বলতে দ্বিধা নেই, এই অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছে। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে অকুপাই মুভমেন্টকে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিতশ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবকে সংগঠিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তৎকালীন সময়ে জার্মান ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জে ডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকে এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অক্ষমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপীই একটি পরিবর্তন আনছে
বিশ্বব্যাপী আজ যে 'অকুপাই মুভমেন্টে'র জন্ম হয়েছে তা কি বিপ্লবের সনাতন সংজ্ঞাকে বদলে দিয়েছে? একুশ শতকে 'অকুপাই মুভমেন্ট'কে কেন্দ্র করে কী একটি 'বিপ্লব' সংঘটিত হবে? 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটে'র দৃষ্টান্ত নিউইয়র্ক ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আটলান্টিকের ওপারের দেশগুলোতে। একই সঙ্গে অকুপাই পোর্টল্যান্ড ক্যালিফোর্নিয়ার পোর্টল্যান্ড পোর্টে অনুষ্ঠিত হলেও তা ছড়িয়ে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পাড়ের দেশগুলোতে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রতিটি অকুপাই মুভমেন্টের পেছনে কাজ করছে একটি জিনিস, তা হচ্ছে সমাজন অসমতা, বৈষম্য ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সীমিত এক শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে এক সরব প্রতিবাদ। নিউইয়র্কের 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' আন্দোলন ৬০ দিন পর ভেঙে দেওয়া হলেও এর রেশ রয়ে গেছে। আন্দোলন বন্ধ হয়নি। বিক্ষোভকারীরা দিনের পর দিন নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটের পাশে জুকোটি পার্কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছিল। প্রচণ্ড শীত ও তুষারপাতের মধ্যেও শত শত বিক্ষোভকারী তাঁবু টানিয়ে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিল। আন্দোলনের এতটুকুও কমতি নেই। সর্বশ্রেণীর মানুষের সমর্থন তারা পেয়েছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের আন্দোলনের খবর পেঁৗছে গিয়েছিল পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের মতো ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজা দখল করে নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এই আন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছে October 2011 Movement. ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত এই আন্দোলন পার করেছে ৪৫ দিন। October 2011 Movement -এর উদ্দেশ্য একটাই, যুদ্ধ ব্যয় কমানো (৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার) ও সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো। বলা ভালো, জুকোটি পার্ক কিংবা ফ্রিডম প্লাজা বেছে নেওয়ার কারণ কিন্তু একটাই, জুকোটি পার্কের পাশেই রয়েছে ওয়ালস্ট্রিট, এখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজার, রয়েছে বড় বড় করপোরেট হাউসের সদর দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার মূল কেন্দ্র এখানে। আর ফ্রিডম প্লাজার কাছেই রয়েছে কংগ্রেস ভবন ও সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস। বিক্ষোভকারীরা এই দুটি জায়গা কেন বেছে নিল, তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙন ও সমাজতন্ত্রের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, পুঁজিবাদই সমাজের মঙ্গল আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কনজারভেটিভ তাত্তি্বক (ফুকিয়ামা) এই ধারণার স্বপক্ষে তাদের লেখনী অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হলো পুঁজিবাদও সমাজ বিকাশে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। পুঁজিবাদী সমাজেই একটি বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভোগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ বহন করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর জোসেফ স্টিগলিজের মতে, শীর্ষে থাকা এই ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়াখেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে Casino capitalism . অথচ পরিসংখ্যান বলে, সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। জুকোটি পার্কে জমায়েত হওয়া অনেক তরুণ জানিয়েছে, তারা গ্র্যাজুয়েট করার পর চাকরি পাচ্ছে না। অথচ ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই যে বৈষম্য, একই ধরনের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই। এক ধরনের class warfaveÕ বা শ্রেণীযুুদ্ধের সূচনা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে। অকুপাই মুভমেন্টগুলো তার বড় প্রমাণ। এই শ্রেণীযুদ্ধের কথা বলেছিলেন মার্কস। মার্কসের বিশ্লেষণে এই শ্রেণীদ্বন্দ্ব কোনো সমাজে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। মার্কস এবং অ্যাঙ্গেলসের বিখ্যাত The communist Manifesto গ্রন্থে এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, \'..a fight that each time ended, either in a revolutionary reconstitution of society at large, or in a common ruin of the contending classes. \' অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে অথবা উভয় শ্রেণীর বিলুপ্ত ঘটবে। মার্কস চূড়ান্ত বিচারে শোষিতশ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব সনাতন। আজ এত বছর পরও শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে অকুপাই মুভমেন্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্কস আজও বেঁচে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের এই শ্রেণীদ্বন্দ্বকে কীভাবে বিশ্লেষণ করতেন বলতে পারব না। তবে নোয়াম চমস্কির লেখনীতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার চমৎকার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে আখ্যায়িত করেছেনPlutonomy হিসেবে অর্থাৎ সম্পদশালী ধনী শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। নোয়াম চমস্কি লিখেছেন, ÔIncreasingly, wealth concentrated in the financial sector. Politiciasis faced with the rising cost of campaigns, were driven ever deeper into the Pockets of Wealthy backers.Õ এটাই হচ্ছে আসল কথা। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু ধনিকশ্রেণীর হাতে। রাজনীতি-অর্থনীতি এরাই পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে বলা হয় Billionaire friendly.Õ .' ধনিকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস। ধনীদের টাকায় কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হন। এরপর কংগ্রেস সদস্যরা ধনীদের আরও সুযোগ-সুবিধা দেন। নোয়াম চমস্কি তাই আমেরিকার ওই অকুপাই মুভমেন্টে এতটুকুও অবাক হননি! তিনি লিখেছেন, The most exciting aspect of the occupy movement is the construction of the linkage that are taking place all over. If they can be sustained and expanded. Occupy can lead to dedicated efforts to set society on a moral human course. মার্কস যেখানে বিশ্বাসের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলছেন, 'গড়ৎধষ যঁসধহ পড়ঁৎংব'-এর কথা। বিশ্বজুড়ে যে অকুপাই মুভমেন্ট পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটা সমন্বয় থাকা দরকার_ এটাও চমস্কির অভিমত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী সমাজে একটি পরিবর্তন আসন্ন। কেননা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজে অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ঐক্যে একটি বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস ও ইতালির পরিস্থিতির রেশ ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এই বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণী-বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে একটি ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও দেশটিতে দরিদ্রতার হার ৬ ভাগ আর বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ ভাগ। সুইজারল্যান্ড ইইউর সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৮ আর ৭ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এই হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ ভাগ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে বেকারত্ব ও দরিদ্রতার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও ১৮ ভাগ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও অকুপাই মুভমেন্টের খবর আমরা জানি। কেননা এসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ওইসব দেশেও অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছে। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে অকুপাই মুভমেন্টকে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিতশ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবকে সংগঠিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তৎকালীন সময়ে জার্মান ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জে ডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকে এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অক্ষমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপীই একটি পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তনকে 'বিপ্লব' বলা যাবে কি-না জানি না, কিন্তু একুশ শতকে বিশ্ব যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বিশ্বব্যাপী আজ যে 'অকুপাই মুভমেন্টে'র জন্ম হয়েছে তা কি বিপ্লবের সনাতন সংজ্ঞাকে বদলে দিয়েছে? একুশ শতকে 'অকুপাই মুভমেন্ট'কে কেন্দ্র করে কী একটি 'বিপ্লব' সংঘটিত হবে? 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটে'র দৃষ্টান্ত নিউইয়র্ক ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আটলান্টিকের ওপারের দেশগুলোতে। একই সঙ্গে অকুপাই পোর্টল্যান্ড ক্যালিফোর্নিয়ার পোর্টল্যান্ড পোর্টে অনুষ্ঠিত হলেও তা ছড়িয়ে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পাড়ের দেশগুলোতে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রতিটি অকুপাই মুভমেন্টের পেছনে কাজ করছে একটি জিনিস, তা হচ্ছে সমাজন অসমতা, বৈষম্য ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সীমিত এক শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে এক সরব প্রতিবাদ। নিউইয়র্কের 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' আন্দোলন ৬০ দিন পর ভেঙে দেওয়া হলেও এর রেশ রয়ে গেছে। আন্দোলন বন্ধ হয়নি। বিক্ষোভকারীরা দিনের পর দিন নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটের পাশে জুকোটি পার্কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছিল। প্রচণ্ড শীত ও তুষারপাতের মধ্যেও শত শত বিক্ষোভকারী তাঁবু টানিয়ে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিল। আন্দোলনের এতটুকুও কমতি নেই। সর্বশ্রেণীর মানুষের সমর্থন তারা পেয়েছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের আন্দোলনের খবর পেঁৗছে গিয়েছিল পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের মতো ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজা দখল করে নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এই আন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছে October 2011 Movement. ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত এই আন্দোলন পার করেছে ৪৫ দিন। October 2011 Movement -এর উদ্দেশ্য একটাই, যুদ্ধ ব্যয় কমানো (৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার) ও সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো। বলা ভালো, জুকোটি পার্ক কিংবা ফ্রিডম প্লাজা বেছে নেওয়ার কারণ কিন্তু একটাই, জুকোটি পার্কের পাশেই রয়েছে ওয়ালস্ট্রিট, এখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজার, রয়েছে বড় বড় করপোরেট হাউসের সদর দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার মূল কেন্দ্র এখানে। আর ফ্রিডম প্লাজার কাছেই রয়েছে কংগ্রেস ভবন ও সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস। বিক্ষোভকারীরা এই দুটি জায়গা কেন বেছে নিল, তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙন ও সমাজতন্ত্রের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, পুঁজিবাদই সমাজের মঙ্গল আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কনজারভেটিভ তাত্তি্বক (ফুকিয়ামা) এই ধারণার স্বপক্ষে তাদের লেখনী অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হলো পুঁজিবাদও সমাজ বিকাশে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। পুঁজিবাদী সমাজেই একটি বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভোগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ বহন করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর জোসেফ স্টিগলিজের মতে, শীর্ষে থাকা এই ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়াখেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে Casino capitalism . অথচ পরিসংখ্যান বলে, সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। জুকোটি পার্কে জমায়েত হওয়া অনেক তরুণ জানিয়েছে, তারা গ্র্যাজুয়েট করার পর চাকরি পাচ্ছে না। অথচ ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই যে বৈষম্য, একই ধরনের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই। এক ধরনের class warfaveÕ বা শ্রেণীযুুদ্ধের সূচনা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে। অকুপাই মুভমেন্টগুলো তার বড় প্রমাণ। এই শ্রেণীযুদ্ধের কথা বলেছিলেন মার্কস। মার্কসের বিশ্লেষণে এই শ্রেণীদ্বন্দ্ব কোনো সমাজে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। মার্কস এবং অ্যাঙ্গেলসের বিখ্যাত The communist Manifesto গ্রন্থে এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, \'..a fight that each time ended, either in a revolutionary reconstitution of society at large, or in a common ruin of the contending classes. \' অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে অথবা উভয় শ্রেণীর বিলুপ্ত ঘটবে। মার্কস চূড়ান্ত বিচারে শোষিতশ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব সনাতন। আজ এত বছর পরও শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে অকুপাই মুভমেন্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্কস আজও বেঁচে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের এই শ্রেণীদ্বন্দ্বকে কীভাবে বিশ্লেষণ করতেন বলতে পারব না। তবে নোয়াম চমস্কির লেখনীতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার চমৎকার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে আখ্যায়িত করেছেনPlutonomy হিসেবে অর্থাৎ সম্পদশালী ধনী শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। নোয়াম চমস্কি লিখেছেন, ÔIncreasingly, wealth concentrated in the financial sector. Politiciasis faced with the rising cost of campaigns, were driven ever deeper into the Pockets of Wealthy backers.Õ এটাই হচ্ছে আসল কথা। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু ধনিকশ্রেণীর হাতে। রাজনীতি-অর্থনীতি এরাই পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে বলা হয় Billionaire friendly.Õ .' ধনিকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস। ধনীদের টাকায় কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হন। এরপর কংগ্রেস সদস্যরা ধনীদের আরও সুযোগ-সুবিধা দেন। নোয়াম চমস্কি তাই আমেরিকার ওই অকুপাই মুভমেন্টে এতটুকুও অবাক হননি! তিনি লিখেছেন, The most exciting aspect of the occupy movement is the construction of the linkage that are taking place all over. If they can be sustained and expanded. Occupy can lead to dedicated efforts to set society on a moral human course. মার্কস যেখানে বিশ্বাসের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলছেন, 'গড়ৎধষ যঁসধহ পড়ঁৎংব'-এর কথা। বিশ্বজুড়ে যে অকুপাই মুভমেন্ট পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটা সমন্বয় থাকা দরকার_ এটাও চমস্কির অভিমত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী সমাজে একটি পরিবর্তন আসন্ন। কেননা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজে অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ঐক্যে একটি বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস ও ইতালির পরিস্থিতির রেশ ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এই বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণী-বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে একটি ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও দেশটিতে দরিদ্রতার হার ৬ ভাগ আর বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ ভাগ। সুইজারল্যান্ড ইইউর সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৮ আর ৭ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এই হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ ভাগ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে বেকারত্ব ও দরিদ্রতার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও ১৮ ভাগ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও অকুপাই মুভমেন্টের খবর আমরা জানি। কেননা এসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ওইসব দেশেও অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছে। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে অকুপাই মুভমেন্টকে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিতশ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবকে সংগঠিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তৎকালীন সময়ে জার্মান ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জে ডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকে এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অক্ষমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপীই একটি পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তনকে 'বিপ্লব' বলা যাবে কি-না জানি না, কিন্তু একুশ শতকে বিশ্ব যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
0 comments:
Post a Comment