও সংসদে একটি 'ছায়া মন্ত্রিসভা' গঠন করতে পারেনি। এই 'ছায়া মন্ত্রিসভায়' যারা থাকবেন, তারা সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করে বিকল্প একটি নীতি উপস্থাপন করবেন। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অনিবার্যভাবে দুটি শক্তি। গণতন্ত্র বিনির্মাণে এদের মাঝে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এটি না থাকলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি পেয়েছিল প্রাপ্ত ভোটের ৩০.৮১ ভাগ, আর আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ ভাগ, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট, আর বিএনপি ৩৩.৬১ ভাগ, অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপি ৪০.৯৭ ভাগ ভোট, আর আওয়ামী লীগ ৪০.১৩ ভাগ ভোট।
সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্তি ৪৮.০৬ ভাগ, আর বিএনপির ৩২.৪৫ ভাগ। পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মাঝে একটি 'সমঝোতা' কেন প্রয়োজন। এই 'সমঝোতা' নেই বিধায় গণতন্ত্র এখানে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিতে বান কি মুন যখন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি 'সংলাপ'-এর আহ্বান জানান, তখন তিনি সরকারকে একটা মেসেজ পেঁৗছে দেন বলেই আমার ধারণা। সরকার এই মেসেজ থেকে কতটুকু ধারণ করবে, তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু একটা সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে ২০১২ সালে বাংলাদেশকে একটি বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। সুতরাং 'সংলাপ'টা জরুরি। জাতির বৃহত্তম স্বার্থেই বিভিন্ন জাতীয় প্রশ্নে, বিশেষ করে দশম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন।
সরকার ও বিরোধী দল যখন পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে একটি 'অবস্থান' নিয়েছে, তখন একটি রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে বান কি মুনের মতো ব্যক্তিত্ব এই আহ্বান জানালেন। এর গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। এই আহ্বান গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি কারণে। আর তা হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ইতোমধ্যেই আক্রান্ত। গ্রিস ও ইতালিতে সরকারের পতন হয়েছে। আর অকুপাই ম্যুভমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের এক শহর থেকে অন্য শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের অবস্থাও ভালো নয়। গত ৩ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই ঘাটতির পরিমাণ ১৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে। ১ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ১৬ হাজার ৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮৪ শতাংশ। আর দৈনিক হিসেবে সরকারের ব্যাংক ঋণের গড় ১৩৩ কোটি টাকা। নতুন নোট ছেপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না।
সরকার ইতোমধ্যে তাদের ৩৪ মাসের শাসনকাল পার করেছে। এ ক্ষেত্রে খুব সঙ্গত কারণেই সরকারের 'পারফরমেন্স' বিচার করা যায়। গত ৩৪ মাসে একাধিক সেক্টরে সরকারের ব্যর্থতা প্রকট। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম আরো এক দফা বাড়িয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে সিএনজি এবং বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে। সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। কারণ দাতারা তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার কারণে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। খোদ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দুর্নীতির প্রশ্ন তুলেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগ করেছে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক। অথচ যোগাযোগমন্ত্রী এখনো তার পদে বহাল আছেন। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হলে মন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। শেয়ারবাজার নিয়ে 'জুয়াখেলা' এখনো বন্ধ হয়নি। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অনশন পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু তাতে সরকারের এতটুকু টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। মূল্যস্ফীতি এখন সর্বকালের শীর্ষে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে গেছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতায় সাধারণ মানুষের এখন নাভিশ্বাস। তারা চায় একটি পরিবর্তন। তাই সাধারণ মানুষ যে বেগম জিয়ার প্রতি সমর্থন ছুড়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই আস্থা ও বিশ্বাস নেই। সরকারি দল বিরোধী দলকে 'শত্রু' মনে করে। প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাটের পাটগ্রামের সমাবেশে বলেছেন, 'জোট সরকারের মন্ত্রীর দুর্নীতিতে পদ্মা সেতুর ঋণ স্থগিত হয়েছে' (সকালের খবর, ২০ অক্টোবর)। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা রীতিমত এক প্রশ্ন। কেননা বর্তমান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির প্রশ্নই তুলেছিল বিশ্বব্যাংক। আর জোট সরকার ক্ষমতা ছেড়েছে ৫ বছর আগে। পাঁচ বছর আগের দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক তোলেনি।
আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সরকারকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার কাজটি করে বিরোধী দল। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলকে আদৌ গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া হয়নি। 'ব্রুট মেজরিটির' জোরে সরকার প্রতিটি সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে সংসদে ও সংসদের বাইরে 'চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স'-এর অভাবেই রাষ্ট্র একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে এই 'চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স'-এর অভাবটি অত্যন্ত প্রবল। সরকার এককভাবে যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্তের চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। সরকার বিরোধী দলের মতামত গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে সংসদকে কার্যকর না করা। পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে সংসদ বয়কটের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, বিশ বছর পরও সেই সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল পঞ্চম সংসদে ১১৮ দিন (৯টি অধিবেশনে), ৭ম সংসদে ১৬৫ দিন (৯টি অধিবেশনে), ৮ম সংসদে ২২৩ দিন (৯টি অধিবেশনে) সংসদ বয়কট করে। ৯ম সংসদের সংসদ বয়কটের হিসাব-নিকাশ আমরা আরো পরে পাব। তবে সংসদ বয়কট তো অব্যাহত রয়েছে। উপরে উল্লেখিত তিনটি সংসদেই মারাত্মক কোরাম সঙ্কট পরিলক্ষিত হয়। ৭ম সংসদের ৯ম অধিবেশনে মোট ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট কোরাম সঙ্কটের কারণে ব্যয় হয়। ৮ম সংসদে ২২৭ ঘণ্টা অপচয় হয় কোরাম সঙ্কটে যা সংসদের মোট কার্যকালের একপঞ্চমাংশ। এর জন্য আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ২০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা (টিআইবি রিপোর্ট)। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কার্যকরী জাতীয় সংসদ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। নির্বাচন হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সংসদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হচ্ছে সংসদকে শক্তিশালী করা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সংসদকে শক্তিশালী করতে পারিনি। সরকারে যারা থাকেন, তাদের দায়িত্বটি বেশি। কিন্তু এ কথাটা আমরা ভুলে যাই। সংসদ হচ্ছে জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা। জাতীয় নীতি এখানে প্রণীত হবে। জাতীয় স্বার্থ জাতীয় সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে সংসদে ডিবেট হবে। সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিরোধী দল বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করবে। কিন্তু এই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যে কারণে সরকারি নীতি হয়ে যাচ্ছে একপক্ষীয়। জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, তা সংসদে উপস্থাপিত হয় না। আলোচনাও হয় না। কিছুদিন আগে সিপিডির এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি স্পিকার। তিনি বলেছিলেন সংসদ সদস্যরা জাতীয় নীতি নির্ধারণী বিষয়ে বক্তব্য দেন না, প্রস্তাবও রাখেন না, এমনকি কোনো প্রশ্নও উত্থাপন করেন না। অতি সম্প্রতি ট্রানজিট ফি ছাড়াই ট্রান্সশিপমেন্টের কয়েকটি চালান ত্রিপুরা গেছে। যেখানে এখনো ট্রানজিট ফি নির্ধারিত হয়নি, সেখানে কী করে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করা হয়? বিষয়টি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অথচ বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হলো না। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ৪২ চাকার যান চলাচলের ফলে বাংলাদেশ যে পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সেই ক্ষতি আমরা কীভাবে পূরণ করব, সে ব্যাপারেও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ইতোমধ্যে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারও কোনো সুস্পষ্ট জবাব আমরা পাইনি। অথচ সংসদে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। ডেপুটি স্পিকার এটা স্বীকার করলেও, সংসদে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার কোনো পরিবেশও তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। সংসদীয় রাজনীতিতে একটি 'ছায়া মন্ত্রিসভা' থাকে। এটা সংসদীয় রাজনীতির একটি সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। বর্তমান বিরোধী দলও সংসদে একটি 'ছায়া মন্ত্রিসভা' গঠন করতে পারেনি। এই 'ছায়া মন্ত্রিসভায়' যারা থাকবেন, তারা সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করে বিকল্প একটি নীতি উপস্থাপন করবেন। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অনিবার্যভাবে দুটি শক্তি। গণতন্ত্র বিনির্মাণে এদের মাঝে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এটি না থাকলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি পেয়েছিল প্রাপ্ত ভোটের ৩০.৮১ ভাগ, আর আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ ভাগ, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট, আর বিএনপি ৩৩.৬১ ভাগ, অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপি ৪০.৯৭ ভাগ ভোট, আর আওয়ামী লীগ ৪০.১৩ ভাগ ভোট।
সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্তি ৪৮.০৬ ভাগ, আর বিএনপির ৩২.৪৫ ভাগ। পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মাঝে একটি 'সমঝোতা' কেন প্রয়োজন। এই 'সমঝোতা' নেই বিধায় গণতন্ত্র এখানে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিতে বান কি মুন যখন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি 'সংলাপ'-এর আহ্বান জানান, তখন তিনি সরকারকে একটা মেসেজ পেঁৗছে দেন বলেই আমার ধারণা। সরকার এই মেসেজ থেকে কতটুকু ধারণ করবে, তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু একটা সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে ২০১২ সালে বাংলাদেশকে একটি বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। সুতরাং 'সংলাপ'টা জরুরি। জাতির বৃহত্তম স্বার্থেই বিভিন্ন জাতীয় প্রশ্নে, বিশেষ করে দশম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন।
দৈনিক যায় যায় দিন। ২১ নভেম্বর ২০১১। ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment