বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরের পুরোটা সময় এ দেশে গণতন্ত্র চর্চা হয়েছে তা বলা যাবে না। স্বাধীকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতার ঘোষণার পর প্রতিটি ক্ষেত্রে এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটা প্রত্যয় ছিল। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দেয়া হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য ন্যায্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা ও সাংবিধানিকভাবে তা গঠন করেছি’। এখানে দেখা যায়, স্পর্শকাতর ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। এই ঘোষণা প্রমাণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এই ধারণা আরো বদ্ধমূল হয় যখন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক সাম্য, স্পর্শকাতর ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে ...।’ যদিও বাংলাদেশের সংবিধান ইতোমধ্যে ১৫ বার সংশোধিত হয়েছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার সাথে সম্পর্কিত ধারাগুলো রয়ে গেছে। যেমন বলা যেতে পারে, সংবিধানের মূলনীতি, মহিলাদের অংশগ্রহণ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, মালিকানা, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সাম্যতা, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ কিংবা মৌলিক অধিকার, আইনসভা সম্পর্কিত যেসব অনুচ্ছেদ সংযোজিত হয়েছিল, তা যে কোনো দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ অত সহজ ছিল না। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা করায়ত্ত করার আকাক্সা, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের উচ্চভিলাষসহ রাজনীতিবিদদের আচরণ নানা কারণে এ দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে নিঃসন্দেহে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ও দ্বাদশ সংশোধনী দুটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চতুর্থ সংশোধনীতে যেখানে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়েছিল ও দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, সেখানে দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) ছিল এ ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে দ্বাদশ সংশোধনী পাস হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করতে একটি তত্ত্বাবধাযক সরকারব্যবস্থা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখা ও বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই জিনিসটির বড় অভাব বাংলাদেশে। এই আস্থাহীনতা পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু হয়েছিল, যা আজো অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে জাতি আজো বিভক্ত। সংসদ বয়কটের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল পঞ্চম সংসদ থেকে। আজো সংসদ বয়কট চলছে। বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নেয়ার জন্য একটি ডেপুটি স্পিকারের পদসহ গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের কয়েকটি পদ বিরোধী দলকে দেয়ার কথা বলা হলেও তা রক্ষিত হয়নি। ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স-এর যে স্পিরিটের কথা গণতন্ত্রে বলা আছে তা লক্ষ্য করা যায়নি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একদল ক্ষমতাসীন হয়েছে, পরে আবার ক্ষমতাসীন দলের পতন ঘটেছে। শুধুমাত্র নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর গণতন্ত্রকে উন্নত পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া যায় না। এজন্য দরকার মানসিকতা পরিবর্তনের। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আজ এ কথাটা প্রযোজ্য। গত চার দশকের রাজনীতিতে একাধিকবার বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে আমরা আরো উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক-এগার’র ঘটনা (২০০৭) একটি বিতর্কিত অধ্যায়। দু’বছর ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে সংবিধান লংঘন করে। শুধু তাই নয়, ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বিতর্কিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ব্যক্তিগতভাবে নিন্দিত হয়েছেন তার ভূমিকার জন্য। একটি অনির্বাচিত সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সংবিধানে বর্ণিত ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ধরে রেখেছেন দু’বছর পর্যন্ত, যা তাদেরকে বিতর্কিত করেছে। এমনকি তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার জন্যও তারা সমালোচিত হয়েছেন।
সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অংশ। এই বিষয়টিকে আমরা যদি বিবেচনায় নেই, তাহলে দেখা যাবে দুটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মাঝে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে বাংলাদেশে একটি দ্বি-দলীয় রাজনীতির জন্ম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এককভাবে তৃতীয় কোনো শক্তির জন্ম হয়নি, যারা জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করার ক্ষমতা রাখে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শক্তির বিকাশ ঘটেছে, যারা কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্রের একটি সৌন্দর্য। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বজায় রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কথা বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় শক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। যুক্তরাজ্যে আছে বটে, কিন্তু তাদের একার পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। জার্মানিতেও এই তৃতীয় ও চতুর্থ শক্তি রয়েছে, যারা কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার। এই তৃতীয় তথা চতুর্থ শক্তির উপস্থিতি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরো শক্তিশালী করেছে মাত্র। বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে দু’টি প্রধান দলের মাঝে ক্ষমতা পরিবর্তিত হলেও অপর দুটি দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রয়োজনীয়তাকে অপরিহার্য করে তুলেছে। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (২৯২ আসন ও ৭৩ দশমিক ২০ ভাগ ভোট)। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। স্বতন্ত্র সদস্যরা ৪টি আসন পেয়েছিল (৫.২৫ ভাগ ভোট)। কিন্তু ন্যাপ (মো.) ১টি আসন পেলেও শতকরা ভোট পেয়েছিল ৮.৩৩ ভাগ। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ২০৭ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (৪১.১৭ ভাগ ভোট)। আওয়ামী লীগ (মালেক ও মিজান গ্রুপ) পেয়েছিল ৪১টি আসন (৩৯+২), আর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২৪.৫৬ ও ২.৭৮ ভাগ। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ ঐক্য করে পেয়েছিল ২০টি আসন (১০.০৭ ভাগ ভোট) জাসদ পেয়েছিল ৮টি আসন। মজার ব্যাপার আজকের মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত একতা পার্টির ব্যানারে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন। জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ও তথাকথিত নির্বাচনে (১৯৮৬ ও ১৯৮৮) বিজয়ী হলেও ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। অনিশ্চিত ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়ে পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬.১৬ ভাগ ভোট)। গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রাপথ শুরু হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) মধ্য দিয়ে। ওই নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪১টি সিট (৩০.৮১ ভাগ ভোট), আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮৮টি সিট (৩০.০৮ ভাগ ভোট)। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ৩৫টি (১১.৯২ শতাংশ) ও জামায়াতে ইসলামী ১৮ (১২.১৩ শতাংশ) আসন পেয়েছিল। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) এই দৃশ্যপট বদলে যায়। আওয়ামী লীগ (৩৭.৪৪ শতাংশ) ১৪৬টি আসন ও বিএনপি ১১৬ (৩৩.৬১)টি আসন পাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল। পঞ্চম সংসদেও বিএনপি একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। সপ্তম সংসদে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা প্রায় এক থাকে (৩২ আসন, ১৬.৩৯ ভাগ ভোট)। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর আসন কমে এসে দাঁড়ায় ৩-এ (৮.৬১ ভাগ ভোট) অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০১) আবার দৃশ্যপট বদলে যায়। চারদলীয় জোট বিএনপি ১৯৩ আসন (৪০.৯৭ ভাগ ভোট) ও জামায়াতে ইসলামী ১৭ আসনে (৪.১৮ ভাগ ভোট) বিজয়ী হয়। জোটগতভাবে চারদলের আসন ছিল ২১৬, আর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৪৭ ভাগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসন পেলেও তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪০.১৩ ভাগ। আর জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ১৪টি আসন (৭.২৫ ভাগ ভোট)। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আবার দৃশ্যপট বদলে যায়। আওয়ামী লীগ ২৩১টি আসনে বিজয়ী হয় (৪৮.০৬ ভাগ ভোট)। আর বিএনপি’র ভাগ্যে জোটে ৩০টি আসন (৩২.৪৫ ভাগ ভোট)। জাতীয় পার্টি ২৬টি আসন (৭.০৫ ভাগ ভোট), জামায়াতে ইসলামী ২টি আসন ৪.৬০ ভাগ ভোট), বিজেপি ১, জাসদ ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, এলডিপি ১ আসন পেয়ে তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে মজার ব্যাপার জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা বিজয়ী হয়েছেন তাদের নিজস্ব ‘মার্কা’ নিয়ে নয়, বরং ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে। আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য করেই তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এই নির্বাচনী ফলাফল প্রমাণ করে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’টি বড় শক্তি। এই দু’টি দলকে বাদ দিয়ে এ দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। সেই সাথে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে তাদের সংসদীয় ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর ইসলামী চিন্তা-চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপির নেতৃত্বে চারদল এই ধারায় আগামীতে ইসলামিক শক্তিগুলো একত্রিত হতে পারে। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিনিধিত্ব করে আওয়ামী লীগ। বাংাদেশে বামধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সংগঠিত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখবে। এই দু’টি ধারার বাইরে তৃতীয় একটি ধারার জন্ম ও বিকাশের সম্ভাবনা তেমন একটি নেই। বাংলাদেশের চার দশকের রাজনীতিতে আমাদের প্রাপ্তি এটাই যে, এখানে একটি সংসদীয় রাজনীতির সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। দু’টি প্রধান দলকে কেন্দ্র করেই এই সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ একটি কোয়ালিশন রাজনীতির যুগে প্রবেশ করেছে। দু’টি প্রধান দল এখন এবং আগামীতে তাদের শরিকদের উপর নির্ভরশীল থাকবে। দু’টি প্রধান দলেরই টার্গেট হচ্ছে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের সমন্বয়ে এই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলছে। অন্যদিকে বিএনপি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তথা ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দু’টি ধারা আগামীদিনের রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখা ও বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই জিনিসটির বড় অভাব বাংলাদেশে। এই আস্থাহীনতা পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু হয়েছিল, যা আজো অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে জাতি আজো বিভক্ত। সংসদ বয়কটের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল পঞ্চম সংসদ থেকে। আজো সংসদ বয়কট চলছে। বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নেয়ার জন্য একটি ডেপুটি স্পিকারের পদসহ গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের কয়েকটি পদ বিরোধী দলকে দেয়ার কথা বলা হলেও তা রক্ষিত হয়নি। ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স-এর যে স্পিরিটের কথা গণতন্ত্রে বলা আছে তা লক্ষ্য করা যায়নি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একদল ক্ষমতাসীন হয়েছে, পরে আবার ক্ষমতাসীন দলের পতন ঘটেছে। শুধুমাত্র নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর গণতন্ত্রকে উন্নত পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া যায় না। এজন্য দরকার মানসিকতা পরিবর্তনের। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আজ এ কথাটা প্রযোজ্য। গত চার দশকের রাজনীতিতে একাধিকবার বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে আমরা আরো উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক-এগার’র ঘটনা (২০০৭) একটি বিতর্কিত অধ্যায়। দু’বছর ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে সংবিধান লংঘন করে। শুধু তাই নয়, ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বিতর্কিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ব্যক্তিগতভাবে নিন্দিত হয়েছেন তার ভূমিকার জন্য। একটি অনির্বাচিত সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সংবিধানে বর্ণিত ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ধরে রেখেছেন দু’বছর পর্যন্ত, যা তাদেরকে বিতর্কিত করেছে। এমনকি তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার জন্যও তারা সমালোচিত হয়েছেন।
সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অংশ। এই বিষয়টিকে আমরা যদি বিবেচনায় নেই, তাহলে দেখা যাবে দুটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মাঝে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে বাংলাদেশে একটি দ্বি-দলীয় রাজনীতির জন্ম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এককভাবে তৃতীয় কোনো শক্তির জন্ম হয়নি, যারা জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করার ক্ষমতা রাখে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শক্তির বিকাশ ঘটেছে, যারা কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্রের একটি সৌন্দর্য। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বজায় রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কথা বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় শক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। যুক্তরাজ্যে আছে বটে, কিন্তু তাদের একার পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। জার্মানিতেও এই তৃতীয় ও চতুর্থ শক্তি রয়েছে, যারা কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার। এই তৃতীয় তথা চতুর্থ শক্তির উপস্থিতি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরো শক্তিশালী করেছে মাত্র। বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে দু’টি প্রধান দলের মাঝে ক্ষমতা পরিবর্তিত হলেও অপর দুটি দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রয়োজনীয়তাকে অপরিহার্য করে তুলেছে। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (২৯২ আসন ও ৭৩ দশমিক ২০ ভাগ ভোট)। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। স্বতন্ত্র সদস্যরা ৪টি আসন পেয়েছিল (৫.২৫ ভাগ ভোট)। কিন্তু ন্যাপ (মো.) ১টি আসন পেলেও শতকরা ভোট পেয়েছিল ৮.৩৩ ভাগ। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ২০৭ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (৪১.১৭ ভাগ ভোট)। আওয়ামী লীগ (মালেক ও মিজান গ্রুপ) পেয়েছিল ৪১টি আসন (৩৯+২), আর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২৪.৫৬ ও ২.৭৮ ভাগ। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ ঐক্য করে পেয়েছিল ২০টি আসন (১০.০৭ ভাগ ভোট) জাসদ পেয়েছিল ৮টি আসন। মজার ব্যাপার আজকের মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত একতা পার্টির ব্যানারে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন। জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ও তথাকথিত নির্বাচনে (১৯৮৬ ও ১৯৮৮) বিজয়ী হলেও ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। অনিশ্চিত ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়ে পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬.১৬ ভাগ ভোট)। গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রাপথ শুরু হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) মধ্য দিয়ে। ওই নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪১টি সিট (৩০.৮১ ভাগ ভোট), আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮৮টি সিট (৩০.০৮ ভাগ ভোট)। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ৩৫টি (১১.৯২ শতাংশ) ও জামায়াতে ইসলামী ১৮ (১২.১৩ শতাংশ) আসন পেয়েছিল। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) এই দৃশ্যপট বদলে যায়। আওয়ামী লীগ (৩৭.৪৪ শতাংশ) ১৪৬টি আসন ও বিএনপি ১১৬ (৩৩.৬১)টি আসন পাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল। পঞ্চম সংসদেও বিএনপি একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। সপ্তম সংসদে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা প্রায় এক থাকে (৩২ আসন, ১৬.৩৯ ভাগ ভোট)। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর আসন কমে এসে দাঁড়ায় ৩-এ (৮.৬১ ভাগ ভোট) অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০১) আবার দৃশ্যপট বদলে যায়। চারদলীয় জোট বিএনপি ১৯৩ আসন (৪০.৯৭ ভাগ ভোট) ও জামায়াতে ইসলামী ১৭ আসনে (৪.১৮ ভাগ ভোট) বিজয়ী হয়। জোটগতভাবে চারদলের আসন ছিল ২১৬, আর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৪৭ ভাগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসন পেলেও তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪০.১৩ ভাগ। আর জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ১৪টি আসন (৭.২৫ ভাগ ভোট)। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আবার দৃশ্যপট বদলে যায়। আওয়ামী লীগ ২৩১টি আসনে বিজয়ী হয় (৪৮.০৬ ভাগ ভোট)। আর বিএনপি’র ভাগ্যে জোটে ৩০টি আসন (৩২.৪৫ ভাগ ভোট)। জাতীয় পার্টি ২৬টি আসন (৭.০৫ ভাগ ভোট), জামায়াতে ইসলামী ২টি আসন ৪.৬০ ভাগ ভোট), বিজেপি ১, জাসদ ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, এলডিপি ১ আসন পেয়ে তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে মজার ব্যাপার জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা বিজয়ী হয়েছেন তাদের নিজস্ব ‘মার্কা’ নিয়ে নয়, বরং ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে। আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য করেই তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এই নির্বাচনী ফলাফল প্রমাণ করে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’টি বড় শক্তি। এই দু’টি দলকে বাদ দিয়ে এ দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। সেই সাথে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে তাদের সংসদীয় ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর ইসলামী চিন্তা-চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপির নেতৃত্বে চারদল এই ধারায় আগামীতে ইসলামিক শক্তিগুলো একত্রিত হতে পারে। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিনিধিত্ব করে আওয়ামী লীগ। বাংাদেশে বামধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সংগঠিত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখবে। এই দু’টি ধারার বাইরে তৃতীয় একটি ধারার জন্ম ও বিকাশের সম্ভাবনা তেমন একটি নেই। বাংলাদেশের চার দশকের রাজনীতিতে আমাদের প্রাপ্তি এটাই যে, এখানে একটি সংসদীয় রাজনীতির সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। দু’টি প্রধান দলকে কেন্দ্র করেই এই সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ একটি কোয়ালিশন রাজনীতির যুগে প্রবেশ করেছে। দু’টি প্রধান দল এখন এবং আগামীতে তাদের শরিকদের উপর নির্ভরশীল থাকবে। দু’টি প্রধান দলেরই টার্গেট হচ্ছে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের সমন্বয়ে এই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলছে। অন্যদিকে বিএনপি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তথা ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দু’টি ধারা আগামীদিনের রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
0 comments:
Post a Comment