সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীকে দু’ভাগে ভাগ করে দু’টি পৃথক সিটি কর্পোরেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভা এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের অনুমোদন দিয়েছে। আগামী সংসদ অধিবেশনে এ সংক্রান্ত একটি বিল উত্থাপিত হবে বলে আশা করছি। এবং এ ক্ষেত্রে যা হয়, তাই হতে যাচ্ছে। সংসদে বিলটি পাস হবে এবং চারশ’ বছরের পুরনো ঢাকা শহরকে আমরা দেখবো দু’টি সিটি কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালিত হতে। ঢাকা মহানগরীকে দু’ভাগে ভাগ করার পেছনে সরকারের যুক্তি যেটাই থাকুক না কেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিরোধী দল সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। শুধু তাই নয় সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা, যারা ঢাকা মহানগরী থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, তারা এই বিভক্তিকে সমর্থন করেছেন, এমন কোন দালিলিক ডকুমেন্টও আমাদের কাছে নেই। এমনকি ঢাকা মহানগরী বর্তমানে ৯২টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। নির্বাচিত কাউন্সিলরদের (কমিশনার) অনেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তারা এর আগে ঢাকা মহানগরীকে দু’ভাগে ভাগ করার কোন প্রস্তাব করেছেন, এমনটিও আমাদের জানা নেই। সে কারণেই সরকার যখন এই সিদ্ধান্তটি নিল, তখন এটা বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে মাত্র। ইতোমধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিনি ডিসিসিকে আরো শক্তিশালী করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কর্পোরেশনের সেবা নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর যে কথা বলা হয়, তাতে এখন নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতে পারে। শুধু তাই নয়, সিটি কর্পোরেশন দু’টি পরিচালনায়ও নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। প্রসঙ্গত, বিভক্তির ফলে ডিসিসির দক্ষিণে পড়বে ৫৬টি ওয়ার্ড, আর উত্তরে পড়বে ৩৬টি। এর ফলে আয় ও ব্যয়ের দিক দিয়ে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হতে বাধ্য। কেননা ডিসিসির বেশি আয় হয় দক্ষিণ অঞ্চল থেকে। এখন বিভক্তির ফলে দক্ষিণ অঞ্চল থেকে রাজস্ব আসবে ৭০ শতাংশ। আর উত্তর অঞ্চল থেকে রাজস্ব আসবে মাত্র ৩০ শতাংশ। এর ফলে একাধিক সমস্যা সৃষ্টি হতে বাধ্য। উত্তর অঞ্চল থেকে রাজস্ব কম আসলে, সেখানে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। একই সাথে উত্তর অঞ্চলের মানুষ সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, দুই মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর ক্ষমতা পরিচালনা করতে গিয়ে এদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। আর আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে করে এ দ্বন্দ্ব যদি সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নেয়, তাতে আমি অবাক হবো না। তৃতীয়ত, সিটি কর্পোরেশনের একটা বড় কাজ হচ্ছে স্থানীয় বাজার, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু ডিসিসি ভাগ হলে এক ধরনের সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হবে। লোকবলের অভাব হেতু বর্জ্য-ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। চতুর্থত, দু’টি কর্পোরেশন গঠিত হলে সরকারের খরচও বাড়বে। কেননা দ্বিতীয় মেয়রের জন্য অফিস তৈরি, জনবল নিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারকে আর্থিক সাহায্য দিতে হবে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাবে। সে ক্ষেত্রে এই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ওয়ার্ডসমূহের কাউন্সিলদের সাথে, বিশেষ করে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের সাথে মেয়রের একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে। যা কিনা কর্পোরেশনের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি এ খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হবে, অর্থনীতির এ মন্দার যুগে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বর্তমানে ডিসিসিতে রয়েছেন, তাদের কেউই নতুন সৃষ্ট সিটি কর্পোরেশনে যোগ দিতে চাইবেন না। তাদের ট্রান্সফার করা হলে, তারা উচ্চ আদালতে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিট করতে পারেন। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রান্সফারের বিষয়টি একটি বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাদের পেনশনের ব্যাপারটিও এর সাথে জড়িত। পঞ্চমত, সরকার যেভাবে সীমানা চিহ্নিত করে সিটি কর্পোরেশন উত্তর ও সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ করেছেন, তা আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। ভুক্তভোগী যে কোন নাগরিক ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের প্রতিকার চাইতে পারেন। উচ্চ আদালতের যে কোন সিদ্ধান্ত নানা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। ষষ্ঠ, সিটি কর্পোরেশনের বিভক্তি সংক্রান্ত বিলটি সংসদে পাস হয়ে গেলে সরকার দু’টি সিটি কর্পোরেশনে দু’জন প্রশাসক নিয়োগ করবে। সরকার ১২০ দিনের মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দেবে। এখানে নানা জটিলতায় (মামলা-মোকদ্দমা, প্রার্থী বাছাই ইত্যাদি) নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরা নির্ধারিত সময়ের বাইরেও ক্ষমতা ভোগ করবেন। সরকার এমনিতেই ডিসিসির নির্বাচন দিতে পারেনি। বর্তমান ডিসিসির মেয়র ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার টার্ম শেষ হয়ে যাবার পরও বর্তমান সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি। যে সমস্যার জন্য সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি, সেই সমস্যা থেকে যাবে। ফলে ডিসিসির বিভক্তি কোন কাজে আসবে না। প্রশাসকরা যদি রাজনীতিবিদ হন (যার সম্ভাবনা বেশি), তাহলে তারা নিজেরাও নানা কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবেন। ফলে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। সপ্তম, ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্টের মাধ্যমে সীমানা সমীক্ষা চালানো হয়। ওই সময় মন্ত্রিসভায় অন্যান্য দেশের মতো এককেন্দ্রিক কর্তৃপক্ষ (ইউনিটারি অথরিটি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। তখন মন্ত্রিসভার ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্তটি ওই সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক। এতে করে বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকারের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সাথে দাতা সংস্থাগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড়করণ বন্ধ রেখেছে। এখন ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্ত দাতা সংস্থাটির সাথে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাতে পারে।
সুতরাং ডিসিসির বিভক্তি নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করতে আদৌ কোন সাহায্য করবে না। সরকার তার ক্ষমতাবলে এই কাজটি করতেই পারে। কিন্তু এর ফলাফল ভোগ করবে এই ঢাকা শহরে বসবাসরত নাগরিকরা। ডিসিসির বিভক্তি কোন সমাধান নয়। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর, বিশেষ করে লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা কোলকাতার মতো শহরে একজনই মেয়র আছেন। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের মেয়রের কর্মকাণ্ড অনেক ব্যাপক। প্রশাসনিক এলাকাও তাদের বড়। সেখানে একজন মেয়র যদি বিশাল এক এলাকার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেন, তাহলে ঢাকার একজন মেয়র পারবেন না কেন। আসলে ডিসিসির বিভক্তির বিষয়টি রাজনৈতিক। ক্ষমতাসীন দলে একাধিক মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। তাদেরকে খুশি করার জন্যই মূলত এই বিভক্তি। এর মধ্যে দিয়ে মেয়রের মর্যাদাও ছোট করা হল। বর্তমান মেয়র একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে থাকেন। প্রটোকল অনুযায়ী মন্ত্রীর সমমর্যাদা ভোগ করেন। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী মেয়র একজন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করবেন। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমনি মেয়রের মর্যাদাকে এক ধাপ নিচে নামানো হল, অন্যদিকে তেমনি সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকার পুনঃনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নে অন্তরায় সৃষ্টি করা হল। মেয়র খোকা নিশ্চয়ই প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। এমনকি বিরোধী দলের অন্যান্য যেসব প্রার্থীর নাম শোনা যায়, তারাও সিনিয়র নেতা। তারা নিশ্চয়ই নয়া আইন অনুযায়ী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। আসলে সিটি কর্পোরেশনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের বিকল্প কিছু নেই। অনেক বড় বড় সিটি কর্পোরেশন মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট হিসেবে পরিচালিত হয়। নাগরিক সুবিধার সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয় (পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি) এই মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের আওতাধীন থাকে। ফলে একদিকে যেমনি এক ধরনের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তেমনি নাগরিকের ন্যূনতম সুবিধাও নিশ্চিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষিতে এসব বিষয়াদিতে নগর প্রশাসনের করার কিছুই নেই। শহরের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও, পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নগর প্রশাসনের ভূমিকা এখানে শূন্য। তাই ডিসিসির বিভক্তি নয়। বরং ডিসিসিকে ঠিক রেখে এটাকে মেট্রোপলিটান গভর্নমেন্ট হিসেবে উন্নীত করা যায়। আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও ঢাকার প্রাক্তন মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফ এই মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট ধারণার পক্ষে ছিলেন। বর্তমান মেয়রও এমনটি চান। শুধু তাই নয় আগামী একশ বছরের ঢাকাকে চিন্তা করে এখনই একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেঁষে কেরাণীগঞ্জ থেকে সাভার হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আগামী দিনের জন্য একটি পরিকল্পিত ঢাকা মহানগরীর মাস্টার প্লান তৈরিতে এখন থেকেই কাজ শুরু করা উচিত। এটা না করে ডিসিসিকে ভাগ করে ঢাকা মহানগরীকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না। প্রায় দেড় কোটি লোক বাস করে এই ঢাকা নগরীতে। জলাবদ্ধতা, ট্রাফিক জ্যাম, হকারদের ফুটপাত দখল, বিদ্যুৎ সংকট, শিশুদের খেলার মাঠের অভাব, রাস্তাঘাটের দুরবস্থা- এই নিয়ে যে ঢাকা মহানগর, এই মহানগরের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এই মুহূর্তে এটাই জরুরি। এটাই প্রায়োরিটি। সরকারের এদিকে নজর দেয়া উচিত। কিন্তু এদিকে নজর না দিয়ে সরকার যখন ডিসিসিকে ভাগ করার উদ্যোগ নেয়, তখন প্রশ্ন উঠবে বৈকি। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে বটে। কিন্তু সিদ্ধান্তটি কার্যকর না করাই মঙ্গল।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কর্পোরেশনের সেবা নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর যে কথা বলা হয়, তাতে এখন নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতে পারে। শুধু তাই নয়, সিটি কর্পোরেশন দু’টি পরিচালনায়ও নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। প্রসঙ্গত, বিভক্তির ফলে ডিসিসির দক্ষিণে পড়বে ৫৬টি ওয়ার্ড, আর উত্তরে পড়বে ৩৬টি। এর ফলে আয় ও ব্যয়ের দিক দিয়ে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হতে বাধ্য। কেননা ডিসিসির বেশি আয় হয় দক্ষিণ অঞ্চল থেকে। এখন বিভক্তির ফলে দক্ষিণ অঞ্চল থেকে রাজস্ব আসবে ৭০ শতাংশ। আর উত্তর অঞ্চল থেকে রাজস্ব আসবে মাত্র ৩০ শতাংশ। এর ফলে একাধিক সমস্যা সৃষ্টি হতে বাধ্য। উত্তর অঞ্চল থেকে রাজস্ব কম আসলে, সেখানে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। একই সাথে উত্তর অঞ্চলের মানুষ সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, দুই মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর ক্ষমতা পরিচালনা করতে গিয়ে এদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। আর আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে করে এ দ্বন্দ্ব যদি সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নেয়, তাতে আমি অবাক হবো না। তৃতীয়ত, সিটি কর্পোরেশনের একটা বড় কাজ হচ্ছে স্থানীয় বাজার, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু ডিসিসি ভাগ হলে এক ধরনের সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হবে। লোকবলের অভাব হেতু বর্জ্য-ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। চতুর্থত, দু’টি কর্পোরেশন গঠিত হলে সরকারের খরচও বাড়বে। কেননা দ্বিতীয় মেয়রের জন্য অফিস তৈরি, জনবল নিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারকে আর্থিক সাহায্য দিতে হবে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাবে। সে ক্ষেত্রে এই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ওয়ার্ডসমূহের কাউন্সিলদের সাথে, বিশেষ করে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের সাথে মেয়রের একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে। যা কিনা কর্পোরেশনের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি এ খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হবে, অর্থনীতির এ মন্দার যুগে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বর্তমানে ডিসিসিতে রয়েছেন, তাদের কেউই নতুন সৃষ্ট সিটি কর্পোরেশনে যোগ দিতে চাইবেন না। তাদের ট্রান্সফার করা হলে, তারা উচ্চ আদালতে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিট করতে পারেন। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রান্সফারের বিষয়টি একটি বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাদের পেনশনের ব্যাপারটিও এর সাথে জড়িত। পঞ্চমত, সরকার যেভাবে সীমানা চিহ্নিত করে সিটি কর্পোরেশন উত্তর ও সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ করেছেন, তা আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। ভুক্তভোগী যে কোন নাগরিক ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের প্রতিকার চাইতে পারেন। উচ্চ আদালতের যে কোন সিদ্ধান্ত নানা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। ষষ্ঠ, সিটি কর্পোরেশনের বিভক্তি সংক্রান্ত বিলটি সংসদে পাস হয়ে গেলে সরকার দু’টি সিটি কর্পোরেশনে দু’জন প্রশাসক নিয়োগ করবে। সরকার ১২০ দিনের মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দেবে। এখানে নানা জটিলতায় (মামলা-মোকদ্দমা, প্রার্থী বাছাই ইত্যাদি) নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরা নির্ধারিত সময়ের বাইরেও ক্ষমতা ভোগ করবেন। সরকার এমনিতেই ডিসিসির নির্বাচন দিতে পারেনি। বর্তমান ডিসিসির মেয়র ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার টার্ম শেষ হয়ে যাবার পরও বর্তমান সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি। যে সমস্যার জন্য সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি, সেই সমস্যা থেকে যাবে। ফলে ডিসিসির বিভক্তি কোন কাজে আসবে না। প্রশাসকরা যদি রাজনীতিবিদ হন (যার সম্ভাবনা বেশি), তাহলে তারা নিজেরাও নানা কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবেন। ফলে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। সপ্তম, ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্টের মাধ্যমে সীমানা সমীক্ষা চালানো হয়। ওই সময় মন্ত্রিসভায় অন্যান্য দেশের মতো এককেন্দ্রিক কর্তৃপক্ষ (ইউনিটারি অথরিটি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। তখন মন্ত্রিসভার ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্তটি ওই সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক। এতে করে বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকারের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সাথে দাতা সংস্থাগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড়করণ বন্ধ রেখেছে। এখন ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্ত দাতা সংস্থাটির সাথে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাতে পারে।
সুতরাং ডিসিসির বিভক্তি নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করতে আদৌ কোন সাহায্য করবে না। সরকার তার ক্ষমতাবলে এই কাজটি করতেই পারে। কিন্তু এর ফলাফল ভোগ করবে এই ঢাকা শহরে বসবাসরত নাগরিকরা। ডিসিসির বিভক্তি কোন সমাধান নয়। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর, বিশেষ করে লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা কোলকাতার মতো শহরে একজনই মেয়র আছেন। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের মেয়রের কর্মকাণ্ড অনেক ব্যাপক। প্রশাসনিক এলাকাও তাদের বড়। সেখানে একজন মেয়র যদি বিশাল এক এলাকার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেন, তাহলে ঢাকার একজন মেয়র পারবেন না কেন। আসলে ডিসিসির বিভক্তির বিষয়টি রাজনৈতিক। ক্ষমতাসীন দলে একাধিক মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। তাদেরকে খুশি করার জন্যই মূলত এই বিভক্তি। এর মধ্যে দিয়ে মেয়রের মর্যাদাও ছোট করা হল। বর্তমান মেয়র একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে থাকেন। প্রটোকল অনুযায়ী মন্ত্রীর সমমর্যাদা ভোগ করেন। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী মেয়র একজন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করবেন। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমনি মেয়রের মর্যাদাকে এক ধাপ নিচে নামানো হল, অন্যদিকে তেমনি সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকার পুনঃনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নে অন্তরায় সৃষ্টি করা হল। মেয়র খোকা নিশ্চয়ই প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। এমনকি বিরোধী দলের অন্যান্য যেসব প্রার্থীর নাম শোনা যায়, তারাও সিনিয়র নেতা। তারা নিশ্চয়ই নয়া আইন অনুযায়ী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। আসলে সিটি কর্পোরেশনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের বিকল্প কিছু নেই। অনেক বড় বড় সিটি কর্পোরেশন মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট হিসেবে পরিচালিত হয়। নাগরিক সুবিধার সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয় (পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি) এই মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের আওতাধীন থাকে। ফলে একদিকে যেমনি এক ধরনের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তেমনি নাগরিকের ন্যূনতম সুবিধাও নিশ্চিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষিতে এসব বিষয়াদিতে নগর প্রশাসনের করার কিছুই নেই। শহরের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও, পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নগর প্রশাসনের ভূমিকা এখানে শূন্য। তাই ডিসিসির বিভক্তি নয়। বরং ডিসিসিকে ঠিক রেখে এটাকে মেট্রোপলিটান গভর্নমেন্ট হিসেবে উন্নীত করা যায়। আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও ঢাকার প্রাক্তন মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফ এই মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট ধারণার পক্ষে ছিলেন। বর্তমান মেয়রও এমনটি চান। শুধু তাই নয় আগামী একশ বছরের ঢাকাকে চিন্তা করে এখনই একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেঁষে কেরাণীগঞ্জ থেকে সাভার হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আগামী দিনের জন্য একটি পরিকল্পিত ঢাকা মহানগরীর মাস্টার প্লান তৈরিতে এখন থেকেই কাজ শুরু করা উচিত। এটা না করে ডিসিসিকে ভাগ করে ঢাকা মহানগরীকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না। প্রায় দেড় কোটি লোক বাস করে এই ঢাকা নগরীতে। জলাবদ্ধতা, ট্রাফিক জ্যাম, হকারদের ফুটপাত দখল, বিদ্যুৎ সংকট, শিশুদের খেলার মাঠের অভাব, রাস্তাঘাটের দুরবস্থা- এই নিয়ে যে ঢাকা মহানগর, এই মহানগরের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এই মুহূর্তে এটাই জরুরি। এটাই প্রায়োরিটি। সরকারের এদিকে নজর দেয়া উচিত। কিন্তু এদিকে নজর না দিয়ে সরকার যখন ডিসিসিকে ভাগ করার উদ্যোগ নেয়, তখন প্রশ্ন উঠবে বৈকি। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে বটে। কিন্তু সিদ্ধান্তটি কার্যকর না করাই মঙ্গল।
দৈনিক ইনকিলাব।নভেম্বর ২০১১।
ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment