রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও রাজনীতির চালচিত্র


তারপরও রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে ফলপ্রসূ কোনো কিছু আশা করা ঠিক হবে না। রাষ্ট্রপতি আমাদের অভিভাবক। সংকটময় মুহূর্তে জাতি তার কাছ থেকে একটি ভূমিকা আশা করতেই পারে। সংবিধানে তার ভূমিকা সীমিত। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তিনি সরকারের পরামর্শ মতো কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু কী করতে পারবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে সরকার ও বিরোধী দেলর মাঝে একটি সমঝোতা প্রয়োজন। জাতীয় প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে, গণতন্ত্র কোনো অবস্থাতেই বিকশিত হবে না। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবেই। এই বিরোধিতা হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও সহনীয়। এই বিরোধিতা পশ্চিমা সমাজেও আছে। আমেরিকার মতো সমাজেও 'শাটডাউন' বা বন্ধ এর মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেই 'শাটডাউন' কখনই সহিংস পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয় না। এমনকি এটাও দেখা গেছে, সংগঠিত প্রতিবাদ হয় একটা সীমিত জায়গায়_ প্রতিবাদকারীরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন হতে পারে কোনো কলকারখানার সামনে) জমায়েত হয়ে হাতে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে ঘুরে ঘুরে সেস্নাগান দিয়ে প্রতিবাদ করছেন। জনজীবনকে এরা বাধাগ্রস্ত করছেন না। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবরও আমরা দেখি। কিন্তু খুব কম পর্যায়েই তা সহিংসতায় পরিণত হয়। পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া একটি গুরুতর অপরাধ পশ্চিমা বিশ্বে। পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিবাদকারীদের ওপর সরকার সমর্থকরা আক্রমণ করেছেন_ এ ধরনের কোনো খবর আমরা কোনোদিন পড়িনি। আমি নিজে দেখিনি। আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে প্রতিবাদের ভাষা আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা শুধু বারবার আমাদের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। প্রতিবাদের এই সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। আর উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। আমাদের সমস্যা অনেক। এই সমস্যা একা সরকারের পক্ষে সমাধান দেয়া সম্ভব নয়। অবশ্যই বিরোধী দলের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার তিন বছর পার করার কাছাকাছি সময়ে এসে অনেকগুলো সমস্যা মোকাবিলা করছে। এক. সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে (সরকারি ও বেসরকারি) প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। বছর শেষে এই ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার অংককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে করে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। হ্রাস পাবে প্রবৃদ্ধির হার। এটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার একটি ত্রুটি। সরকার অবশ্যই ঋণ নেবে। কিন্তু তা যেন একটা সীমার মধ্যে থাকে। কৃচ্ছ্র সাধন জরুরি। কিন্তু কৃচ্ছ্র সাধন হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় পিপিপি মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। বড় প্রকল্পগুলোতে এই মুহূর্তে হাত না দেয়াই মঙ্গল। গত ১৫ ডিসেম্বর সরকার ৬১ জেলা পরিষদে দলীয় লোকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এতে করে বিরোধিতা আরো বাড়ল। বাড়ল খরচ। বাংলাদেশে বিশ্বমন্দার প্রভাব এই মুহূর্তে আমরা অনুভব করতে পারছি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃচ্ছ্র সাধনটা জরুরি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী রফতানি আয় কমেছে শতকরা ৩৯ ভাগ, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ১১ দশমিক ৭৩ ভাগ। তিন হাজার তৈরি পোশাক কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। রেমিটেন্সের প্রবাহও কম। এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া প্রয়োজন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। দুঃখজনক হলেও সত্য, গত চলি্লশ বছরে আমরা এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। আজ সময় এসেছে এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার। বাংলাদেশে এক ধরনের অসমতা সৃষ্টি হয়েছে। এখানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে। বিজয়ের চলি্লশ বছরে দাঁড়িয়েও আমরা দেখি বাংলাদেশে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই অসমতা আর বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রে 'অকুপাই আন্দোলনের' জন্ম দিয়েছে। আরব বিশ্বে সৃষ্টি করেছে 'আরব বসন্ত'। আমরা এ থেকে যেন শিক্ষা নেই। দরিদ্রতা দূরীকরণ কিংবা অসমতা দূরীকরণে আজ প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। বিরোধী দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখবে না। 'আরব বসন্ত' সৃষ্টি করেছিল তরুণ সমাজ। আরব বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ৪০ ভাগের ওপরে হচ্ছে এই তরুণ প্রজন্ম, যারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে 'বিপ্লব'কে সংগঠিত করেছিল। বাংলাদেশে তরুণ সমাজের অংশও একেবারে কম নয়। এদের সাঝে অনেকেই বেকার। এই তরুণ সমাজ একটি শক্তি হতে পারে, যদি এদের প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। প্রথাগত শিক্ষা বাদ দিয়ে এদের যদি কর্মমুখী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, সমাজ পরিবর্তনে পালন করতে পারে এরা একটি বড় ভূমিকা। প্রায় একশ'টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর কয়েক লাখ মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরুচ্ছে। অথচ এদের জন্য চাকরি নেই। পৃথিবীর কোনো দেশে এককভাবে সরকার কর্মসংস্থান করে না। বেসরকারি উদ্যোক্তারা একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বেসরকারি সেক্টরের ভূমিকা বেড়েছে, কিন্তু সেখানে মেধার পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না। আগামী ২০ বছর সামনে রেখে আমাদের কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনশক্তি দরকার, তা আমরা জানি না। ফলে উদ্ভ্রান্তের মতো তরুণ সমাজ এমন সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, যা সমাজ বা রাষ্ট্র তাকে চাকরির নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। অথচ এই জনশক্তিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং ভাষা শিক্ষা দিয়ে বিদেশের জব মার্কেটে তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা আমরা করতে পারি। এ জন্য দরকার পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গির। বিরোধী দলের ভূমিকাও এখানে থাকা উচিত। বিরোধী দল শুধু সরকার পতনে তাদের কর্মকা- সীমাবদ্ধ রাখবে, তা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে তাদেরও একটা 'ভিশন' থাকা উচিত, পরিকল্পনা থাকা উচিত। বিরোধী দল একটি 'শ্যাডো ক্যাবিনেট' বা 'ছায়া মন্ত্রিসভা' গঠন করবে, যেখানে সরকারের মন্ত্রীর বিকল্প থাকবে বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি, যিনি সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিকল্প নীতি উপস্থাপন করবেন। প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই আমরা এই 'ছায়া মন্ত্রিসভা' (যেমন ব্রিটেনে) কাজ করতে দেখি। বাংলাদেশে বিরোধী দল একটি 'ছায়া মন্ত্রিসভা' গঠন করতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে জাতীয় ঐকমত্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, গত চলি্লশ বছরে জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনো বিভক্ত। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, একমাত্র সংসদীয় সরকারে ফিরে যাবার প্রশ্নে (পঞ্চম সংসদ, দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী) সরকার ও বিরোধী দল এক হয়েছিল। এরপর থেকে (১৯৯১) কোনো একটি ইস্যুতেও সরকার ও বিরোধী দল এক হতে পারেনি। অতি সাম্প্রতিককালে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষের শঙ্কা যখন বাড়ছে, সেখানেও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে কোনো সহাবস্থান হয়নি। অথচ টিপাইমুখের বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু। এর সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কয়েক কোটি জনগণের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত।
রাজনীতিতে এই যে অসহিষ্ণুতা, এই অসহষ্ণিুতা যদি আমরা পরিত্যাগ করতে না পারি, যদি জাতীয় ইস্যুতে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে প্রায় ষোল কোটির এই দেশটির জন্য আরো অনেক দুঃখ-কষ্ট অপেক্ষা করছে। দেশটি ৫০ বছরে পা দেবে ২০২১ সালে। ওই পঞ্চাশ বছরের একটি দেশের জন্য আমাদের পরিকল্পনা কী, কী পরিমাণ জনশক্তি আমাদের দরকার, আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই বা কী হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে কোনো সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই। সরকার এককভাবে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সংসদ হয়ে পড়ছে একদলীয়। বিরোধী দল দিনের পর দিন সংসদ বয়কট করে চলছে। তাদের সংসদে নিয়ে আসার ব্যাপারে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। সমাজের সর্বত্র বিভক্তি বাড়ছে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি সংলাপ করছেন। তবে প্রধান বিরোধী দল যদি সত্যি সত্যিই সংলাপে অংশ না নেয়, তাহলে এ সংলাপের কোনো মূল্য থাকবে না। রাষ্ট্রপতি তার অধিকার বলেই সিইসিসহ কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। ফলে ওই নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে থাকবে। এক্ষেত্রে একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে যদি আভাস দেয়া হয় যে, রাষ্ট্রপতি এজেন্ডাবহির্ভূত বিষয়েও কথা শুনবেন, তাতে অন্তত বরফ গলতে পারে। নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নে যেমনি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন, ঠিক তেমনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় আয়োজন করা যায় কি না, সে বিষয়টির ব্যাপারেও একটি ঐকমত্য প্রয়োজন। আমার ধারণা, সরকারের শরিকদের কেউ কেউ নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বউদ্যোগে সংলাপ শুরু করতে পারেন। বর্তমান সংলাপ শুধু নির্বাচন কমিশন নিয়ে হলেও, পরবর্তী ধাপে নিরপেক্ষ সরকার নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি 'সার্চ কমিটির' প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এটি ভালো। সরকার ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে এই কমিটি গঠিত হতে পারে। স্পিকার এই কমিটির আহ্বায়ক হতে পারেন। তারা কয়েকটি নাম প্রস্তাব করতে পারেন, যাদের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের বেছে নেবেন। মোট কথা, একটি সমাধান প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির এই সংলাপেও এই সিদ্ধান্তটি নেয়া যায়।

দৈনিক ডেসটিনি ২৮ ডিসেম্বর।
তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tareque.rahman(a)aol.com


0 comments:

Post a Comment