রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কতদূর এগোতে পেরেছি আমরা?

বিজয় দিবসের ৪০ বছরে এসে যে প্রশ্নটি আমাদের কাছে আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কতদূর এগোতে পেরেছি আমরা? একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতার বীর যোদ্ধারা, যাঁদের আহ্বানে হাজার হাজার মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের প্রস্তাবনায়ও বলা হয়েছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু আমাদের সেই প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছে? গত ৪০ বছরে কত সরকারই তো এল গেল। কত ধরনের সরকার পদ্ধতিই না আমরা দেখলাম। গণতান্ত্রিক, রাষ্ট্রপতি শাসিত, একদলীয়, সামরিক একনায়কতান্ত্রিক, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা_কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কতটুকু আমরা বিনির্মাণ করতে পেরেছি? সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে বারবার। সর্বশেষ পনেরতম সংশোধনীও সংসদ গ্রহণ করেছে। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। অথচ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আমরা হরতাল পর্যন্ত করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবক্তা। তখন বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সেদিন জাতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা সমর্থন করেছিল। আর আজকের বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে (১৯৯৬) এ দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। পর পর তিনটি_সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোয় অনুষ্ঠিত হলেও এখন আর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোয় অনুষ্ঠিত হবে না। অনুষ্ঠিত হবে দলীয় সরকারের কাঠামোয়। মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে সংবিধান নিয়ে আমাদের 'পরীক্ষা-নিরীক্ষা' পরিত্যক্ত হলো। একই বৃত্তে আমরা ঘুরছি বারবার। জাতীয় পর্যায়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কয়েক বছর পর তা আবার বাতিল ঘোষণা করা হচ্ছে। ৪০ বছরে কোনো জাতীয় ইস্যুতে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীও (১৫তম) পাস হলো এককভাবে। তবে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) ছিল এ ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে দ্বাদশ সংশোধনী পাস হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বহাল ছিল। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার আওতায় ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে প্রথম দুটিতে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদে তৎকালীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন বিএনপির মধ্যে সংসদীয় ধারায় ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে ঐক্য হয়েছিল। বিএনপি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার সমর্থক থাকলেও ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী সমর্থন করেছিল। এরপর আর কোনো ইস্যুতে এই দুটি বড় দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভক্তির প্রশ্নেও কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখা ও বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই জিনিসটির বড় অভাব বাংলাদেশে। এই আস্থাহীনতা পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু হয়েছিল, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে জাতি আজও বিভক্ত। সংসদ বয়কটের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল পঞ্চম সংসদ থেকে। আজও সংসদ বয়কট চলছে। বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নেওয়ার জন্য একটি ডেপুটি স্পিকারের পদসহ গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের কয়েকটি পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার কথা বলা হলেও তা রক্ষিত হয়নি। 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারর্স'-এর যে স্পিরিটের কথা গণতন্ত্রে বলা আছে, তা লক্ষ করা যায়নি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একদল ক্ষমতাসীন হয়েছে, পরে আবার ক্ষমতাসীন দলের পতন ঘটেছে। শুধু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর গণতন্ত্রকে উন্নত পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া যায় না। এ জন্য দরকার মানসিকতা পরিবর্তনের। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আজ কথাটা প্রযোজ্য। গত চার দশকের রাজনীতিতে একাধিকবার বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে আমরা আরো উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক-এগারোর ঘটনা (২০০৭) একটি বিতর্কিত অধ্যায়। দুই বছর ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে সংবিধান লঙ্ঘন করে। শুধু তা-ই নয়, ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বিতর্কিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ব্যক্তিগতভাবে নিন্দিত হয়েছেন তাঁর ভূমিকার জন্য। একটি অনির্বাচিত সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সংবিধানে বর্ণিত ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ক্ষমতা ধরে রেখেছে দুই বছর পর্যন্ত, যা তাদের বিতর্কিত করেছে। এমনকি তথাকথিত 'মাইনাস টু' ফর্মুলার জন্যও তারা সমালোচিত হয়েছে।
সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অংশ। বিষয়টি আমরা যদি বিবেচনায় নিই, তাহলে দেখা যাবে যে দুটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে একটি দ্বি-দলীয় রাজনীতির জন্ম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এককভাবে তৃতীয় কোনো শক্তির জন্ম হয়নি, যারা জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করার ক্ষমতা রাখে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শক্তির বিকাশ ঘটেছে, যারা কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্রের একটি সৌন্দর্য। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বজায় রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কথা বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় শক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। যুক্তরাজ্যে আছে বটে, কিন্তু তাদের একার পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়।
জার্মানিতেও ওই তৃতীয় ও চতুর্থ শক্তি রয়েছে, যারা কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার। এই তৃতীয় তথা চতুর্থ শক্তির উপস্থিতি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী করেছে মাত্র। বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে দুটি প্রধান দলের মধ্যে ক্ষমতা পরিবর্তিত হলেও অপর দুটি দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। সংসদের ইতিহাস সে কথাই বলে। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (২৯২ আসন ও ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ ভোট)। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এ বিজয় কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। স্বতন্ত্র সদস্যরা চারটি আসন পেয়েছিলেন (৫.২৫ শতাংশ ভোট)। কিন্তু ন্যাপ (মোজাফফর) একটি আসন পেলেও ভোট পেয়েছিল ৮.৩৩ শতাংশ। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ২০৭ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (৪১.১৭ শতাংশ ভোট)। আওয়ামী লীগ (মালেক ও মিজান গ্রুপ) পেয়েছিল ৪১টি আসন (৩৯+২), আর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২৪.৫৬ ও ২.৭৮ শতাংশ। ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ ঐক্য করে পেয়েছিল ২০টি আসন (১০.০৭ শতাংশ ভোট)। জাসদ পেয়েছিল আটটি আসন। মজার ব্যাপার হলো, আজকের মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একতা পার্টির ব্যানারে নির্বাচন করে তখন বিজয়ী হয়েছিলেন। জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ও তথাকথিত নির্বাচনে (১৯৮৬ ও ১৯৮৮) বিজয়ী হলেও ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। অবশ্য ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়ে পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬.১৬ শতাংশ ভোট)। গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রাপথ শুরু হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) মধ্য দিয়ে। ওই নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪১টি আসন (৩০.৮১ শতাংশ ভোট) আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮৮টি আসন (৩০.০৮ শতাংশ) ভোট। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ৩৫টি (১১.৯২ শতাংশ) ও জামায়াতে ইসলামী ১৮টি (১২.১৩ শতাংশ) আসন পেয়েছিল। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) এই দৃশ্যপট বদলে যায়। আওয়ামী লীগ (৩৭.৪৪ শতাংশ) ১৪৬টি আসন ও বিএনপি ১১৬টি (৩৩.৬২ শতাংশ) আসন পাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল। পঞ্চম সংসদেও বিএনপি একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। সপ্তম সংসদে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা প্রায় এক থাকে (৩২ আসন, ১৬.৩৯ শতাংশ ভোট)। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর আসন কমে এসে দাঁড়ায় ৩-এ (৮.৬১ শতাংশ ভোট)। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০১) আবার দৃশ্যপট বদলে যায়। চারদলীয় জোটে বিএনপি ১৯৩ আসন (৪০.৯৭ শতাংশ ভোট) ও জামায়াতে ইসলামী ১৭ আসনে (৪.১৮ শতাংশ ভোট) বিজয়ী হয়। জোটগতভাবে চার দলের আসন ছিল ২১৬, আর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৪৭ শতাংশ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসন পেলেও তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪০.১৩ শতাংশ, আর জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ১৪টি আসন (৭.২৫ শতাংশ ভোট)। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার দৃশ্যপট বদলে যায়। আওয়ামী লীগ ২৩১টি আসনে বিজয়ী হয় (৪৮.০৬ শতাংশ ভোট)। আর বিএনপির ভাগ্যে জোটে ৩০টি আসন (৩২.৪৫ শতাংশ ভোট)। জাতীয় পার্টি ২৬টি আসনে (৭.০৫ শতাংশ ভোট), জামায়াতে ইসলামী দুটি আসন (৪.৬০ শতাংশ ভোট), বিজেপি এক, জাসদ তিন, ওয়ার্কার্স পার্টি দুই, এলডিপি এক আসন পেয়ে তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা স্পষ্ট হয়েছে। ইসলামপন্থীরা ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা এক শিবিরে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা অপর শিবিরে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি তত্ত্বগতভাবে প্রথম পক্ষে থাকার কথা। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারায় থাকার কারণ একটাই_আর তা হচ্ছে ব্যক্তি এরশাদের একটি ভূমিকা ও সুবিধাবাদিতা। এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশ যদি আগামীতে বিএনপিতে বিলীন হয়ে যায় অথবা একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলে, আমি অবাক হব না।
বিজয়ের ৪০ বছরে এসে আজ তাই হিসাব-নিকাশের পালা। বিগত ৪০ বছরে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। সংবিধান মূল ধারায় ফিরে এসেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি আগের চেয়ে এখন আরো আগ্রহ বেড়েছে। অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। সাংবিধানিক শাসন এখন দৃঢ়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু যা হয়নি, তা হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য। জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনো বিভক্ত। টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু আবারও প্রমাণ করল, রাজনৈতিক বিবেচনা যেখানে মুখ্য, জাতীয় ইস্যু সেখানে গৌণ। এই বিভক্তি জাতি গঠনে প্রধান অন্তরায়। সংসদীয় রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে সত্য, কিন্তু এই রাজনীতি হয়ে পড়েছে দলীয়। সমাজের সর্বক্ষেত্রে দলীয় কর্তৃত্ব আজ বেশি। এই দলীয় কর্তৃত্ব আজ জাতিকে একটা মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত করেছে। পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা আজ বেশি। এই আস্থাহীনতা সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের উপহার দিতে পারেননি। আমাদের অনেক অর্জন এই ব্যর্থতার কাছে ম্লান হয়ে গেছে। এই ক্ষুদ্র মানসিকতা যদি আমরা পরিত্যাগ করতে না পারি, গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। বিজয়ের ৪০ বছরে এই হোক আমাদের ভাবনা।
দৈনিক কালের কন্ঠ. ১৬ ই ডিসেম্বর ২০১১।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment