একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের লক্ষ্যে সারা আরব বিশ্বে যে গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছে এবং যাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে, তার ঢেউ কী বাংলাদেশে এসে লাগবে? বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের সংলাপের আহ্বান এবং এ ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতার পর এ প্রশ্নটি এখন বড় বেশি আলোচিত ‘বাংলা বসন্ত’ কী এখন দারপ্রান্তে? ইতোমধ্যে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের নেতৃত্বে যে রোডমার্চ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, তার মধ্যে দিয়ে মূলত ‘বাংলা বসন্ত’ এর আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আগামী ২৬ ও ২৭ নভেম্বর বিরোধী জোট খুলনায় তৃতীয় রোডমার্চ করবে। আর চতুর্থ রোডমার্চ হবে চট্টগ্রামে। ফলে ২০১২ সাল বাংলাদেশের জন্য যে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সারা বিশ্ব এখন দু’দুটো আন্দোলনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখছে। প্রথমটি ‘আরব বসন্ত’ আর দ্বিতীয়টি ‘অকুপাই মুভমেন্ট’। এই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ শুরু হয়েছিল নিউইয়র্কে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ থেকে, যা ছড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের এক শহর থেকে অন্য শহরে এবং ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর উদ্দেশ্য একটাইÑ অসক্ষমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ, যা কী-না এখন পরিণত হয়েছে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনে। এই আন্দোলনের সাথে ‘আরব বসন্ত’-এর আন্দোলনের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, এটা সত্য, কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়Ñ আর তা হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ আর সেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন সাধারণ মানুষ। আজ নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কে যারা সমাবেশ করেছেন এবং দীর্ঘ প্রায় ৬০ দিন প্রচণ্ড শীতে অবস্থান করে আসছিলেন তাঁবু বিছিয়ে, তাদের সাথে সিরিয়ার কিংবা ইয়েমেনে যারা আন্দোলন করে আসছেন তাদের সামাজিক অবস্থানের একটা মিল রয়েছে। এরা সবাই সাধারণ মানুষ। এরা অবহেলিত, নিষ্পেষিত এবং শোষিত। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটেছে আরব বিশ্বে আর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র। আর এটাই হচ্ছে এই দু’ধরনের আন্দোলনের মাঝে মিল।
‘আরব বসন্ত’ ইতোমধ্যে আরব বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কম্পিউটার গ্রাজুয়েট, কিন্তু ফল বিক্রি করে জীবন ধারণ করতেন সিদি বওজিদ (তিউনিসিয়া) শহরের মোহাম্মদ কওকুজিজি। পুলিশ অত্যাচারের প্রতিবাদ করে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে তিউনিশিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’-এর তিনি সূচনা করেছিলেন ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। ওই বিপ্লবে উৎখাত হয়েছিলেন ২৩ বছরের শাসক বেন আলী। এরপর উৎখাত হলেন মিসরের হোসনি মোবারক, যিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮১ সাল থেকে। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতাসীন ১৯৭৮ সাল থেকে। তিনি এখনও নামে ক্ষমতায় আছেন বটে। কিন্তু কার্যত তার কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া তিনি শুরু করে দিয়েছেন। সিরিয়ায় বাসার আল আসাদ ক্ষমতায় ২০০০ সাল থেকে, পিতার মৃত্যুর পর। আর লিবিয়ায় দীর্ঘ ৪১ বছরের গাদ্দাফির শাসনের অবসান হয়েছে একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ‘আরব বসন্ত’ পরিবর্তন আনছে আরব বিশ্বে। জর্ডান ও মরক্কোতেও সংস্কার আনা হচ্ছে। পরিবর্তন এখানে অবশ্যম্ভাবী। এর ঢেউ কী লাগবে বাংলাদেশে?
বাংলাদেশের সাথে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য রয়েছে সত্য, কিন্তু যেসব কারণে সেখানে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটা মিল রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতা ধরে রাখার প্রবণতা। আরব বিশ্বের নেতারা তাদের নিজ নিজ দেশে কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলেননি। কিন্তু তারা ক্ষমতা ধরে রেখেছেন, অনেকটা পারিবারিকভাবে, যুগের পর যুগ। বাংলাদেশে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। এখানে ১৯৯১ সালের পর থেকেই গণতান্ত্রিকভাবেই সরকার পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই ধারায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। সরকার তার ‘ব্রুট মেজরিটির’ সুযোগ নিয়ে এককভাবে সংবিধানে পরিবর্তন এনেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষণা করেছেন। সরকারের একদলীয় মনোভাব সংসদকে অকার্যকর করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের মতো ব্যক্তির যখন ঢাকায় এসে সরকার ও বিরোধীদলের মাঝে একটি সংলাপের কথা বলেন, তখন সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। সরকার সংলাপের ব্যাপারে আদৌ উৎসাহী নয়। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কারÑ দলীয়ভাবে নির্বাচন করা ক্ষমতা ধরে রাখা। সরকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চরমভাবে ব্যর্থ। দুর্নীতি আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচিত। যে কারণে কোনো কোনো প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়ন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে (পদ্মা সেতু)। জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। সরকার বিদেশি প্রভুদের স্বার্থে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে (করিডোর বা ট্রানজিট)। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি আরব বিশ্বের পরিস্থিতির কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। যে পরিস্থিতি আরব বিশ্বে ‘আরব বসন্ত’-এর জন্ম দিয়েছিল। সেই একই ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে বর্তমান, যা কী-না ‘বাংলা বসন্ত’-এর জন্ম দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আজকে যে পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে, তাতে করে একটা বড় ধরনের গণঅভ্যুত্থানের আশঙ্কা অমূলক নয়। সরকার জনস্বার্থ বিরোধী একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফা বাড়ানোর পর আবারো নতুন করে বাড়ানো হচ্ছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। পরিবহন খরচ এতে বেড়ে গেছে, যা গিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। সরকার এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানোর কথা বললেও, অন্যান্য সেক্টরে যেখানে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি, সেসব খাত থেকে ভর্তুকি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। গত সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী রফতানিতে আয় কমেছে ৩৯ ভাগ। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই ঘাটতির পরিমাণ ১৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সরকার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে। ১ নভেম্বর পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫১ কোটি টাকা। দৈনিক হিসেবে এই ঋণের পরিমাণ ১৩৩ কোটি টাকা। নতুন নোট ছেপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। বছরের শেষে এই ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৩ হাজার তৈরি পোশাক কারখানা। ফলে বেকার হয়েছে অনেক মহিলা, যাদের অনেকের ওপর নির্ভর করতো এক একটি পরিবার। এই গার্মেন্টস কন্যার অনেকেই এখন আর গ্রামে ফিরে যাবে না। গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্র এরাই তৈরি করতে পারে। অসমতা বৈষম্য আর দারিদ্র্য ‘অকুপাই মুভমেন্টের’ জন্ম দিয়েছিল। ‘আরব বসন্ত’-এর প্রভাব পড়েছিল। এই দারিদ্র্য (জনগোষ্ঠীর ৫৬ ভাগ এখন বাংলাদেশে দরিদ্র), চলমান আন্দোলনকে আরো উসকে দিতে পারে। তৃতীয়ত, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস ‘আরব বসন্ত’-এর একটা বড় কারণ। এটা বাংলাদেশেও লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি শতকরা ১১ দশমিক ৭৩ ভাগ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে। প্রতিবাদ করেছে সরকারের অদক্ষতার ও দুর্নীতির। চতুর্থত, গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধীদলের মাঝে একটা সমঝোতার কথা বলে। আরব বিশ্বে কোথাও এই সমঝোতা ছিল না। ফলে বিরোধী পক্ষ ‘আরব বসন্ত’-এর সূচনা করেছে। আন্দোলন যখন প্রাথমিক পর্যায়ে তখন বেন আলী (তিউনিসিয়া), হোসনি মোবারক (মিসর), আলী আবদুল্লা সালেহ (ইয়েমেন), গাদ্দাফি (লিবিয়া) কিংবা বাসার (সিরিয়া) কখনো উদ্যোগ নেয়নি বিরোধী পক্ষের সাথে কথা বলার। বরং অস্ত্রের ভাষায় বিরোধী পক্ষের সাথে তারা কথা বলেছেন। এক সময় পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশেও এ রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। বিরোধীদলের সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না সরকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তখন সরকারের করার কিছুই থাকবে না। তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। পঞ্চমত, ‘আরব বসন্ত’ শুরু করেছে তরুণ সমাজ। মিসরের কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে দিনের পর দিন অবস্থান করে যারা গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তারা তরুণ। যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। ওরা সামাজিক নেটওয়ার্ক টুইটারের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিল সর্বত্র। এদের অনেকেই ছিলেন বেকার। কওকুজিজির (তিউনিসিয়া) মতো মিসরেও জনৈক ব্যক্তি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, তিনিও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং বেকার। ইয়েমেনে সরকার বিরোধী আন্দোলনে যিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং যে জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে (তাওয়াক্কুল কারমা), তিনিও তারুণ্যের প্রতীক। আর মিসরে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল অঢ়ৎরষ ৬ গড়াবসবহঃ, যা চূড়ান্ত বিচারে মোবারক সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। বাংলাদেশে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ বেকার। সরকারদলীয় অঙ্গ-সংগঠনগুলোর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত না থাকায়, তারা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সরকারি চাকরি এখন দলীয় বিবেচনায় দেয়া হচ্ছে। এই তরুণ প্রজন্ম সামাজিক নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ডে জড়িত। ‘আরব বিপ্লবে’ এরা অনুপ্রাণিত হতে পারে। মোটকথা আরব বিশ্বের বিরাজমান পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটা মিল আমরা লক্ষ্য করি। বিরোধীদল এখন আরো বেশি তৎপর ও সক্রিয়। দুর্নীতি আজ চরম পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার আজ চরমভাবে ব্যর্থ। এমনি এক পরিস্থিতিতে ‘আরব বসন্ত’-এর মতো ‘বাংলা বসন্ত’ আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়ছে। ‘আরব বসন্ত’-এর মতো ‘বাংলা বসন্ত’ যে বাংলাদেশে একটি পরিবর্তন ডেকে আনবে, তা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,সারা বিশ্ব এখন দু’দুটো আন্দোলনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখছে। প্রথমটি ‘আরব বসন্ত’ আর দ্বিতীয়টি ‘অকুপাই মুভমেন্ট’। এই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ শুরু হয়েছিল নিউইয়র্কে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ থেকে, যা ছড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের এক শহর থেকে অন্য শহরে এবং ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর উদ্দেশ্য একটাইÑ অসক্ষমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ, যা কী-না এখন পরিণত হয়েছে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনে। এই আন্দোলনের সাথে ‘আরব বসন্ত’-এর আন্দোলনের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, এটা সত্য, কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়Ñ আর তা হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ আর সেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন সাধারণ মানুষ। আজ নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কে যারা সমাবেশ করেছেন এবং দীর্ঘ প্রায় ৬০ দিন প্রচণ্ড শীতে অবস্থান করে আসছিলেন তাঁবু বিছিয়ে, তাদের সাথে সিরিয়ার কিংবা ইয়েমেনে যারা আন্দোলন করে আসছেন তাদের সামাজিক অবস্থানের একটা মিল রয়েছে। এরা সবাই সাধারণ মানুষ। এরা অবহেলিত, নিষ্পেষিত এবং শোষিত। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটেছে আরব বিশ্বে আর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র। আর এটাই হচ্ছে এই দু’ধরনের আন্দোলনের মাঝে মিল।
‘আরব বসন্ত’ ইতোমধ্যে আরব বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কম্পিউটার গ্রাজুয়েট, কিন্তু ফল বিক্রি করে জীবন ধারণ করতেন সিদি বওজিদ (তিউনিসিয়া) শহরের মোহাম্মদ কওকুজিজি। পুলিশ অত্যাচারের প্রতিবাদ করে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে তিউনিশিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’-এর তিনি সূচনা করেছিলেন ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। ওই বিপ্লবে উৎখাত হয়েছিলেন ২৩ বছরের শাসক বেন আলী। এরপর উৎখাত হলেন মিসরের হোসনি মোবারক, যিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮১ সাল থেকে। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতাসীন ১৯৭৮ সাল থেকে। তিনি এখনও নামে ক্ষমতায় আছেন বটে। কিন্তু কার্যত তার কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া তিনি শুরু করে দিয়েছেন। সিরিয়ায় বাসার আল আসাদ ক্ষমতায় ২০০০ সাল থেকে, পিতার মৃত্যুর পর। আর লিবিয়ায় দীর্ঘ ৪১ বছরের গাদ্দাফির শাসনের অবসান হয়েছে একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ‘আরব বসন্ত’ পরিবর্তন আনছে আরব বিশ্বে। জর্ডান ও মরক্কোতেও সংস্কার আনা হচ্ছে। পরিবর্তন এখানে অবশ্যম্ভাবী। এর ঢেউ কী লাগবে বাংলাদেশে?
বাংলাদেশের সাথে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য রয়েছে সত্য, কিন্তু যেসব কারণে সেখানে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটা মিল রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতা ধরে রাখার প্রবণতা। আরব বিশ্বের নেতারা তাদের নিজ নিজ দেশে কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলেননি। কিন্তু তারা ক্ষমতা ধরে রেখেছেন, অনেকটা পারিবারিকভাবে, যুগের পর যুগ। বাংলাদেশে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। এখানে ১৯৯১ সালের পর থেকেই গণতান্ত্রিকভাবেই সরকার পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই ধারায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। সরকার তার ‘ব্রুট মেজরিটির’ সুযোগ নিয়ে এককভাবে সংবিধানে পরিবর্তন এনেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষণা করেছেন। সরকারের একদলীয় মনোভাব সংসদকে অকার্যকর করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের মতো ব্যক্তির যখন ঢাকায় এসে সরকার ও বিরোধীদলের মাঝে একটি সংলাপের কথা বলেন, তখন সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। সরকার সংলাপের ব্যাপারে আদৌ উৎসাহী নয়। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কারÑ দলীয়ভাবে নির্বাচন করা ক্ষমতা ধরে রাখা। সরকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চরমভাবে ব্যর্থ। দুর্নীতি আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচিত। যে কারণে কোনো কোনো প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়ন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে (পদ্মা সেতু)। জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। সরকার বিদেশি প্রভুদের স্বার্থে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে (করিডোর বা ট্রানজিট)। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি আরব বিশ্বের পরিস্থিতির কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। যে পরিস্থিতি আরব বিশ্বে ‘আরব বসন্ত’-এর জন্ম দিয়েছিল। সেই একই ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে বর্তমান, যা কী-না ‘বাংলা বসন্ত’-এর জন্ম দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আজকে যে পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে, তাতে করে একটা বড় ধরনের গণঅভ্যুত্থানের আশঙ্কা অমূলক নয়। সরকার জনস্বার্থ বিরোধী একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফা বাড়ানোর পর আবারো নতুন করে বাড়ানো হচ্ছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। পরিবহন খরচ এতে বেড়ে গেছে, যা গিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। সরকার এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানোর কথা বললেও, অন্যান্য সেক্টরে যেখানে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি, সেসব খাত থেকে ভর্তুকি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। গত সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী রফতানিতে আয় কমেছে ৩৯ ভাগ। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই ঘাটতির পরিমাণ ১৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সরকার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে। ১ নভেম্বর পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫১ কোটি টাকা। দৈনিক হিসেবে এই ঋণের পরিমাণ ১৩৩ কোটি টাকা। নতুন নোট ছেপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। বছরের শেষে এই ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৩ হাজার তৈরি পোশাক কারখানা। ফলে বেকার হয়েছে অনেক মহিলা, যাদের অনেকের ওপর নির্ভর করতো এক একটি পরিবার। এই গার্মেন্টস কন্যার অনেকেই এখন আর গ্রামে ফিরে যাবে না। গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্র এরাই তৈরি করতে পারে। অসমতা বৈষম্য আর দারিদ্র্য ‘অকুপাই মুভমেন্টের’ জন্ম দিয়েছিল। ‘আরব বসন্ত’-এর প্রভাব পড়েছিল। এই দারিদ্র্য (জনগোষ্ঠীর ৫৬ ভাগ এখন বাংলাদেশে দরিদ্র), চলমান আন্দোলনকে আরো উসকে দিতে পারে। তৃতীয়ত, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস ‘আরব বসন্ত’-এর একটা বড় কারণ। এটা বাংলাদেশেও লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি শতকরা ১১ দশমিক ৭৩ ভাগ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে। প্রতিবাদ করেছে সরকারের অদক্ষতার ও দুর্নীতির। চতুর্থত, গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধীদলের মাঝে একটা সমঝোতার কথা বলে। আরব বিশ্বে কোথাও এই সমঝোতা ছিল না। ফলে বিরোধী পক্ষ ‘আরব বসন্ত’-এর সূচনা করেছে। আন্দোলন যখন প্রাথমিক পর্যায়ে তখন বেন আলী (তিউনিসিয়া), হোসনি মোবারক (মিসর), আলী আবদুল্লা সালেহ (ইয়েমেন), গাদ্দাফি (লিবিয়া) কিংবা বাসার (সিরিয়া) কখনো উদ্যোগ নেয়নি বিরোধী পক্ষের সাথে কথা বলার। বরং অস্ত্রের ভাষায় বিরোধী পক্ষের সাথে তারা কথা বলেছেন। এক সময় পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশেও এ রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। বিরোধীদলের সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না সরকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তখন সরকারের করার কিছুই থাকবে না। তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। পঞ্চমত, ‘আরব বসন্ত’ শুরু করেছে তরুণ সমাজ। মিসরের কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে দিনের পর দিন অবস্থান করে যারা গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তারা তরুণ। যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। ওরা সামাজিক নেটওয়ার্ক টুইটারের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিল সর্বত্র। এদের অনেকেই ছিলেন বেকার। কওকুজিজির (তিউনিসিয়া) মতো মিসরেও জনৈক ব্যক্তি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, তিনিও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং বেকার। ইয়েমেনে সরকার বিরোধী আন্দোলনে যিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং যে জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে (তাওয়াক্কুল কারমা), তিনিও তারুণ্যের প্রতীক। আর মিসরে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল অঢ়ৎরষ ৬ গড়াবসবহঃ, যা চূড়ান্ত বিচারে মোবারক সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। বাংলাদেশে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ বেকার। সরকারদলীয় অঙ্গ-সংগঠনগুলোর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত না থাকায়, তারা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সরকারি চাকরি এখন দলীয় বিবেচনায় দেয়া হচ্ছে। এই তরুণ প্রজন্ম সামাজিক নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ডে জড়িত। ‘আরব বিপ্লবে’ এরা অনুপ্রাণিত হতে পারে। মোটকথা আরব বিশ্বের বিরাজমান পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটা মিল আমরা লক্ষ্য করি। বিরোধীদল এখন আরো বেশি তৎপর ও সক্রিয়। দুর্নীতি আজ চরম পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার আজ চরমভাবে ব্যর্থ। এমনি এক পরিস্থিতিতে ‘আরব বসন্ত’-এর মতো ‘বাংলা বসন্ত’ আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়ছে। ‘আরব বসন্ত’-এর মতো ‘বাংলা বসন্ত’ যে বাংলাদেশে একটি পরিবর্তন ডেকে আনবে, তা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yohoo.com
0 comments:
Post a Comment