ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট যখন একক মুদ্রা ইউরোর ভবিষ্যৎকে একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে, তখন অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কল্পনাতেই থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোন অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্র“য়ারিতে স্বাক্ষরিত মাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। মাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে সেঙেন চুক্তি এবং ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ ক’টি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউর সদস্য সংখ্যা এখন ২৭। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউর ১৫টি দেশের মাঝে ১১টি দেশে ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৭টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল, ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এই আশংকাই সত্যে পরিণত হল। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজি ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত ৯ বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও চলতি বছরের প্রথম দিকে ইইউ’র কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে পাপেন্দ্র“র নেতৃত্বাধীন গ্রিস সরকারের পতন হয়েছে ও পাপাদেমস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। একই সঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বার্লুসকোনিও পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
পাপেন্দ্র“ ও বার্লুসকোনির পরিণতি প্রমাণ করে ইউরোপ কী বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারগুলো প্রচুর ঋণ গ্রহণ করেও সেই ঋণ শোধ করতে পারছে না। ধীরে ধীরে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করলেও সেই দেউলিয়া রোধ করতে পারছে না। গ্রিস কিংবা ইতালি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের কথা ঘোষণা করলেও জনসাধারণ তার বিরোধিতা করছে। তারা দিনের পর দিন বিক্ষোভ মিছিল করছে। গ্রিসের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গ্রিসকে ‘উদ্ধারের’ জন্য যে ঋণ দিয়েছে, তা ছিল শর্তযুক্ত। ওই শর্ত মেনেই আবাসন করের ওপর একটি বিল পাস করেছে গ্রিসের সংসদ। পাশাপাশি কমানো হয়েছে পেনশন। কমানো হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা। গ্রিসের রাস্তায় বিক্ষোভ তাই নিত্যদিনের চিত্র। এ চিত্র আজ ইতালিতেও লক্ষ্য করা যায়। অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ইতালি ও গ্রিসের বাইরে আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। গ্রিসে ২০১০ সালে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১৩ ভাগ। আর দেশটির ঋণ পরিস্থিতি জিডিপির ১০০ ভাগকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলে গ্রিসের পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছিল যে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছিল না সরকার। এমন এক পরিস্থিতিতে আইএমএফ ও ইউরো জোনের দেশগুলো ৩ বছরের জন্য ১১০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু শর্ত হিসেবে ঘাটতি কমানোর কথা বলা হলে তা মারাÍক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আয়ারল্যান্ডে ২০০৯ সালে যেখানে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১১ ভাগ, সেখানে ২০১০ সালে তা উন্নীত হয় ৩১ ভাগে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ৮৫ বিলিয়ন ইউরোর একটি ‘উদ্ধার কর্মসূচি’ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্তুগালের পরিস্থিতি আরও খারাপ। ২০০৯ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭৬ ভাগ। আর ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৫ ভাগে। ফলে ২০১১ সালের মার্চে সেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে এবং পর্তুগালকে ঋণ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য ৭৮ মিলিয়ন ইউরো ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত জার্মানি কিংবা ফ্রান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম। এ কারণেই একক মুদ্রা হিসেবে চালু হওয়া ইউরোর ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় মুদ্রায় আবার ফিরে যেতে। বলা হচ্ছে, জাতীয় মুদ্রায় ফিরলে সমস্যার সামধান হবে। ইউরোপের স্বল্পোন্নত বা গরিব দেশগুলোর ধারণা, ইউরো চালু হওয়ার পর ইউরোপের শক্তিশালী (অর্থনেতিক দিক থেকে) ও দুর্বল দেশগুলোর মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। তাদের ধারণা, ইউরো তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। প্যাকেজ ভর্তুকি ও ঋণ দিয়েও সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। ফলে নিজ মুদ্রায় ফিরে যাওয়ার দাবি কোন কোন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে।
‘ইউরো জোন’-এর এই অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপের ঐক্যকে বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন টিকবে কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। অথচ একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একটা মডেল হিসেবে ধরা হতো। ইতিমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা ‘দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন’ গঠনের কথা শুনেছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি ‘এশীয় ইউনিয়ন’ গঠিত হতে পারে, এমন ধারণাও করেছিলেন কেউ কেউ। এখন ইউরো জোনের সংকটের ফলে নতুন করে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের (ইইসি) যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পরিণত হয়েছে। ইউরোপের ২৭টি দেশ এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইতিমধ্যে শুধু ইইউতেই যোগ দেয়নি, বরং ন্যাটোতেও যোগ দিয়েছে। ন্যাটোর এই সম্প্রসারণ নিয়েও নানা কথা রয়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মাঝে ২৪টি দেশ এখন ন্যাটোর সদস্য।
ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জš§ হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দফতর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক এবং ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এই সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন। যে যুক্তি তুলে এক সময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হল। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার ৫০তম পূর্তি উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরোর মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র তিন বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল, ইউরো সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিহ্নিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউ’র জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালে ‘ভেলভেট রেভ্যুলিউশন’ এই দেশগুলোকে সোভিয়েতনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোন দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এই দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউ’র সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও ক্রোয়েশিয়া এখনও ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারও মন্দার আশংকা বাড়ছে। সামনের বছর ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এর ফলে ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ, তা আরও বাড়বে। ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এই বিভক্তির কথা বলছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কিনা কিংবা ‘নতুন ইউরোপ’-এর স্বরূপ কী হবে, তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসবেই, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
পাপেন্দ্র“ ও বার্লুসকোনির পরিণতি প্রমাণ করে ইউরোপ কী বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারগুলো প্রচুর ঋণ গ্রহণ করেও সেই ঋণ শোধ করতে পারছে না। ধীরে ধীরে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করলেও সেই দেউলিয়া রোধ করতে পারছে না। গ্রিস কিংবা ইতালি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের কথা ঘোষণা করলেও জনসাধারণ তার বিরোধিতা করছে। তারা দিনের পর দিন বিক্ষোভ মিছিল করছে। গ্রিসের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গ্রিসকে ‘উদ্ধারের’ জন্য যে ঋণ দিয়েছে, তা ছিল শর্তযুক্ত। ওই শর্ত মেনেই আবাসন করের ওপর একটি বিল পাস করেছে গ্রিসের সংসদ। পাশাপাশি কমানো হয়েছে পেনশন। কমানো হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা। গ্রিসের রাস্তায় বিক্ষোভ তাই নিত্যদিনের চিত্র। এ চিত্র আজ ইতালিতেও লক্ষ্য করা যায়। অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ইতালি ও গ্রিসের বাইরে আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। গ্রিসে ২০১০ সালে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১৩ ভাগ। আর দেশটির ঋণ পরিস্থিতি জিডিপির ১০০ ভাগকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলে গ্রিসের পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছিল যে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছিল না সরকার। এমন এক পরিস্থিতিতে আইএমএফ ও ইউরো জোনের দেশগুলো ৩ বছরের জন্য ১১০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু শর্ত হিসেবে ঘাটতি কমানোর কথা বলা হলে তা মারাÍক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আয়ারল্যান্ডে ২০০৯ সালে যেখানে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১১ ভাগ, সেখানে ২০১০ সালে তা উন্নীত হয় ৩১ ভাগে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ৮৫ বিলিয়ন ইউরোর একটি ‘উদ্ধার কর্মসূচি’ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্তুগালের পরিস্থিতি আরও খারাপ। ২০০৯ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭৬ ভাগ। আর ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৫ ভাগে। ফলে ২০১১ সালের মার্চে সেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে এবং পর্তুগালকে ঋণ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য ৭৮ মিলিয়ন ইউরো ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত জার্মানি কিংবা ফ্রান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম। এ কারণেই একক মুদ্রা হিসেবে চালু হওয়া ইউরোর ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় মুদ্রায় আবার ফিরে যেতে। বলা হচ্ছে, জাতীয় মুদ্রায় ফিরলে সমস্যার সামধান হবে। ইউরোপের স্বল্পোন্নত বা গরিব দেশগুলোর ধারণা, ইউরো চালু হওয়ার পর ইউরোপের শক্তিশালী (অর্থনেতিক দিক থেকে) ও দুর্বল দেশগুলোর মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। তাদের ধারণা, ইউরো তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। প্যাকেজ ভর্তুকি ও ঋণ দিয়েও সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। ফলে নিজ মুদ্রায় ফিরে যাওয়ার দাবি কোন কোন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে।
‘ইউরো জোন’-এর এই অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপের ঐক্যকে বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন টিকবে কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। অথচ একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একটা মডেল হিসেবে ধরা হতো। ইতিমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা ‘দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন’ গঠনের কথা শুনেছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি ‘এশীয় ইউনিয়ন’ গঠিত হতে পারে, এমন ধারণাও করেছিলেন কেউ কেউ। এখন ইউরো জোনের সংকটের ফলে নতুন করে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের (ইইসি) যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পরিণত হয়েছে। ইউরোপের ২৭টি দেশ এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইতিমধ্যে শুধু ইইউতেই যোগ দেয়নি, বরং ন্যাটোতেও যোগ দিয়েছে। ন্যাটোর এই সম্প্রসারণ নিয়েও নানা কথা রয়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মাঝে ২৪টি দেশ এখন ন্যাটোর সদস্য।
ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জš§ হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দফতর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক এবং ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এই সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন। যে যুক্তি তুলে এক সময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হল। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার ৫০তম পূর্তি উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরোর মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র তিন বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল, ইউরো সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিহ্নিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউ’র জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালে ‘ভেলভেট রেভ্যুলিউশন’ এই দেশগুলোকে সোভিয়েতনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোন দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এই দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউ’র সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও ক্রোয়েশিয়া এখনও ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারও মন্দার আশংকা বাড়ছে। সামনের বছর ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এর ফলে ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ, তা আরও বাড়বে। ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এই বিভক্তির কথা বলছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কিনা কিংবা ‘নতুন ইউরোপ’-এর স্বরূপ কী হবে, তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসবেই, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment